মহামারীকালে ঘরবন্দি দিনে এল নিরানন্দের ঈদ

ঢাকায় পশ্চিম রাজাবাজারের মুদি দোকানি মোহাম্মদ নুরুর কাছে ঈদ মানে দুই ছেলে-মেয়েসহ সবার জন্য নতুন জামাকাপড় কেনা আর মুন্সিগঞ্জের বাড়িতে গিয়ে আনন্দ আয়োজনে সামিল হওয়া।

মাসুম বিল্লাহ নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 May 2020, 05:54 PM
Updated : 25 May 2020, 04:05 AM

এবার সে আয়োজনে সামিল হওয়ার চিন্তাও তার মাথায় নেই; উল্টো দুঃশ্চিন্তায় আছেন, কখন ছোবল দেয় মরণঘাতী করোনাভাইরাস।

”কেনাকাটা করমু কী, ঈদের নামই তো নাই,” বিস্ময় আর আতঙ্কের মিশেলে বলছিলেন নুরু।

দুই দশক ধরে মুদি দোকান চালানো এই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী স্ত্রী ও দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় থাকেন।

সারাবিশ্বকে অবরুদ্ধ করা আর আতঙ্কে ছড়িয়ে দেওয়া করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের মধ্যে সোমবার বাংলাদেশে উদযাপিত হচ্ছে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর।

ঈদ শব্দের অর্থ হচ্ছে আনন্দ; কিন্তু নুরুর মতো অধিকাংশ বাঙালি মুসলমানের কাছে এবার ঈদের সেই মানে নেই; তার বদলে অবরুদ্ধ আর গৃহবন্দি অবস্থায় থেকে থেকে দুঃসময় পার হওয়ার অপেক্ষায় তারা।

ছোঁয়াচে এই রোগের সংক্রমণ এড়াতে ঈদ উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীকে বলেছেন ঘরে থেকে ঈদ উদযাপন করতে।

ঈদের জামাত হলেও কোলাকুলির চেনা দৃশ্য এবার অনুপস্থিত; ভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে হাত মেলানোও বন্ধ।

রোববার নিয়মিত স্বাস্থ্য বুলেটিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, “সব ক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলবেন। কমপক্ষে ৩ ফুট সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ঈদের জামায়াতে শরিক হবেন। সব মুসলিম ভাইয়ের প্রতি অনুরোধ, ঈদে কোলাকুলি থেকে বিরত থাকবেন।”

ঈদের নামাজ শেষে কোলাকুলির চিরচেনা এই দৃশ্য এবার হয়ত দেখা যাবে না। ফাইল ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

তিন মাসের বেশি সময় ধরে সারা দেশে কার্যত অবরুদ্ধ অবস্থার মধ্যে আসা ঈদুল ফিতর ঘিরে শপিংমলগুলো খুলে দিলেও এবার জমে উঠেনি। প্রাণসংহারী ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে বিপণি বিতান খোলার সাহস করতে পারেননি অনেক ব্যবসায়ী।

রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহর থেকে লাখ লাখ মানুষের যে ঈদযাত্রা তা এবার নেই; স্বজনদের সঙ্গে ঈদ উদযাপনে যারা ঝুঁকি নিয়ে বাড়ির পথ ধরেছিলেন, গণপরিবহনহীন অবস্থায় তাদের অনেকেও পড়েছেন বিপত্তিতে।

কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারী রূপ নিয়ে বাংলাদেশেও সংক্রমণ ঘটানোর পর গত ২৬ মার্চ সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে এক ধরনের ‘লকডাউন’ অবস্থা তৈরি করে সরকার।

রোজা শুরুর পর বিধি-নিষেধ কিছুটা শিথিল হলেও এখনও সংক্রমণ এড়াতে এখনও সবাইকে ঘরে থাকতেই বলা হচ্ছে।

এমন অবস্থায় এবারের ঈদকে ‘অস্বাভাবিক’ হিসাবে মূল্যায়ন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

অশীতিপর এই অধ্যাপক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ”এ এক অস্বাভাবিক ঈদ। এই ঈদের মতো ঈদ আমরা কখনও দেখি নাই। একাত্তরের সালে ঈদ এসেছিল আতঙ্কের মধ্যে। এবার তো মানুষ বেরোতেই পারছে না।

”ঈদের অনেক অনুষঙ্গ থাকে। অনেক আনন্দের উপলক্ষ তৈরি হয়, কেনাকাটা হয়। বোনাস পেলে বিপুল কেনাকাটা হয়, তাতে বিক্রেতাদের মধ্যেও লাভের বিষয় থাকে। এবার তা নেই।”

ঈদের অনুষঙ্গে সামাজিক মেলামেশা দিক এবার বঞ্চিত হওয়ার কথা তুলে ধরে অধ্যাপক চৌধুরী বলেন, “ঈদ শিশু-কিশোরদের জন্য এটা বড় আনন্দের উপলক্ষ, তারা সবচেয়ে বেশি উপভোগ করে। এবার তো তারা বড় বিপদের মধ্যে আছে।

“ঈদের আনন্দটা আর পাওয়া যাচ্ছে না। ঈদের যে সামাজিকতা আছে, সেটাও নাই। মানুষ আত্মীয়-স্বজনকে দেখতে বাড়ি যায়, এবার যাচ্ছে না। উল্টো ভীতির মধ্যে আছে।”

অবরুদ্ধ অবস্থার মধ্যে আসা ঈদের আগের দিন করোনাভাইরাসে বাংলাদেশে কেড়ে নিয়েছে ২৮ জনের প্রাণ। এ পর্যন্ত দেশে মোট ৪৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে, আক্রান্ত হয়েছে মোট ৩৩ হাজার ৬১০ জনকে।

ঈদের আগের দিন জাতীয় ঈদগাহ তালাবদ্ধ কি কেউ আগে দেখেছে? করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে এবার ঈদের নামাজ ঈদগাহ বা খোলা জায়গার পড়ায় নিষেধাজ্ঞা, তাই এই তালা।

’ভিন্ন প্রেক্ষাপটে’ আসা ঈদ উদযাপনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি দরিদ্রদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।

ঈদ উপলক্ষে দেওয়া বাণীতে তিনি বলেন, “বিশ্বব্যাপী নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণে সৃষ্ট মহামারীর ফলে এ বছর ঈদুল ফিতর ভিন্ন প্রেক্ষাপটে পালিত হবে। এ কঠিন সময়ে আমি সমাজের স্বচ্ছল ব্যক্তিবর্গের প্রতি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছি।

“একই সাথে আমি দেশবাসীর প্রতি যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে ঈদুল ফিতর উদযাপনের আহ্বান জানাচ্ছি। নিজে ভালো থাকি-অন্যকে ভালো রাখি - এটাই হোক এবারের ঈদে সকলের প্রত্যাশা।”

ঈদ উপলক্ষে দেওয়া বাণীতে ‘অস্বাভাবিক পরিবেশের’ কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকানোর লড়াইয়ে সামনের দিকে থাকা মানুষদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, ”এই বিপদের সময় আমাদের স্বাস্থ্যকর্মী, ডাক্তার, নার্স, পুলিশ, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী, পরিচ্ছন্নতাকর্মীসহ যারা জীবন বাজি রেখে মানুষের সেবা করে যাচ্ছেন তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।”

শেখ হাসিনা বলেন, “অস্বাভাবিক পরিবেশে এবার ঈদুল ফিতর উদযাপন করছি। করোনাভাইরাস সমগ্র বিশ্বকে স্থবির করে দিয়েছে। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। এক অদৃশ্য ভাইরাস মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

”আমরা বাধ্য হচ্ছি নিজ নিজ অবস্থানে ধৈর্য্য সহকারে অবস্থান করতে যাতে অপরকে সংক্রমিত না করি বা নিজে সংক্রমিত না হই।”

করোনাভাইরাস সঙ্কটের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় দুর্গত ঝালকাঠির চরের এই পরিবারে নেই ঈদের খুশি

সহনশীল ও সহানুভূতিশীল মনে একে অপরকে সাহায্য করার আহ্বান জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, “পাশাপাশি আমি করোনাভাইরাসের এই মহামারীতে অনুরোধ করব, যথাসম্ভব গণজমায়েত এড়িয়ে আমরা যেন ঘরে পরিবার-পরিজন নিয়ে ঈদের আনন্দ উপভোগ করি এবং আল্লাহ্তায়ালার দরবারে বিশেষ দোয়া করি যে এই সংক্রমণ থেকে আমরা সবাই দ্রুত মুক্তি পাই।”

ঈদ উদযাপনের এই সময়ে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন অনেকে; আবারও অনেককে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কেবল চিকিৎসার জন্য ঘুরতে হচ্ছে হাসপাতালে হাসপাতালে।

মুগদা হাসপাতালে কোভিড-১৯ নিয়ে ভর্তি ছোট ভাইয়ের সর্বশেষ টেস্ট রিপোর্টের পাঁচদিন অপেক্ষা থাকার কথা উল্লেখ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা লীনা পারভীন বলেন, ’দুঃশ্চিন্তার কালে’ আবদ্ধ হয়ে আছেন তাদের পরিবারের সবাই।

তিনি বলেন, ”করোনায় যারা আক্রান্ত হয়নি, তারা এই মানসিক ট্রমার কিছুই বুঝতে পারবে না। কাল (সোমবার) ঈদ অথচ আমাদের ঈদ নেই। আব্বা-আম্মা একদিকে, আমরা একেক ভাই বোন একেক দিকে, ছোট ভাই হাসপাতালে আর তার ছোট দুটি বাচ্চা নিয়ে ভাইয়ের বউ একা আছে আরেক বাসায়। হে সৃষ্টিকর্তা তুমি অতি বড় শত্রুকেও এমন দুঃসময় দিও না।”

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের ক্ষেত্রে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে ঘূর্ণিঝড় আম্পান।

ঘূর্ণিঝড় আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত বাগেরহাটের এই পরিবারে ঈদের আনন্দ নেই

তারিখের হিসাবে রোজার শেষে ঈদ এলেও আম্পানের কারণে জ্বলোচ্ছাসে প্লাবিত খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের প্রায় ১০টি উপজেলার মানুষের সামনে এখন টিকে থাকার সংগ্রাম।

”বেঁচে আছে এটাই তাদের ঈদ,” ফেইসবুকে কয়েকটি ছবি প্রকাশ করে এভাবে নিজ এলাকার বানভাসি মানুষের দুর্দশার বর্ণনা দিয়েছেন সাংবাদিক আবদুল্লাহ মুয়াজ।

আবহাওয়া ভালো থাকলে এমনিতে দেশে ঈদের প্রধান জামাতটি হয় ঢাকায় জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে। রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রিসভার সদস্য, সংসদ সদস্য, রাজনীতিবিদ, কূটনীতিকসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ সেই জামাতে নামাজ পড়েন ঈদের সকালে। এবার তা হচ্ছে না।

প্রতিবছর কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় দেশের সর্ববৃহৎ ঈদ জামাতের আয়োজন হয়। ধর্ম মন্ত্রণালয় খোলা মাঠে ঈদ জামাত আয়োজনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় শোলাকিয়া ময়দানেও এবার জামাত হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক সারওয়ার মুর্শেদ চৌধুরী।

ঢাকায় প্রতিবার সিটি করপোরেশনের ব্যবস্থাপনায় জাতীয় ঈদগাহসহ ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঈদ জামাতের আয়োজন করা হলেও এবার তা হচ্ছে না।

তবে কেন্দ্রীয়ভাবে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে বরাবরের মতই পাঁচটি ঈদ জামাতের আয়োজন থাকছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে সেখানে থাকছে বিশেষ ব্যবস্থা।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, বায়তুল মোকাররমে প্রথম জামাত হবে সোমবার সকাল ৭টায়। এরপর সকাল ৮টা, ৯টা, ১০টা এবং পৌনে ১১টায় হবে বাকি চারটি ঈদ জামাত।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, সোমবার রাজধানীসহ দেশের অধিকাংশ এলাকায় বৃষ্টি থাকবে না। রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও বৃষ্টি হতে পারে। অন্যত্র আকাশ আংশিক মেঘলাসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকবে।