৫ থেকে ১০ ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের পূর্বাভাস

অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলাগুলোসহ দেশের বেশিরভাগ এলাকায় মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে বৃষ্টি শুরু হতে পারে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা। 

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 May 2020, 08:00 AM
Updated : 19 May 2020, 11:17 AM

ঘণ্টায় ১৪০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার বেগের বাতাসের শক্তি নিয়ে আমপান যখন উপকূল অতিক্রম করবে, তখন উপকূলীয় দ্বীপ ও চরের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৫ থেকে ১০ ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে বলে সতর্ক করা হয়েছে আবহওয়ার বিশেষ বুলেটিনে।

ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সাগর বিক্ষুব্ধ থাকায় আগের মতই চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৬ নম্বর এবং মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

আবহাওয়াবিদ মো. মনোয়ার হোসেন জানান, সুপার সাইক্লোন আম্পান আরও উত্তর-উত্তর পূর্ব দিকে এগিয়ে এসে সামান্য দুর্বল হয়ে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের আকারে পশ্চিম মধ্যবঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্নএলাকায় অবস্থান করছে। 

মঙ্গলবার বেলা ৩টায় এ ঘূর্ণিঝড় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৭৮৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে; কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৭৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে; মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৭০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৬৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থান করছিল।

তখন ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৮৫ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২০০ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ২২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছিল।

বাংলাদেশের আবহাওয়া অফিস বলছে, এ ঝড় আরও উত্তর-উত্তর পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে মঙ্গলবার শেষরাত থেকে বুধবার বিকাল/সন্ধ্যার মধ্যে খুলনা ও চট্টগ্রাম উপকূলের মধ্যবর্তী অঞ্চল দিয়ে বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করতে পারে।

ভারতের আবহওয়া অফিসের পূর্বাভাস বলছে, উপকূলে পৌঁছানোর আগে সামান্য কমে আসতে পারে আম্পানের শক্তি। অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের আকারে বুধবার বিকাল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের দীঘা এবং বাংলাদেশের হাতিয়ার মাঝামাঝি এলাকা দিয়ে এ ঝড় উপকূল অতিক্রম করতে পারে।

বিপদ সংকেত

# বাংলাদেশের আবহাওয়া অফিস মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে।

উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলো ৭ নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে।

# আর চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৬ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।

উপকূলীয় জেলা নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এবং অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলো ৬ নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে।

আবহাওয়া অফিস বলছে, ২২ মে অমাবস্যা থাকায় এর প্রভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠবে জোয়ার। ঘূর্ণিঝড় ও অমাবস্যার প্রভাবে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম এবং আশপাশের দ্বীপ ও চরের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৫-১০ ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।

চট্টগ্রামের পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, বুধবার দিনের প্রথম ভাটা শুরু হবে বেলা ১১টা ৫৩ মিনিটে আর দিনের দ্বিতীয় জোয়ার শুরু হবে সন্ধ্যা ৬টা ২৩ মিনিটে। এরপরের ভাটা রাত ১২টা দুই মিনিটে শুরু হবে।

ভারতের আবহওয়া অফিসের পূর্বাভাস অনুযায়ী আম্পান বুধবার বিকালে উপকূল অতিক্রম শুরু করলে তখন ভাটার প্রভাবে জলোচ্ছ্বাস কিছুটা কম থাকবে। তবে সন্ধ্যায় জোয়ারের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাস হয়ে উঠতে পারে ভয়ঙ্কর।

বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তর বলেছে, ঘূর্ণিঝড় উপকূল অতিক্রম করার সময় সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম জেলা এবং অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরে ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে। সেই সঙ্গে ঘণ্টায় ১৪০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার বেগে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে।

এ পরিস্থিতিতে উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সকল মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলেছে আবহাওয়া অফিস। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।

সাগরে যখন ঘূর্ণিবায়ু পাক খাচ্ছে, ঢাকা, টাঙ্গাইল, মাদারীপুর, রাঙ্গামাটি, চাঁদপুর, মাইজদীকোর্ট, ফেনী, রাজশাহী, ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের দুয়েক জায়গায় তখন মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। সোমবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে যশোরে ৩৭ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

আবহাওয়াবিদ আরিফ হোসেন বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের এ সময়ে বাতাসে প্রচুর জলীয় বাষ্প থাকায় ভ্যাপসা গরমে অসহনীয় অবস্থা বিরাজ করছে সবখানে।

“সাইক্লোনের প্রভাবে মধ্যরাত থেকে উপকলীয় এলাকাসহ দেশের সর্বত্র বৃষ্টির প্রবণতা বাড়বে। এর মাধ্যমে কেটে যেতে পারে তাপপ্রবাহের রেশ। দিনের তাপমাত্রা ২-৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমতে পারে।”

সেই সুন্দরবন

২০০৭ সালে বাংলাদেশে আঘাত হেনেছিল ঘূর্ণিঝড় সিডর, তাতে তছনছ হয়েছিল বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল, প্রাণ হারিয়েছিল দুই হাজারের বেশি মানুষ।

তার এক যুগ পরে এখন যে ঘূর্ণিঝড়ের সামনে বাংলাদেশ, সেই আম্পান এখন সিডরের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।

বঙ্গোপসাগরের জানা ইতিহাসে দ্বিতীয় সুপার সাইক্লোন হিসেবে ধরা হচ্ছে আম্পানকে। প্রথম সুপার সাইক্লোনটি ছিল ১৯৯৯ সালের উড়িষ্যা সাইক্লোন।

ভারতের ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স ফোর্সের প্রধান এস এন প্রধান বলছেন, “আমরা তাই আম্পানকে মোটেই হালকাভাবে নিচ্ছি না, কারণ এ নিয়ে দ্বিতীয়বার ভারত একটি সুপার সাইক্লোনের মুখোমুখি হচ্ছে।”

ঘূর্ণিঝড়টির গতিপথ বিশ্লেষণ করে আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে উপকূলে আঘাত হানলেও এ বিস্তৃতি থাকবে বাংলাদেশের হাতিয়া পর্যন্ত।

বাংলাদেশের আবহাওয়াবিদ আব্দুল মান্নান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আড়াইশ কিলোমিটার বেগের ঝড় যখন বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করবে তখনও ১৫০-১৬০ কিলোমিটার বেগে এগোতে পারে। উপকূলে আসার পরই গতি কমে আসবে, বৃষ্টির প্রবণতাও বাড়বে।”

সিডরের উৎপত্তি যেখানে ছিল, আম্পানের উৎপত্তিও বঙ্গোপসাগরের একই এলাকায় আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের কাছে। গত ডিসেম্বরে আঘাত হানা অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের মতোই এগোচ্ছে আম্পান। গত বছরের মে মাসে আরেকটি শক্তিশালী ঝড় ফনীও একই পথে আঘাত হেনেছিল।

আবহাওয়াবিদ রহমান বলেন, “ভৌগলিক ও আবহাওয়াগত কারণে ঘূর্ণিঝড় এ অঞ্চলকে ‘চ্যানেল’ হিসেবে বেছে নিয়েছে। ঘূর্ণিঝড় রূপ নেওয়ার পর ডান দিকে মোড় নেয়। এবারও তাই হয়েছে।”

তিনি বলেন, “সুপার সাইক্লোন আম্পানের ব্যাস বেশ বড়। এ ধরনের ঝড় শেষ মুহুর্তেও সামান্য দিক পরিবর্তন করতে পারে। এটি উড়িষ্যা উপকূলয় হয়ে উত্তর দিকে সরে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ উপকূলে আসবে। এবারও সুন্দরবন অংশ পাবে।”

এক যুগ আগের সিডরের ঝড়ও গিয়েছিল সুন্দরবনের উপর দিয়ে, যা রক্ষা করেছিল উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকা। বুলবুলের ক্ষেত্রেও ঢাল হয়ে ছিল সুন্দরবন।

জয়েন্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টার আম্পানের সম্ভাব্য যে গতিপথ দেখিয়েছে, তাতে উপকূল অতিক্রম করার সময় এ ঝড়ের কেন্দ্র বা চোখ থাকতে পারে সুন্দরবনের ওপর।   

বন অধিদপ্তরের (বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চল) বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এবারের সুপারসাইক্লোনের প্রভাব সুন্দরবনেও পড়বে। আমরা ইতোমধ্যে সুন্দরবন সংশ্লিষ্ট এলাকাসহ সবাইকে নিরাপদে অবস্থান নেওয়ার জন্যে সতর্ক করে দিয়েছে। মাছজীবী ও বনজীবীদেরও নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার জন্যে বলেছি।”

মানুষের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো গেলেও বনের ক্ষয়ক্ষতি ঝড় থেকে এড়ানো সম্ভব হয়ে ওঠে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

আবহাওয়াবিদ আব্দুল মান্নান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “৯১ এর প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়ের পরে উপকূলে বনায়ন করার কর্মসূচি জোরদার করা হয়। বরাবরের মতো ঝড়ে ঢাল হিসেবে থাকে আমাদের সুন্দরবনসহ বনাঞ্চলগুলো। এক্ষেত্রে বনাঞ্চল রক্ষায় সবার ভূমিকা অব্যাহত রাখতে হবে। সেই সঙ্গে ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী কাযক্রম নেওয়ায় সংশ্লিষ্টদের পদক্ষেপও জরুরি।”

উপকলীয় বনাঞ্চল থাকলে জলোচ্ছ্বাসের প্রাথমিক ক্ষতি ও ঝড়ের তীব্র গতি কমানো বড় সহায়ক ভূমিকা পালন করে বলে মন্তব করেন তিনি।