একে একে সবই খুলছে, ঝুঁকিও বাড়ছে

করোনাভাইরাসের মহামারী ঠেকাতে দুই মাসের সাধারণ ছুটির শেষে অবরুদ্ধ অবস্থা কাটিয়ে অফিস, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি গণপরিবহনও চালু হচ্ছে।

মঈনুল হক চৌধুরী জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 May 2020, 08:00 PM
Updated : 28 May 2020, 08:00 PM

দেশে একদিনে সর্বাধিক কোভিড-১৯ রোগী শনাক্তের দিন বৃহস্পতিবারই ঘোষণা আসে, ৩১ মে থেকে অফিস খুলবে, বাস-লঞ্চ-ট্রেন-বিমান চলবে, খুলবে পুঁজিবাজার, ব্যাংকে লেনদেন হবে আগের মতোই। দোকান-পাট তো ঈদের আগেই খুলেছিল।

ভাইরাস সংক্রমণের দিক থেকে নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে এভাবে সব খোলার সিদ্ধান্তকে আত্মঘাতী মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। আপত্তি এসেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকেও।

তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, অর্থনীতি সচলের জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনেই এসব খোলা হবে। ১৫ জুন পর্যন্ত পরিস্থিতি দেখে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

তবে ততদিনে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার অবস্থায় থাকবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে বিশেষজ্ঞদের। কেননা দেশে ‘লকডাউন’ও ঠিকভাবে করা যায়নি, যে কারণে ভাইরাস এখন ৬৪ জেলায়ই ছড়িয়ে পড়েছে।

বৈশ্বিক মহামারী আকার ধারণ করা কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত প্রথম রোগী বাংলাদেশে ধরা পড়েছিল গত ৮ মার্চ। রোগীর সংখ্যা ১০০ ছাড়াতে লেগেছিল প্রায় এক মাস।

এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের পর থেকে রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। এক মাসের মধ্যে ৪ মে রোগীর সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যায়, ততদিনে দোকান-পাট, কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত এসেছিল।

এরপর রোগীর সংখ্যা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। এর মধ্যেই ঈদযাত্রায় ছাড় দেওয়া হলে তার প্রতিক্রিয়ায় এই মহামারীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গঠিত ‘জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির’ সদস্য ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, “তাহলে তো ভাইরাস সারা দেশে ছড়িয়ে যাবে!”

ঈদের তিন পর ২৮ মে বৃহস্পতিবার এক দিনে রেকর্ড ২ হাজার ২৯ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়ে, যা শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৪০ হাজার ছাড়িয়ে নেয়। এর মধ্যে মৃত্যু ঘটেছে ৫৫৯ জনের।

আর এদিনই সব কিছু খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত আসতে থাকে।

অফিস খোলার সিদ্ধান্তটি বুধবারই জানিয়েছিলেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। একদিন বাদে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে তার আদেশ হয়।

তাতে বলা হয়, ৩১ মার্চ থেকে সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিস নিজ ব্যবস্থাপনায় সীমিত পরিসরে খোলা থাকবে। এক্ষেত্রে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত তরার জন্য স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ থেকে জারি করা ১৩ দফা নির্দেশনা কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে।

গণপরিবহন চলার বিষয়ে আদেশে বলা হয়, সীমিত পরিসরে নির্দিষ্ট সংখ্যক যাত্রী নিয়ে স্বাস্থ্যসম্মত বিধি নিশ্চিত করে গণপরিবহণ, যাত্রীবাহী নৌযান ও রেল চলাচল করতে পারে। তবে সব অবস্থায় মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের জারি করা নির্দেশনা কঠোরভাবে মেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে।

এরপর পুঁজিবাজার খোলার ঘোষণাও আসে; তারপরই জানা যায়, আগামী সপ্তাহ থেকে ব্যাংকগুলো স্বাভাবিক সময়ের মতো খোলা থাকবে।

বাংলাদেশের আগে বিভিন্ন দেশ লকডাউন শিথিল করে জনজীবনে স্বাভাবিক করার পথে হাঁটতে শুরু করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সতর্কবার্তা অনেকটাই উপেক্ষা করেই।

তবে অন্যান্য দেশ তখনই লকডাউন শিথিল করেছে, যখন তাদের দেশে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার কমে আসছিল। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে যখন, তখন আক্রান্তের হার সবচেয়ে বেশি বাড়ছে।

এই পরিস্থিতি সব কিছু খোলার পর স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে অনুসরণের মাধ্যমে পরিস্থিতি আরও নাজুক হওয়া ঠেকাতে চাইছে সরকার।

সেজন্য চলাফেরায় বিধিনিষেধ আগের মতোই থাকছে। আগের মতোই রাত ৮টা থেকে সকাল ৬টা সবাইকে ঘরে থাকতে হবে। এই সময় জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হওয়া যাবে না।

হাট-বাজার এবং দোকানপাটগুলোতে সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত বেচাবিক্রি চলবে।

সভা-সমাবেশ, গণজমায়েত ও অনুষ্ঠান বন্ধ থাকবে। আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আপাতত বন্ধই থাকবে।

বিরোধিতায় কী বক্তব্য

সাধারণ ছুটি না বাড়িয়ে সব খোলার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা এসেছে বিএনপি ও বাম গণতান্ত্রিক জোটের কাছ থেকে।

বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী একে আত্মঘাতী ‘মন্তব্য’ করে বলেন, “ছুটির নামে তথাকথিত লকডাউন তুলে নেওয়ার পদক্ষেপের মাধ্যমে সরকার কি প্রমাণ করতে চায়- করোনার থেকে তারা শক্তিশালী?

“এই ছুটি প্রত্যাহারের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষকে আক্রান্তের দিকে ঠেলে দেওয়া হল। এই ছুটি প্রত্যাহারের জন্য করোনাভাইরাসে প্রাণহানির সকল দায় সরকারকেই নিতে হবে।”

ছুটি আর বাড়ছে না, ঈদ শেষে কর্মস্থলে ফিরতে বৃহস্পতিবার সকালে মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাটে ঢাকামুখী মানুষের ঢল।

বাম গণতান্ত্রিক জোট এক বিবৃতিতে বলছে, এটা সরকারের ‘চরম দায়িত্বহীন’ সিদ্ধান্ত।

“যেখানে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন জুন এর ১৫ তারিখের পর দেশে করোনা সংক্রমণ চূড়ান্ত উচ্চে পৌঁছানো এবং তার পর থেকে সংক্রমণ কমার সম্ভাবনা রয়েছে তখন ৩১ মে থেকে সব খুলে দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত জনগণের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা এবং চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় বহন করে।”

বাম জোট বলছে, “যেখানে স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভঙ্গুর, সরকারের অস্থিরতা ও সমন্বয়হীনতা প্রকট সেখানে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ লাইনে চলার সরকারের সিদ্ধান্ত গরিবের ঘোড়া রোগের শামিল। কারণ যে সব দেশ হার্ড ইমিউনিটির কথা বলছে, তারা গণহারে পরীক্ষা করে আক্রান্তদের আইসোলেশনে নিচ্ছে।

“আমাদের তো শুরু থেকেই পরীক্ষা সীমিত আকারে করা হচ্ছে, আক্রান্ত ও মৃত্যুর তথ্য গোপন করা, হাসপাতালসমূহের অব্যবস্থাপনা, চিকিৎসা সরঞ্জাম নিয়ে দুর্নীতি বর্তমান সরকারের ব্যর্থতাকে উন্মোচিত করেছে।”

পক্ষে কী যুক্তি

জনজীবন সচল করার ক্ষেত্রে অর্থনীতিতে প্রাণ ফেরানোর যুক্তিই দেখিয়ে আসছে সরকার।

ঈদের আগে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, “ঝড়-ঝঞ্ছা-মহামারী আসবে। সেগুলো মোকাবেলা করেই আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে।”

সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, “প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে জীবন-জীবিকার মাঝে সাযুজ্য বিধানের যে প্রয়াস চলছে, তার থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন থাকতে পারি না।

“আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশেষজ্ঞদের সাথে আলোচনা করে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।”

করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে ঢাকার একটি কারখানায় ঢোকার আগে হাত ধুয়ে নিচ্ছে শ্রমিকরা।

তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মাসের পর মাস বন্ধ রেখে কোনো দেশ টিকে থাকতে পারে না।

“উন্নত দেশগুলোতেও আস্তে আস্তে নানা কর্মকাণ্ড শুরু করা হয়েছে, মানুষ কাজে ফিরে গেছে। আমাদেরকেও ধীরে ধীরে সেই কাজটি করতে হবে।”

কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা

এক সঙ্গে প্রায় সব খুলে দেওয়াটাকে ছোঁয়াচে এই রোগ বিস্তারের সুযোগ করে দেওয়া বলে মনে করছেন ডা. মুশতাক হোসেন।

কোভিড-১৯ মহামারী ঠেকানোর লড়াইয়ে থাকা আইইডিসিআরের অবসরপ্রাপ্ত এই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রোগের সংক্রমণ বাড়ছে; মৃত্যুর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। স্কুল ছাড়া সবই তো খোলা হল। আর বাকি কী রইল?

“ঢালাওভাবে ছুটি প্রত্যাহার করে দিয়ে সবাইকে একসঙ্গে কাজে যোগ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হল। এটা তো আর সীমিত থাকবে না। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে না পারলে; এভাবে ঢালাওভাবে চাকরি বাঁচার কথা বলে কাজে যোগ দিলে সেই ঝুঁকিই তো থেকে গেল।”

ঈদের সময়কালের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে এ গবেষক বলেন, “ঈদের আগে মানুষ বের হয়েছে। এ ধারাবাহিকতায় ধীরে ধীরে সবাই বের হচ্ছে।”

অর্থনীতি সচলের চাপ থাকার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই তিনি বলেন, “সরকারের তরফ থেকে আমরাও বিশ্বাস করি (ছুটি না বাড়ানো) এখনও সামাজিক-অর্থনৈতিক চাপ আছে।

“এখন যদি মানুষের জীবনের বড় ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয় কিংবা জানমালের বড় বিপর্যয় নেমে আসে কী হবে?”

সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য মিরপুর-১ নম্বর কাঁচাবাজার উন্মুক্ত স্থানে সরানো হলেও ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে তেমন সচেতনতা দেখা যায়নি। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

এক্ষেত্রে ধাপে ধাপে খোলা উচিৎ ছিল বলে মনে করেন মুশতাক।

“জরুরি কিছু বিভাগ, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান খোলে দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে কাজ করা উচিত ছিল। ধাপে ধাপে খোলার ব্যবস্থা করা উচিৎ ছিল।”

বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের আচরণ দেখে ‘হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো অবস্থা’ বলে মনে হচ্ছে মুশতাক হোসেনের।

“এটা হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো অবস্থা। যেন আর নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এই হাল ছেড়ে দেওয়াটা হবে আত্মঘাতী। কোনো জাতির এভাবে হাল ছেড়ে দেওয়া ঠিক নয়; নিয়ন্ত্রণে আনা জরুরি।”

সব কিছু খুলে দেওয়ার পর স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে অনুসরণ করা না হলে বড় ঝুঁকির আশঙ্কা প্রকাশ করেছে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় গঠিত জাতীয় কারিগরী পরামর্শক কমিটিও।

কমিটির বৈঠকে বিশেষজ্ঞদের শঙ্কার কথা জানিয়ে তারা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, “পৃথিবীর অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতায় এই যে রোগ সংক্রমণের হার সুনির্দিষ্টভাবে না কমার আগে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চালু করলে রোগের হার বাড়ার আশংকা থাকে।

“সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রযোজ্য বিধিবিধান সঠিক পদ্ধতিতে প্রয়োগ না করে শিথিল করা হলে রোগীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করতে পারে।”

এসই ঝুঁকি এড়াতে এখন সবার দায়িত্বশীল হওয়ার উপর জোর দিচ্ছেন ড. মুশতাক হোসেন।

তিনি বলেন, “এখনও সময় শেষ হয়ে যায়নি। সবাইকে ইনভলব করে কাজ করতে হবে।

“নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই আলোচনা করে কাজের কর্মপদ্ধতি ঠিক করা উচিৎ। গণপরিবহন চলবে, কিন্তু কীভাবে দূরত্ব বজায় থাকবে। প্রতিটি জায়গায় তাদেরই দায়িত্ব দিতে হবে স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলার জন্য।”

কমিউনিটি আইসোলেশন সেন্টার স্থাপনের পাশাপাশি ঘরে ঘরে গিয়ে সেবা নিশ্চিতে স্বাস্থ্যবিভাগের প্রতি পরামর্শ দেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের নেতা ডা. মুশতাক।

“কেইস ডিটেকশন করতে হবে; আক্রান্তদের আলাদা করতে হবে এবং তাদের সারিয়ে তুলতে হবে। শহরে কমিউনিটি আইসোলেশন সেন্টার গড়ে তুলতে হবে। আরও লোকবল নিয়ে ঘরে ঘরে গিয়ে সেবা দিয়ে এবং শনাক্ত করে সেন্টারে নিয়ে যেতে হবে।”

সামনে কঠিন সময়ের কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “এখনই তো রোগের সংক্রমণ শেষ হয়ে যাচ্ছে না। সবচেয়ে বড় কথা- রোগের সেবা দেওয়ার পাশাপাশি সংক্রমণ যেন না ঘটে সেদিকে নজর দিতে হবে।”