পুলিশের চোখ এড়িয়ে ট্রাকে যাত্রী যাচ্ছে কীভাবে

ঢাকা থেকে ২৭০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে গাইবান্ধায় পৌঁছাতে অন্তত ছয়টি পুলিশ চেকপোস্ট পড়ার কথা, আর করোনাভাইরাস সঙ্কটে লকডাউনের মধ্যে পণ্যবাহী গাড়িতে কোনো যাত্রী থাকার কথা নয়।

কামাল তালুকদারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 May 2020, 06:11 PM
Updated : 22 May 2020, 06:17 PM

তারপরও ঝড়ের সকালে উল্টে যাওয়া একটি ট্রাক সরিয়ে পাওয়া গেল ১৩ জনের লাশ। রডবোঝাই ওই ট্রাক যাত্রী নিয়ে কীভাবে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে ঢাকা থেকে গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে পৌঁছাতে পারল?

বিষয়টি খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের একটি তদন্ত দল গঠন করেছে গাইবান্ধা জেলা প্রশাসন। তবে পুলিশ, যাত্রী আর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, পণ্যবাহী গাড়িতে যাত্রী তোলার নিয়ম থাকলেও তাতে ফাঁকও রয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরে হাইওয়েতে কাজ করা পুলিশ সদস্যরা বলছেন, পণ্যবোঝাই ট্রাকগুলো রাতে মহাসড়কে অনেকটাই বাধাহীনভাবে চলাচল করে। ফলে চালকরা ‘প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে’ যাত্রী তুললে অনেক ক্ষেত্রে বোঝার উপায় থাকে না।

আবার পুলিশকে ‘টাকা দিলে’ ট্রাক ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ যে অনেক পুরনো, সে কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন আন্তঃজেলা ট্রাক চালক ইউনিয়নের একজন নেতা।

করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে আন্তঃজেলা বাস বন্ধ প্রায় দুই মাস ধরে। তারপরও মানুষ নানা কৌশলে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় যাচ্ছে, সঙ্গে ছড়াচ্ছে ভাইরাস। 

গত দুই মাসে লকডাউনের মধ্যেও অন্তত দুই দফা মহাসড়কে পোশাক শ্রমিকদের স্রোত দেখেছে বাংলাদেশ। কেউ ট্রাকে বা পিকআপে, কেউবা অন্য বাহনে ভেঙে ভেঙে গ্রামের বাড়ি থেকে পৌঁছেছেন ঢাকা, গাজীপুর বা নারায়ণগঞ্জের কোনো পোশাক কারখানায়।

ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে এবার সবাইকে যার যার অবস্থানে থেকে রোজার ঈদ করতে বলেছে সরকার। কিন্তু ঈদের দুদিন আগে শুক্রবারও দেখা গেছে, ঢাকা থেকে বিভিন্ন উপায়ে মাওয়া বা শিমুলিয়া ফেরি ঘাট কিংবা বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে পৌঁছে পরে বিকল্প বাহন খুঁজে বাড়ি পৌঁছানোর মরিয়া চেষ্টা।

গত ২৬ মার্চ থেকে প্রতিবার লকডাউনের মেয়াদ বাড়ার পর সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় দফায় দফায় বলে আসছে, পণ্যবাহী গাড়িতে যাত্রী বহন করলেই শাস্তি। পুলিশ কর্মকর্তারাও এ বিষয়ে হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছেন।

কিন্তু তাদের চেষ্টা যে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হচ্ছে, সে কথা বলে দিচ্ছে গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে ১৩ মৃত্যুর ঘটনা।

কী ঘটেছে পলাশবাড়ীতে?

ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তাণ্ডবের মধ্যে বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার জুনদহ দুবলাগাড়ী এলাকায় রংপুর-ঢাকা মহাসড়কে একটি ট্রাক উল্টে ডোবায় পড়ার খবর পান গোবিন্দগঞ্জ হাইওয়ে থানার পুলিশ সদস্যরা।

ওই থানার ওসি আবদুল কাদের জিলানী বলেন, ফায়ার সার্ভিসের সহযোগিতায় ঘটনাস্থলে গিয়ে ট্রাকটি সরিয়ে থানায় আনে পুলিশ। চালক বা সহকারী কাউকেই সেখানে পাওয়া যায়নি।

ঝড় কমার পর দুপুরে ঘটনাস্থলে গিয়ে ডোবা থেকে রড সরাতে গিয়ে পাওয়া যায় ১৩টি লাশ। তাদের মধ্যে ১০ জন মধ্যবয়স্ক পুরুষ, বাকিরা শিশু-কিশোর। 

“ধারণা করা হচ্ছে করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে বাস বন্ধ থাকায় তারা আইনশৃংখলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে ঢাকা বা গাজীপুর থেকে ওই ট্রাকে করে বাড়ি ফিরছিলেন,” বলেন ওসি।

প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে পলাশবাড়ী থানার ওসি মাসুদুর রহমান বলেন, ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা রংপুরগামী ওই ট্রাকে রডের ওপর বসে বাড়ি ফিরছিলেন তারা। ট্রাকটি ত্রিপলে ঢাকা ছিল।

“প্রচুর বৃষ্টি ও হালকা ঝড়ো হাওয়ার মধ্যে ট্রাকটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়কের পাশে ডোবার পানির মধ্যে উল্টে পড়ে। তাতে তারা রডের নিচে পানির মধ্যে চাপা পড়ে আর বের হতে পারেননি। ফলে ঘটনাস্থলেই তারা মারা যান।”

পুলিশ কেন জানতে পারল না?

হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) রহমতুল্লাহ অপু এ বিভাগে কাজ করছেন তিন বছর ধরে।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, যেসব ট্রাক মালামালে বোঝাই থাকে, বিশেষ করে যেগুলো রড, সিমেন্টের গাড়ি সেগুলো রাতে থামাতে গেলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকে। 

“একজন চালক সেটা ভালো করেই জানে। হয়ত সেই সুযোগটিই নিয়েছিলেন গাইবান্ধায় দুর্ঘটনায় পড়া ট্রাকের চালক। টাকার লোভে পথে থেকে ভাড়ায় মানুষ তুলেছিলেন ট্রাকে।”

লকডাউনের মধ্যে যাত্রীবাহী বাস চলাচলে নিষেধ থাকলেও পণ্যবাহী পরিবহন চলছে প্রয়োজনের খাতিরেই।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঢাকা থেকে বের হওয়ার এবং ঢোকার সময় ৪০ কিলোমিটার পর পর চেকপোস্ট থাকে। সেখানে কোনো কাভার্ডভ্যান বা ট্রাকে যাত্রী পাওয়া গেলে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা তাদের নামিয়েও দিচ্ছেন।

“কিন্তু শত শত ট্রাক চলে মহাসড়কে, রাতে ফাঁকা রাস্তায় গতিও থাকে অনেক বেশি। বাস্তবতা হল, ওই সময় ট্রাক থামানো যায় না।”

দারুস সালাম জোনের পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মাহমুদা আফরোজ লাকী বিভিন্ন সময়ে গাবতলী চেকপোস্টে দায়িত্ব পালন করেছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রাতের বেলায় গাড়িগুলোর গতি থাকে অনেক বেশি। যে গাড়িকে সন্দেহ হয়, কেবল সেটাই থামানো হয়।

“প্রতি মিনিটে গড়ে একটি গাড়ি যাতায়াত করে। ধরে ধরে প্রতিটি গাড়ি থামাতে গেলে সারা রাতেও গাড়িগুলো বের করা যাবে না।”

গাইবান্ধার দুর্ঘটনার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “ট্রাকের চাকার দিকে তাকালেই বোঝা যায়, সেটি কতটুকু বোঝাই করা হয়েছে। যেসব গাড়ি পুরো বোঝাই থাকে, আর যদি রড, সিমেন্ট থাকে গাড়িতে তাহলে সেসব গাড়ি সাধারণত চেকপোস্টে থামানো হয় না।

“কিন্তু এই সুযোগে চালকরা যদি এই মহামারীর সময়ও প্রতারণার আশ্রয় নেয় তাহলে কীভাবে ঠেকানো যাবে? এটা মানসিকতার বিষয়।”

হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মল্লিক ফকরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এই লকডাউনের সময়ও সারা দেশে প্রায় ৩০ হাজার ট্রাক ‘অতি জরুরি পণ্য’ নিয়ে যাতায়াত করে।

পুলিশের জনবলের অপ্রতুলতার কারণেও অনেক বেশি গাড়ি থামিয়ে তল্লাশি করা সম্ভব হয় না জানিয়ে তিনি বলেন, “যদি করতে যাওয়া হয় তাহলে দীর্ঘ যানজট লেগে যাবে।”

মল্লিক জানান, দুই দিন আগে টাঙ্গাইলে একটি ছোট্ট ট্রাক থামনো হয়, দেখা যায় তার ভেতরে নারী-পুরুষ মিলে ৪৫ জন উত্তরবঙ্গের দিকে যাচ্ছেন।

“এত মানুষ কীভাবে এত অল্প জায়গায় বসেছিল, তা আমার কাছে বোধগম্য নয়। তারা নিঃশ্বাস কীভাবে নিচ্ছিল! সন্দেহজনক হলেই পুলিশ গাড়ি থামায়, তল্লাশি করে, তারপরও…।”

ঘাটে পৌঁছে ফেরিতে উঠতে বেগ পেতে হয়নি কারও; তাদের ঠেকানোর কোনো চেষ্টাও দেখা যায়নি। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

কৌশল

পুরান ঢাকার রড ব্যবসায়ী ফারুক আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, একটি ট্রাকে রড বোঝাই করার পর উপরে ত্রিপল বা পর্দা দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়, যাতে বৃষ্টির পানিতে রড লালচে না হয়।

তিনি বলেন, বর্তমানে ঢাকার নয়াবাজারে সব রডের দোকান বন্ধ। মালামাল সব পাগলা ও ফতুল্লার মিল থেকে সরাসরি ট্রাকে তোলা হচ্ছে।

প্রতিটি গাড়িতে সর্বোচ্চ বিশ টন রড তোলা যায় জানিয়ে তিনি বলেন, গাইবান্ধায় দুর্ঘটনায় পড়া গাড়িতেও বিশ টন রড ছিল। 

“টিভিতে যে ছবি দেখেছি, তাতে আমার ধারণা, গাইবান্ধায় দুর্ঘটনায় পড়া ওই ট্রাকে রডের উপর ত্রিপল দেওয়ার পর কৌশলে ফাঁক সৃষ্টি করে আরেকটি পর্দা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, যাতে পথে পুলিশ বুঝতে না পারে যে যাত্রী তোলা হয়েছে।”

কামরাঙ্গীর চরের তারাবানু বিভিন্ন বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করেন। বাস বন্ধ থাকলেও সম্প্রতি তিনি ছোট ছোট তিন সন্তান আর স্বামীকে নিয়ে জামালপুরে চলে গেছেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, খোলা ট্রাকে করে কিছু পথ যাওয়ার পর পুলিশে নামিয়ে দিয়েছে। কিছু পথ হেঁটে আবারও অন্য কোনো ট্রাকে উঠেছেন। এভাবে পথে তিনবার ট্রাক বদলে তিনি বাড়ি পৌঁছেছেন।

লেনদেনও হয়?

সব চালক যে নিয়ম মানেন না, নির্ধারিত পণ্যের বাইরেও অন্য মাল এবং কখনও কখনও মানুষও যে তারা পরিবহন করেন, সে কথা স্বীকার করছেন বাংলাদেশ আন্তঃজেলা ট্রাক চালক ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. মিল্লাত হোসেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “কিছু চালকের এ রকম ঝোঁক থাকে, এটা ঠিক। রডের গাড়িতে ওইভাবে লোক তুলে গাইবান্ধা নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও হয়ত এটাই হয়েছে।”

তবে পুলিশের আরও সতর্ক থাকা উচিত ছিল মন্তব্য করে মিল্লাত বলেন, “বোঝাই করা গাড়ি বা ওভারলোড গাড়ি না ধরার যে প্রবণতা পুলিশের এগুলো বেশি বেশি তল্লাশি করা উচিত। আর মোড়ে মোড়ে পুলিশকে টাকা দিলে ট্রাক ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগতো অনেক পুরনো। অবশ্য গাইবান্ধার ওই ট্রাকে কী হয়েছিল তা আমার জানা নেই।”

তবে টাকা নিয়ে ট্রাক ছাড়ার ওই অভিযোগ মানতে রাজি নন দীর্ঘদিন হাইওয়ে পুলিশে কাজ করা পুলিশ পরিদর্শক মশিউর রহমান।

বর্তমানে ঢাকা মহানগরের ট্রাফিক বিভাগে কর্মরত এই পুলিশ কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন মহামারীর যে পরিস্থিতি, এই মুহূর্তে কোনো ট্রাকে এভাবে মানুষ নেবে, আর ট্রাফিক পুলিশ টাকার বিনিময়ে তাদের ছেড়ে দেবে, এমন মানসিকতা কোনো পুলিশ সদস্যের নেই।”

তিনি বলেন, “পুলিশের অনেক সদস্য করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এবং অনেকে মারা গেছেন শুধু মানুষকে সেবা দিতে গিয়ে। এভাবে মানুষ নিয়ে যাবে গাদাগাদি করে আর টাকা দিলে ছেড়ে দেবে, এটা মানতে পারছি না।”