বৃষ্টি ঝরিয়ে দুর্বল আম্পান

অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় আম্পান ঘণ্টায় দেড়শ কিলোমিটার বেগের ঘূর্ণিবায়ু নিয়ে সুন্দরবন ও পশ্চিমবঙ্গের ওপর তাণ্ডব চালানোর পর তুলনামূলকভাবে কম শক্তি নিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 May 2020, 08:08 PM
Updated : 21 May 2020, 03:55 AM

বুধবার রাতে ঘূর্ণিঝড়টির গতি-প্রকৃতি দেখে অনেকটা হাঁফ ছাড়ার সুরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের পরিচালক মো. মহসীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা অনেকটা সেইফ হয়ে গেছি এবার। সরাসরি আমাদের দিকে এলে ক্ষতি বেশ হত।”

সুপার সাইক্লোন আম্পান শক্তি কিছুটা হারিয়ে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় রূপে বুধবার দুপুরের পর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ উপকূলে আঘাত হানে। কলকাতার উপর দিয়ে ঝড় বয়ে যাওয়ার সময় এর বাতাসের তীব্রতা ছিল ঘণ্টায় ১৩৩ কিলোমিটারের মতো।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায়, উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণায় রীতিমত ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে এ ঝড়। বুধবার মধ্যরাত পর্যন্ত অন্তত ১০ জনের মৃত্যুর খবর জানিয়েছেন তিনি।

ঝড়ে বাংলাদেশের পাঁচ জেলা থেকেও অন্তত ছয়জনের মৃত্যুর খবর এসেছে। বহু গাছপালা ও ঘরবাড়ি উপড়ে যাওয়ার খবরও এসেছে। বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছে উপকূলের ১০ লাখ মানুষ।

মহসীন রাত সাড়ে ১১টায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির বড় চিত্র পাওয়া যায়নি।”

তবে ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত চিত্র বোঝা যাবে বৃহস্পতিবার সকাল হওয়ার পর।

মহসীন বলেন, “অনেক এলাকা অন্ধকার। প্রাণহানির পূর্ণাঙ্গ তথ্য আসেনি। জোয়ারের সময় ৪-৫ ফুট উচ্চতায় পানি উঠেছে। শ্যামনগর-আশাশুনিতে বাঁধ ভেঙেছে। এখনও ঝড়ের কবলে এলাকাবাসী। আশ্রয় কেন্দ্রে কর্মকর্তাদের কাজ শেষ হলে কাল প্রাথমিক চিত্র পাব।”

ঘূর্ণিঝড় আম্পান উপকূলে আসার আগে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় সাগর পাড়ের মানুষ নিজেদের জীবন রক্ষায় যাচ্ছেন আশ্রয় কেন্দ্রে। ছবি: সুমন বাবু

ততক্ষণে প্রচুর বৃষ্টি ঝরিয়ে আম্পান আরও দুর্বল হয়ে যাবে এবং ক্রমান্বয়ে স্থল নিম্নচাপে পরিণত হবে বলে আশা করছেন বাংলাদেশের আবহাওয়াবিদরা।

ঘূর্ণিঝড়ের কারণে মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ১০ নম্বর এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরেও ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখাতে বলেছিল বাংলাদেশের আবহাওয়া অফিস।

উপকূলীয় জেলার দ্বীপ ও চরের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ১০-১৫ ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে বলেও সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল।

রাতে মহাবিপদ সংকেত বহাল থাকলেও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বৃহস্পতিবার তা নামিয়ে সতর্ক সংকেত দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদ মনোয়ার হোসেন।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মহসীন বলেন, “ক্ষয়ক্ষতি কমাতে আমরা ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছিলাম, ২৪ লাখ লোককে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্রে।

উপকূলে আঘাত

গত ১৬ মে নিম্নচাপ থেকে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়া আম্পান এক পর্যায়ে শক্তি বাড়িয়ে সুপার সাইক্লোনে পরিণত হয়েছিল। বঙ্গোপসাগরের সাম্প্রতিক ইতিহাসে দ্বিতীয় সুপার সাইক্লোন এটি। তবে উপকূলের দিকে ধেয়ে আসতে আসতে কিছুটা শক্তি হারিয়ে তা অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়।

ভারতীয় আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, স্থানীয় সময় বুধবার বেলা আড়াইটার দিকে এ ঝড় যখন সুন্দরবন এলাকা দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করা শুরু করে, তখন এর কেন্দ্রের কাছে বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৫৫ থেকে ১৬৫ কিলোমিটার, যা দমকা বা ঝেড়ো হাওয়ার আকারে ১৮৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছিল।

প্রায় ৪০০ কিলোমিটার ব্যাসের এ ঝড়ের কেন্দ্র অর্থাৎ চোখ মোটামুটি চার ঘণ্টা সময় নিয়ে বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭টার দিকে সুন্দরবন এলাকা দিয়ে পুরোপুরি স্থলভাগে উঠে আসে। ততক্ষণে ঝড়ের অগ্রভাগ পৌঁছে গেছে কলকাতায়।

ভারতীয় সময় সন্ধ্যা ৭টা ২০ মিনিটে কলকাতায় আম্পানের ঝড়ো হাওয়ার গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৩৩ কিলোমিটার।

আনন্দবাজার লিখেছে, এ ঝড়ে সুন্দরবন এলাকার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। দুই ২৪ পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুরে লণ্ডভণ্ড পরিস্থিতি। কলকাতা, হাওড়া, হুগলি এবং পশ্চিম মেদিনীপুরেও বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। হাজার হাজার কাঁচা ঘরবাড়ি, গাছপালা ভাঙার খবর এসেছে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে।

আম্পানের প্রভাবে মঙ্গলবার দুপুর থেকেই বাংলাদেশের অনেক জায়গায় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। মধ্যরাতের পর বৃষ্টির বেগ বাড়তে শুরু করে। বুধবার সকাল থেকে বাড়ে বাতাসের জোর। সেই সঙ্গে উপকূলীয় জেলাগুলোতে নদীর পানিও বাড়তে শুরু করে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সাতক্ষীরা প্রতিনিধি জানান, ঝড়ের বর্ধিতাংশ বাংলাদেশ উপকূলে ঢুকে পড়ার পর সন্ধ্যা ৬টার দিকে শুরু হয় প্রবল ঝড়ো বাতাসের দাপট।

আবহাওয়াবিদ মনোয়ার হোসেন বলেন, ঘূর্ণিঝড় উপকূল অতিক্রম করার সময় সাতক্ষীরায় ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৫১ কিলোমিটার বেগে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যায়।

স্থলভাগে উঠে আসার পর বৃষ্টি ঝরিয়ে কমতে শুরু করে ঝড়ের শক্তি।

ভারতের আবহাওয়া অফিস বলছে, আরও উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশের মাঝের সীমান্ত অতিক্রম করছে।

জয়েন্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টারের পূর্বাভাস অনুযায়ী, এ ঝড়ের কেন্দ্র সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে মেহেরপুর এলাকা দিয়ে। তখন তা প্রবল ঘূর্ণিঝড় হয়েই থাকছে, তখন তার কেন্দ্রে বাতাসের বেগ ১০০ কিলোমিটারের নিচে নেমে আসবে।

বাংলাদেশে ঢোকার পর তা আরও শক্তি হারিয়ে ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেবে। তারপর বৃষ্টি ঝরাতে ঝরাতে তা রাজশাহী অঞ্চল পেরিয়ে আরও দুর্বল হয়ে স্থল নিম্নচাপে পরিণত হয়ে মিলিয়ে যেতে থাকবে।

পাঁচ জেলায় ৬ মৃত্যু

>> সন্ধ্যায় ঝোড়ো বাতাসের মধ্যে সাতক্ষীরা সদরে গাছচাপা পড়ে এক গৃহবধূর মৃত্যু হয়েছে।

>> পটুয়াখালীতে গাছচাপা পড়ে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া নৌকাডুবিতে নিখোঁজ ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) এক সদস্যের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।

>> সন্ধ্যায় বৃষ্টির মধ্যে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলায় দেয়ালে চাপা পড়ে শাহজাহান মোল্লা (৫৫) নামের একজনের মৃত্যু হয়েছে।

>> ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার আগেই ভোলার চরফ্যাশনে ঝড়ো বাতাসে গাছ ভেঙে পড়ে ছিদ্দিক ফকির নামের ৭০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়।

>> মঙ্গলবার রাত ১২টার দিকে বরগুনার সদর উপজেলার আশ্রয়কেন্দ্র যাওয়ার পথে এক ব্যবসায়ী অসুস্থ হয়ে মারা যান।

পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক ক্ষতি

ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়েছে কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের সমুদ্র উপকূলীয় বিভিন্ন এলাকা। অন্তত ১০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে বলে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, ঝড়টি পুরোটাই পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। এতে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা ‘ধ্বংস’ হয়ে গেছে, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে, প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

দুপুর আড়াইটার দিকে ঘূর্ণিঝড়টি স্থলভূমিতে ঢুকে পড়তে শুরু করে এবং সন্ধ্যায় দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুন্দরবন উপকূলে আছড়ে পড়ে আম্পান। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কলকাতায় ঘণ্টায় প্রায় ১৩৩ কিলোমিটার বেগে বয়ে যায় ঝড়ো হাওয়া।

এর জেরে লণ্ডভণ্ড হয় কলকাতাসহ দুই ২৪ পরগনা ও পূর্ব মেদিনীপুর। হাওড়া, হুগলি এবং পশ্চিম মেদিনীপুরেরও হাজার হাজার কাঁচা ঘরবাড়ি ও গাছপালা ভেঙে পড়েছে। ক্ষয়ক্ষতি আরও বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত ঝড়ে তিনজনের মৃত্যুর খবর জানায় আনন্দবাজার পত্রিকা।

হাওড়ার শালিমারে ঝড়ে উড়ে যাওয়া টিনের আঘাতে মারা গেছে ১৩ বছরের এক কিশোরী। মিনাখাঁয় মাথায় গাছ পড়ে মৃত্যু হয়েছে এক নারীর। ওদিকে, বসিরহাটে বাড়ির উঠোনে গাছ ভেঙে পড়ে মারা গেছে ২০ বছরের এক তরুণ।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বলেন, “মৃতের সংখ্যাটা এখনি বলা যাচ্ছে না। ১০-১২ জনের মৃত্যুর খবর পেয়েছি।”

রাত ৮টার পর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেও তখনও বিপদ কাটেনি বলে সতর্ক করেন তিনি।

উপকূলীয় সুন্দরবন, দিঘাসহ দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বহু এলাকা, মন্দারমণি, শংকরপুর, তাজপুর, কুলপি, পাথরপ্রতীমা, নামাখানা, বাসন্তী কুলতলি, বারুইপুর, সোনারপুর, ভাঙড়, কাকদ্বীপ মিনাখাঁ, রাজারহাট, বনগাঁ, বাগদা, হাবড়া, হিঙ্গলগঞ্জ, সন্দেশখালি, হাসনাবাদ, হাড়োয়াসহ উত্তর চব্বিশ পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুর জেলার বিস্তীর্ণ অংশ বিধ্বস্ত হয়ে গেছে।

পানির তোড়ে ভেসে গেছে সড়ক, সেতু, বাড়িঘর। ভেঙে গেছে বহু নদীর বাঁধ, নষ্ট হয়েছে চাষের জমি। আম্পানের প্রভাবে সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস বেড়েছে। ঝড়ের দাপট বিকেলের পর থেকে বেড়ে যায় বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। সকাল থেকেই ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে।

পূর্ব মেদিনীপুরের বিভিন্ন জায়গায় প্রবল বৃষ্টির সঙ্গে ঝড়ের দাপট বাড়ে। দিঘায় সকাল থেকেই সমুদ্র ছিল উত্তাল। প্রবল জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। সমুদ্রবাঁধও কিছু জায়গায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। উপকূলীয় অনেক জায়গাতেই বাঁধ ভেঙে সমুদ্রের পানি ঢুকে পড়ে।

বিভিন্ন জায়গা থেকে এখনও ক্ষয়ক্ষতির খবর আসছে। কাঁচাবাড়ি ভেঙে পড়েছে অনেক জায়গায়। কলকাতার মানুষ বহু বছর এমন ভয়াবহ ঝড় দেখেনি। শত শত গাছ ও বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে পড়ায় যোগাযোগ কার্যত বন্ধ। বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছে গোটা শহর।

তবে এত ধ্বংসযজ্ঞ ঘটিয়েও এখনই বিদায় হচ্ছে না আম্পান, বলছে আবহাওয়ার পূর্বাভাস।

কলকাতার আলিপুর আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত চলতে থাকবে এ দুর্যোগ। পূর্ব-পশ্চিম মেদিনীপুর, বর্ধমান, হুগলিতেও প্রবল বৃষ্টিপাত হবে। ঝড় বইবে ৭০-৮০ কিলোমিটার বেগে। উত্তরবঙ্গেও মালদা, উত্তর দিনাজপুরে সকাল থেকেই বৃষ্টি বাড়বে। এরপর ধীরে ধীরে কমবে ঝড়ের গতিবেগ।