আলোর মুখ দেখছে নজরুল ভবন

জাতীয় কবি ধানমণ্ডির যে বাড়িতে থাকতেন, সেখানে গড়ে ওঠা নজরুল ইনস্টিটিউটকে সম্প্রসারণ করে ‘নজরুল ভবন’ নির্মাণ শুরু হচ্ছে এবছরই।

জয়ন্ত সাহা নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 May 2020, 06:04 AM
Updated : 25 May 2020, 06:08 AM

তিন বছর আগে নকশা চূড়ান্ত হওয়ার পরও থমকে থাকা নজরুল ভবন এবার আলোর মুখ দেখছে; চলতি বছরেই ঢাকার ধানমণ্ডিতে শুরু হবে নির্মাণ কাজ।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ধানমণ্ডির যে বাড়িতে থাকতেন, সেখানে গড়ে ওঠা নজরুল ইনস্টিটিউটকে সম্প্রসারণ করে ‘নজরুল ভবন’ নির্মাণের ঘোষণা এসেছিল গত বছর; কিন্তু সে প্রকল্পের অগ্রগতি থমকে ছিল নকশাতেই।

নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক ভূঞা রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্ল্যান পাস হয়ে গেছে। নজরুল ভবনটি নির্মাণের কাজ দেওয়া হয়েছে সেনাবাহিনীকে। তাদের একটি কনস্ট্রাকশন ইউনিট এই ভবন নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করবে।”

২০১৬ সালের ২ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নজরুল ভবনের নকশা উপস্থাপন করেন স্থপতি ইকবাল হাবিব ও ইসতিয়াক জহির।

সে সময় তারা জানিয়েছিলেন, ধানমণ্ডির পুরাতন ২৮ নম্বরে কবি নজরুলের বাসভবনের জায়গায় আটতলা ‘নজরুল ভবন’ হবে। সেখানে থাকবে বিশেষায়িত লাইব্রেরি, ডরমিটরি ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। আর নজরুল ইনস্টিটিউটটের পাঁচতলা ভবনটি ছয়তলা করা হবে।

নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে লকডাউনের কারণে নির্মাণ কাজ ‘থমকে আছে’ বলে জানান আব্দুর রাজ্জাক।

তিনি বলেন, “নজরুল ইনস্টিটিউটের আদি নকশা ঠিক রেখে আদি ভবনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই নতুন ভবন নির্মাণ করা হবে।”

তবে নজরুল ইনস্টিটিউটের পাশে ধানমণ্ডি লেকের একাংশে ১৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘নজরুল সরোবর’ করার পরিকল্পনাও আপাতত বাদ দেওয়া হয়েছে বলে জানান ।

“আমরা সেখানে একটি এম্ফি থিয়েটার নির্মাণ করব বলে ভাবছিলাম। কিন্তু সেটা করতে গেলে আমাদের সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ আরও অনেক অনুমতির ব্যাপার আছে। হয়তো সেটা সেকেন্ড ফেইজে হবে।”

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতি রক্ষা, তার জীবন, সাহিত্য, সংগীত ও সামগ্রিক অবদান সম্পর্কে গবেষণা পরিচালনা, সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রকাশনা ও প্রচারের লক্ষ্যে ১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নজরুল ইনস্টিটিউট অর্ডিন্যান্স -১৯৮৪ অনুযায়ী ধানমণ্ডির ২৮ নং সড়কের ৩৩০-বি বাড়িতে নজরুল ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়।

পরবর্তীতে ‘কবি নজরুল ইনস্টিটিউট আইন ২০১৮’ আইনের অধীনে ‘কবি নজরুল ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

নজরুল ভবনের বিষয়ে জাতীয় কবির নাতনী খিলখিল কাজী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা যারপরনাই আনন্দিত। বঙ্গবন্ধুর কাছে আমাদের ঋণের শেষ নাই। তিনি দাদুকে যদি এ দেশে নিয়ে না আসতেন, যদি দাদুকে জাতীয় কবির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত না করতেন, তাহলে দাদুর যে কী হত.. আজ তার জন্ম বার্ষিকীতেই সেই খবর এল, সেই নজরুল ভবনটি হচ্ছে। কী যে ভালো লাগছে !

“কবি ভবন থেকে নজরুল ইনস্টিটিউট যখন হল, তখন ভেতরে রেনোভেশনের কাজ করতে গিয়ে দেখা গেল, দাদুর অনেক স্মৃতিচিহ্ন হারিয়ে গেছে। তবে এখন নজরুল কর্ণারে যতটুকু স্মৃতি আছে, তা যেন আগামী প্রজন্মের সামনে সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয়।  আমাদের পরিবারের কাউকে যেন সেখানে যুক্ত রাখা হয়, তাহলে আমরাও বলতে পারব, কোন স্মৃতি কিভাবে সাজানো হবে।”

রাজধানীর বাইরে নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র নির্মাণও থমকে আছে

নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক রাজ্জাক ভূঞা জানান, নজরুল গবেষণা ও চর্চার প্রচার-প্রসারের লক্ষ্যে সারা দেশে জাতীয় কবির স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলোতে স্মৃতিকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ রয়েছে সরকারের।

তিন বছর আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের এক প্রতিবেদনেই তিনি জানিয়েছিলেন, চট্টগ্রাম ও চুয়াডাঙ্গায় দুটি স্মৃতিকেন্দ্র নির্মাণের কাজে হাত দেওয়া হয়েছিল।

তার তিন বছর কেটে গেলেও পরিকল্পনাতেই থমকে আছে স্মৃতিকেন্দ্র নির্মাণ কাজ।

আব্দুর রাজ্জাক মিঞা জানান, চট্টগ্রামের খুলশীতে রেলওয়ের যে জমি পাওয়া গেছে, তা উলম্ব জমি বলে তাতে স্মৃতিকেন্দ্র নির্মাণ করা যাচ্ছে না।

নজরুল স্মৃতি বিজড়িত চট্টগ্রাম, ফরিদপুর, চুয়াডাঙ্গার কার্পাসডাঙ্গায় ও মানিকগঞ্জের তেওতায় জনবলসহ নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে নজরুল ইনস্টিটিউট।

 রাজ্জাক মিঞা বলেন, “সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি রাজধানী ছাড়া বাকি বিভাগীয় শহরগুলোতে স্মৃতিকেন্দ্র নির্মাণের পরামর্শ দিয়েছে। এখন পুরো ব্যাপারটি জমি প্রাপ্তি সাপেক্ষে।”

চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার কার্পাসডাঙ্গার মিশনপাড়ায় জেলা প্রশাসন ৬৬ শতাংশ জমি পাওয়া গেলেও নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র নির্মাণে আরও জমির প্রয়োজন।

“বেসরকারি মালিকাধানী জমিগুলো পেতে আমাদের আরও ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা খরচ করতে হবে,” বলেন রাজ্জাক মিঞা।

সেখানে চুয়াডাঙ্গায় হর্ষপ্রিয় বিশ্বাসের আটচালা ঘরটি সংরক্ষণ করা হচ্ছে। ১৯২০ এর দশকের শেষভাগে স্বদেশি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সপরিবারে প্রায় দুই মাস সেখানে ছিলেন নজরুল।

মানিকগঞ্জের তেওতায় নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত জমিদার বাড়ির প্রত্নতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট না করে স্মৃতিকেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে। এ নিয়ে আলোচনা চলছে প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের সঙ্গে।

আব্দুর রাজ্জাক ভূঞা বলেন, “নজরুল ভবন নির্মাণের পর ৭টি বিভাগে নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র নির্মাণের জন্য মন্ত্রণালকে আলাদাভাবে জমির দাম ধরে দিতে বলেছি।”

নজরুল ইনস্টিটিউটের অধীনে ময়মনসিংহের ত্রিশালের বিচুলিয়া বেপারিবাড়ি ও কাজীর শিমলার দারোগাবাড়িতে দুটি এবং কুমিল্লায় একটি স্মৃতিকেন্দ্র রয়েছে। সেগুলোতে জাদুঘর, লাইব্রেরি, সেমিনার হল, মিলনায়তন, প্রশিক্ষণকেন্দ্র ও রেস্টহাউস রয়েছে।

সেসব স্মৃতিকেন্দ্রে এখন সংস্কারের কাজ চলছে বলে জানান নির্বাহী পরিচালক।

কবির স্মৃতিবিজড়িত কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার দৌলতপুর গ্রামে একটি সরকারি স্থাপনা নির্মাণের দাবি করছেন গ্রামবাসী।

তবে তাতে কবি পরিবারের ঘোর আপত্তি রয়েছে।

খিলখিল কাজী বলেন, “নার্গিসের সঙ্গে দাদুর বিয়েটা যে হয়নি, সেটা তো প্রমাণিত হয়ে গেছে। দৌলতপুরবাসী দাবি করছে, বিয়েটা হয়েছে। তারা আমার দাদিকে (প্রমিলা দেবী) চূড়ান্তভাবে অস্বীকার করে। সেখানে স্মৃতিকেন্দ্র নির্মাণের যৌক্তিকতা দেখি না।”

নজরুল-রচনাবলী অনুবাদে গুরুত্বারোপ

নজরুল রচনাবলী পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদে গুরুত্বারোপ করছে নজরুল ইনস্টিটিউট।

নির্বাহী পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক ভুঁঞা বলেন, “আমাদের দেশে সমস্যা হল, ভালো অনুবাদক পাওয়া যায় না। তারপরও আমরা নজরুল রচনাবলী পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার অনু্বাদের চেষ্টা করছি।”

তিনি জানান, কবির ‘সঞ্চিতা’ কাব্যগ্রন্থ হিন্দি ভাষায় অনুবাদ হবে এ বছর। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ল্যাংলিও জাতীয় কবিকে নিয়ে গবেষণা করছেন।

খিলখিল কাজী বলেন, “মানুষকে দাদু সব কিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছিলেন। তিনি যেভাবে নিপীড়িত মানুষের পক্ষে কথা বলে গেছেন,আর কেউ কি সেভাবে বলেছেন?

“আজীবন তিনি সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতাকে ঘৃণা করেছেন। তার জীবনকর্ম বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হলে বিশ্ববাসী চিনবে মানুষের কবিকে।”

গত তিন বছরে নজরুল ইনস্টিটিউট ২টি নজরুল রচনার ইংরেজিতে অনূদিত গ্রন্থ প্রকাশ করেছে; যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘নজরুল সমগ্র’ ও ‘দ্য পাথ অব কমেট অ্যান্ড আদার এসেস’।

কবি নজরুল ইনস্টিটিউট বিগত তিন বছরে নজরুলের নিজস্ব রচনার ৬২টি গ্রন্থ, শুদ্ধ বাণী ও সুরে নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপির ৮টি গ্রন্থ, নজরুল বিষয়ক গবেষণাধর্মী ৩টি বাংলা পত্রিকা, ১১টি নজরুল গবেষণাধর্মী গ্রন্থ প্রকাশ করেছে।

তাছাড়া ইনস্টিটিউট নজরুল জীবন ও সৃষ্টি সম্পর্কিত তথ্যচিত্র ‘নজরুল জীবন পরিক্রমা’ এবং নজরুলের ৫৭টি পত্রের শ্রুতিভাষ্যও প্রকাশ করেছে।

শিশু-কিশোর, তরুণ ও উচ্চতর প্রশিক্ষণার্থীদের ৪ বছর মেয়াদী নজরুল সঙ্গীত প্রশিক্ষণ, শিশু –কিশোর ও তরুণদের জন্য ১ বছর মেয়াদী কবি নজরুলের রচনার আবৃত্তি প্রশিক্ষণ কোর্সে মোট ৮৫৮ জন শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।

শুদ্ধ বাণী ও সুরে নজরুল সঙ্গীতের প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে নজরুল সঙ্গীত প্রামাণীকরণ পরিষদ ২৫৭টি নজরুল সঙ্গীতের স্বরলিপি প্রামাণীকরণ হয়েছে।

১৮৯৯ সালের ২৪ মে (১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দ) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলা ভাষার কবিতাপ্রেমীদের কাছে তিনি প্রেমের কবি, চির যৌবনের দূত; সেইসঙ্গে তিনি বিদ্রোহী, গৃহত্যাগী বাউণ্ডুলে।

বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারী নজরুল ছেলেবেলায় পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন ‘দুখু মিয়া’ নামে। পিতৃহীন কবি একে একে হারিয়েছেন কাছের স্বজনদের। আর্থিক অসচ্ছলতাও তার জীবনকে কঠিন করে তুলেছিল।

সব বাধা অতিক্রম করে একসময় তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল হয়ে ওঠেন। সাম্য ও মানবতার চেতনায় সমৃদ্ধ ছিল তার লেখনী। কবিতায় বিদ্রোহী সুরের জন্য হয়ে ওঠেন ‘বিদ্রোহী কবি’।

১৯৪২ সালে দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে ক্রমশ বাকশক্তি হারান নজরুল। স্বাধীনতার পরপরই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসুস্থ কবিকে ভারত থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। নজরুল হন বাংলাদেশের জাতীয় কবি।

১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় কবি নজরুল ইসলামের।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর সব আয়োজন বাতিল করা হয়েছে।

নজরুলের ১২১তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় নির্মিত বিশেষ অনুষ্ঠান 'জাগো অমৃত পিয়াসী' শিরোনামের একটি অনুষ্ঠান টিভিতে সম্প্রচার হয়েছে।

এছাড়া নজরুল ইনস্টিটিউট তাদের নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলের জন্য ১৬ মিনিটের একটি অনুষ্ঠান নির্মাণ করেছে বলে জানান নির্বাহী পরিচালক।