মানুষের গৃহবন্দিত্বে হাঁফ ছেড়েছে খাঁচাবন্দিরা

মুক্ত প্রকৃতিতে ঘুরে বেরানোর অধিকার ঘুচেছে অনেক আগেই; খাঁচাবন্দি জীবনেও ছিল না স্বস্তি। নতুন করোনাভাইরাস অনেক মানুষের প্রাণ কাড়লেও এই মহামারীই যেন কিছুটা হাঁফ ছাড়ার সুযোগ করে দিয়েছে চিড়িয়াখানার প্রাণীগুলোকে।

সুমন মাহমুদ জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 May 2020, 07:33 AM
Updated : 24 May 2020, 10:45 AM

মানুষের উপস্থিতিতে খাঁচাতেও একটু শান্তিতে থাকার জো ছিল না। দুই মাসের বেশি সময় হল, খাঁচা ঘিরে নেই মানুষের হল্লা। ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে মানুষ যখন ঘরবন্দি, এমন সুনসান পরিবেশে পেটপুরে খাওয়া, নিশ্চিন্ত ঘুম আর ঘুরে-ফিরে কাটছে মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানার প্রাণীদের দিন।

গত ২৬ মার্চ থেকে ‘সাধারণ ছুটি’ শুরুর পর থেকে সবকিছুর মতো চিড়িয়াখানাও বন্ধ রয়েছে ২৬ মার্চ থেকে।

চিড়িয়াখানার কিউরেটর মো. নূরুল ইসলাম জানালেন, এমন পরিস্থিতিতে খাঁচাবন্দি পশু-পাখিগুলোর দিন ‘ভালোই’ কাটছে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “মহামারীর মধ্যে বন্ধ চিড়িয়াখানায় সব প্রাণী বর্তমানে ভালো আছে, সুস্থ আছে। তারা খাঁচার স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরা করছে, কোনো অস্বস্তি নেই। তাদের প্রতিদিন যা খাবার দেওয়া হচ্ছে, সবই খেয়ে ফেলে, এখন আর উচ্ছিষ্ট থাকে না।”

জোড়া যেসব প্রাণী আছে, খাঁচার সামনে মানুষজন না থাকায় তারাও নির্বিঘ্নে করে ‘ঘর-সংসার’ করছে জানিয়ে কিউরেটর জানান, ২৫ মার্চ এক জিরাফ দম্পত্তির খাঁচায় এসেছে নতুন অতিথি। সঙ্কটের মধ্যে জন্ম নেওয়ায় সেটির নাম রাখা হয়েছে ‘দুর্জয়’।

কর্তৃপক্ষের বিশেষ অনুমতি নিয়ে খাঁচার কাছে গিয়ে দেখা হল ‘দুর্জয়ের’ সাথে। আঙ্গিনায় খানিকটা বড়সড় জায়গার তাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ‘জিরাফ দম্পতি’।

বছরের প্রথম দিকে আরেকটি জিরাফ দম্পতি একটি কন্যা জিরাফের জন্ম দেয়। ‘শ্রাবণী’ নামের সেই শাবক এখন বেশ বেড়ে উঠেছে।

আরো অতিথির আগমনের সুসংবাদও জানালেন কিউরেটর।

“এমুর খাঁচায়ও নতুন অতিথি এসেছে, ১১টি বাচ্চা হয়েছে। বেশ কয়েকটি উট পাখি, ময়ূরও ডিম দিয়েছে। আশা করছি শিগগিরই নতুন অতিথিরা আসবে।”

মানুষের উপস্থিতি না থাকায় প্রাণীগুলোর প্রজনন এখন ‘নির্বিঘ্নে’ হতে পারছে বলে জানালেন নূরুল ইসলাম।

“দেখা যাচ্ছে, দর্শক না থাকায় নিরিবিলি পরিবেশে প্রাণী, পাখিরা প্রজনন সঠিকভাবে করতে পারছে। সুষম খাবার দেওয়ায় তারা নিয়মিত ডিম ও বাচ্চা দিচ্ছে।”

তিনটি জলহস্তিকে খাঁচায় কাদায় গড়াগড়ি করতে দেখা গেল। মাঝেমধ্যে চোখ ‍খুলতেও যেন চরম আলস্য তাদের। দুপুরে আকাশে যখন মেঘের খেলা চলছে, তখন পাশের খাঁচায় আরো কয়েকটি জলহস্তি ডুবসাঁতার দিচ্ছিল।

সিংহ আর বাঘগুলোও সকালের খাবার খেয়ে খাঁচার ভেতর গড়াগড়ি করে কাটাচ্ছে।

চিড়িয়াখানার আলোকচিত্রী মো. আনোয়ার রনি বলেন, “এখন মানুষের কোলাহল নেই। প্রাণীগুলো নিজেদের মত করেই এখন সময় কাটায়। আগে অনেক মানুষজন খাঁচার কাছে থাকত তখন তাদের মধ্যে এক ধরনের জড়তাও থাকত, এখন সেটি নেই। নিশ্চিন্তে, নীরবে সময় কাটছে তাদের।”

২৮৬ একরের ঢাকা চিড়িয়াখানায় তিন হাজারের মত প্রাণী রয়েছে। ‘জাতীয় চিড়িয়াখানার আধুনিকায়ন’ প্রকল্পের আওতায় এখন ভেতরে রাস্তা সংস্কার, বিভিন্ন খাঁচা মেরামত, সামনের গেইট নির্মাণ, পার্কিংসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ চলছে। আরো একবছর এই আধুনিকায়ন চলবে।

কিউরেটর নূরুল ইসলাম জানালেন, করোনাভাইরাসের কারণে তারা বাড়তি সতর্কতামূলক ব্যবস্থাও নিয়েছেন। চিড়িয়াখানার কোনো কর্মী আক্রান্ত হননি।

তাছাড়া কয়েকদিন পরপরই প্রাণীগুলোর খাঁচায় জীবাণুনাশক ছিটানো হচ্ছে।

তিনি জানান, দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ থাকলেও চিড়িয়াখানার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিয়মিত প্রাণীদের দেখভাল করছে। দুই শিফটে তিনজন কর্মকর্তার নেতৃত্বে ৭০ জন কর্মচারী এই কাজ করছেন।

প্রতিবছর ঈদের ছুটিতে নগরীর মানুষ বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে ছোটে; মিরপুর চিড়িয়াখানাতেও উপচে পড়া ভিড় থাকে। তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন।

অন্যসব দিনের মতই চিড়িয়াখানার প্রাণীদের ঈদের দিনটি কাটবে। খাবারেও থাকবে না কোনো ব্যতিক্রম বা বিশেষত্ব।

কিউরেটর মো. নুরুল ইসলাম বলেন, “প্রতিদিন যে খাবার আমরা দিই, সেই খাবারই ঈদের দিন দেওয়া হবে। কারণ তাদের যে রেশন সেটা পরিবর্তন করলে বদহজম বা পেটে অসুবিধা হতে পারে। সেজন্য বিশেষ দিনে ব্যতিক্রম কিছু করার কোনো সুযোগ নেই প্রাণীদের ক্ষেত্রে।”