এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ সাড়ে তিন লাখ শিক্ষার্থী যেন হারিয়ে না যায়, সে দিকেও নজর রাখতে বলেছেন কেউ কেউ।
মাধ্যমিকে এবার ৮২ দশমিক ৮৭ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে, জিপিএ-৫ পেয়েছেন এক লাখ ৩৫ হাজার ৮৯৮ জন।
মাঝে এক বছর বাদ দিলে গত দশ বছর ধরেই পাসের হার ৮০ শতাংশের উপরে থাকছে। শুধু ২০১৮ সালে সার্বিক পাসের হার ছিল ৭৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
এবার ১৭ দশমিক ১৩ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেছে; সংখ্যার হিসেবে তা ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৫০৫ জন।
এই প্রসঙ্গ তুলে ধরে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ফলাফল দেখে সব সময়ই মনে হয়, কারো ফেল করা উচিত না। অনেকে ফেল করছে সেটাই তো অস্বাভাবিক।
“ফলাফলে (গ্রেডিংয়ে) ভালো-মন্দ থাকবে সেটা স্বাভাবিক। শিক্ষার মান বাড়ছে কিনা এটা কিন্তু পরীক্ষার ফল দেখে বোঝা যাবে না। কারণ পাসের হার বাড়ে আবার কমে যায়।”
তিনি বলেন, “শিক্ষার মান বাড়াতে হবে। উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। অভিভাবকরা অনেক সময় সন্তানের যত্ন নেন না, কোনো কোনো শিক্ষার্থীরও আগ্রহ কম থাকে, এসব বিষয়ে আমাদের নজর দিতে হবে।”
নয়টি সাধারণ বোর্ডের অধীনে এবার বিজ্ঞান বিভাগে ৯৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ, মানবিকে ৭৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ এবং ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের ৮৪ দশমিক ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে। মানবিক বিভাগে পাসের হার বাড়লে সার্বিক পাসে হার আরও বাড়ত।
গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, একটা সময় শিক্ষার্থীদের ব্যবসায় শিক্ষায় ঝোক ছিল, মানবিক সবসময়ই পিছিয়ে থাকছে। ওলটপালট হচ্ছে বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষার মধ্যে।
“সরকারের প্রয়াস, চিন্তাভাবনা এবং তথ্যপ্রযুক্তির যুগে বিজ্ঞানে তো যেতেই হবে। বিজ্ঞান শিক্ষায় সরকারের বিনিয়োগও রয়েছে। তার সাথে মানবিকের গুরুত্বটা যাতে না হারায়, যেহেতু আমরা বার বার বলছি, আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এগুলোতে এখান থেকেই আসে।”
রাশেদা বলেন, শিক্ষাক্রমের পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তকগুলোও এমনভাবে করা উচিত যেন অন্তত দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা মানবিক মূল্যবোধের বিষয়গুলো থেকে বঞ্চিত না হয়। বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা- এই তিন বিভাগের শিক্ষাক্রমের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে।
এবার এক লাখ ৩৫ হাজার ৮৯৮ জন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে। গতবার পূর্ণাঙ্গ পিজিএ পেয়েছিলেন ১ লাখ ৫ হাজার ৫৯৪ জন। সেই হিসেবে এবার জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থী বেড়েছে ৩০ হাজার ৩০৪ জন।
রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, “এই পরীক্ষা পদ্ধতি ও পুঁথিগত বিদ্যার মধ্য দিয়ে আসলে মেধার বিকাশ হয় না। শিক্ষার্থীরা পাস করছে, তাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি। কিন্তু একটা বড় সংখ্যক কিন্তু ফেল করছে, তাদের কথা যেন আমরা ভুলে না যাই, এরা যেন ঝরে না যায়।
“মানবিকের পাশাপাশি কারিগরিতেও গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বাজেটে শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের মহামারীর এই সময়ে এবং পরে শিক্ষাখাত যেন অগ্রাধিকারের খাতের তালিকা থেকে ছিটকে না যায়।
“রুটিরুজি ঠিকই আমরা সামলে নেব, একটা ব্রিজ ঠিকই বানিয়ে নেব, কিন্তু একটা প্রজন্মকে যদি শিক্ষা থেকে হারিয়ে ফেলি সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারব না।”
এক নজরে এসএসসির ফলাফল
বোর্ড | পাশের হার (%) | জিপিএ-৫ | পাসের হার (%) | পাসের হার (%) |
২০২০ |
| ২০১৯ | ২০১৮ | |
ঢাকা | ৮২.৩৪ | ৩৬,০৪৭ | ৭৯.৬২ | ৮১.৪৮ |
রাজশাহী | ৯০.৩৭ | ২৬,১৬৭ | ৯১.৬৪ | ৮৬.০৭ |
কুমিল্লা | ৮৫.২২ | ১০,২৪৫ | ৮৭.১৬ | ৮০.৪০ |
যশোর | ৮৭.৩১ | ১৩,৭৬৪ | ৯০.৮৮ | ৭৬.৬৪ |
চট্টগ্রাম | ৮৪.৭৫ | ৯,০০৮ | ৭৮.১১ | ৭৫.৫০ |
বরিশাল | ৭৯.৭০ | ৪,৪৮৩ | ৭৭.৪১ | ৭৭.৭১ |
সিলেট | ৭৮.৭৯ | ৪,২৬৩ | ৭০.৮৩ | ৭০.৪২ |
দিনাজপুর | ৮২.৭৩ | ১২,০৮৬ | ৮৪.১০ | ৭৭.৬২ |
ময়মনসিংহ | ৮০.১৩ | ৭,৪৩৪ |
|
|
মাদ্রাসা | ৮২.৮১ | ৭,৫৬১ | ৮৩.০৩ | ৭০.৮৯ |
কারিগরি | ৭২.৭০ | ৪,৮৮৫ | ৭২.২৪ | ৭১.৯৬ |
মোট | ৮২.৮৭ | ১,৩৫,৮৯৮ | ৮২.২০ | ৭৭.৭৭ |
৮২ দশমিক ৮৭ শতাংশ সার্বিক পাসের হারের মধ্যে এবার মাদ্রাসা বোর্ডের ৮২ দশমিক ৫১ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস বরলেও কারিগরিতে পাসের হার ৭২ দশমিক ৭০ শতাংশ।
এবার রাজশাহী বোর্ডে সবচেয়ে বেশি ৯০ দশমিক ৩৭ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে। আর সবচেয়ে কম পাস করেছে সিলেট বোর্ডে, ৭৮ দশমিক ৭৯ শতাংশ। সাধারণ নয়টি বোর্ডের মধ্যে এই দুই বোর্ডে পাসের হারের ব্যবধান বেশ বড়।
রাজশাহী বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. আরিফুল ইসলাম মনে করেন, যেসব বোর্ডে প্রত্যন্ত ও দুর্গম এলাকা বেশি, সেসব বোর্ডে পাসের হার তুলনামূলক কম।
তবে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশের মধ্যে পাসের হার ওঠানামা করলে তাতে বড় কোনো সমস্যা দেখছেন না তিনি।
মানবিকের শিক্ষার্থীরা এবার খারাপ ফল করেছে জানিয়ে আরিফুল বলেন, ইংরেজি ও গণিতে মানবিকের শিক্ষার্থীরা বেশি ফেল করে। এসব বিষয়ে বাড়তি নজর দিতে হবে।
বেশ কয়েক বছর ধরে রাজশাহী বোর্ডে পাসের হার ৯০ শতাংশের উপরে রয়েছে। টানা আট বছর ধরে সাধারণ বোর্ডগুলোর মধ্যে রাজশাহী বোর্ডে পাসের হার সবচেয়ে বেশি।
এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করা কীভাবে সম্ভব হচ্ছে জানতে চাইলে রাজশাহী বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বলেন, “উত্তরপত্রগুলো যাতে ঠিকভাবে মূল্যায়ন হয়, সেজন্য আমরা প্রধান পরীক্ষকদের নিয়ে কর্মশালা করেছি। প্রধান পরীক্ষকরা অন্য পরীক্ষকদের নির্দেশনা দিয়েছেন।
“সৃজনশীল প্রশ্নের জ্ঞানমূলক অংশের একটি উত্তর হলেও সেই অংশটুকু মূল্যায়নও একেক পরীক্ষক একেক রকম করে করতেন। এসব নিয়ে আমরা আলোচনা করে তাদের নির্দেশনা দিয়েছি।”
এছাড়া রাজশাহী বোর্ডের প্রত্যন্ত এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শন করে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে সমস্যা চিহ্নিত করে সেগুলো সমাধানের পদক্ষেপ নেওয়ায় পাসের হারে তার প্রভাব পড়েছে বলে মনে করেন আরিফুল।
সার্বিক পাসের হারে সন্তোষ প্রকাশ করে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ফলাফল গতবারের মতই হল। পাসের হার সন্তোষজনক তো বটেই। তাতে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের ভূমিকা বেশি। মানবিকে পাসের হার বাড়াতে আমরা উদ্যোগ নেব।”
পাসের হারের ক্ষেত্রে অনেকগুলো বিষয় নির্ভর করে জানিয়ে অধ্যাপক জিয়াউল বলেন, “শিক্ষার্থীদের মান ও প্রশ্নের মানও গুরুত্বপূর্ণ। এবার শিক্ষার যে গড় মান সেটা মোটামুটি বহাল আছে।”