পড়ুয়ারা বিপত্তিতে, প্রকাশকরা সঙ্কটে

পাঁচ সপ্তাহ পর ইতালি যখন লকডাউন প্রথম শিথিল করেছিল, তাতে প্রথম খুলেছিল বইয়ের দোকান; বাংলাদেশ গত দেড় মাসে লকডাউন কয়েক দফায় শিথিল করলেও তার মধ্যে বইয়ের দোকান পড়েনি।

সাজিদুল হক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 May 2020, 04:17 AM
Updated : 19 May 2020, 01:01 PM

“বর্তমান লকডাউন পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার অন্যতম উপায় হচ্ছে বই পড়া। সুতরাং এটি জরুরি বিষয়,” বলছেন অনুবাদ সাহিত্যিক জি এইচ হাবীব।

কিন্তু বাংলাদেশে এখনও বইয়ের দোকান যেমন খোলেনি, তেমনি বইয়ের অনলাইন মার্কেট প্লেসগুলোও বন্ধ। গ্রন্থাগার কিংবা পাঠাগারগুলোও বন্ধ রয়েছে। ফলে করোনাভাইরাস মহামারীকালে বই পড়ুয়াদের হা-পিত্যেস থামছে না।

ফাইল ছবি

অন্যদিকে প্রকাশকরা বলছেন, তারাও পড়েছেন বড় সঙ্কটে; আর আগামী এক বছরেও তারা এই সঙ্কট থেকে উঠতে পারবেন না, যদি না সরকার সহযোগিতার হাত বাড়ায়।

বিশ্বজুড়ে মহামারী আকার ধারণ করা করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশে দেখা দেওয়ার পর গত ২৬ মার্চ লকডাউন জারি করে সরকার। গণপরিবহন, ওষুধসহ নিত্য ও জরুরি পণ্যের দোকান ছাড়া সব বন্ধ করে দেওয়া হয়।

জরুরি সামগ্রীর তালিকায় বই না থাকায় দীর্ঘ ‘লকডাউনে’ পছন্দমতো বই না কিনতে পারায় আক্ষেপ প্রকাশ করছেন অনেকে।

বেসরকারি সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাশ, বাংলাদেশের কর্মী আমজাদ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রতিমাসে কিছু না কিছু বই কেনা হয়। গত দুই মাস প্রায় বই কেনা হয়নি। দোকান বন্ধ। আর খোলা থাকলেও যেতাম কিনা সেটাও একটা প্রশ্ন।

“তবে এরকম আপদকালীন সময়ে অনলাইনে বই কেনাকাটার সুযোগ থাকলে আমার মতো পাঠকদের সুবিধা।”

চলচ্চিত্র নির্মাতা সাকী ফারজানা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একটি অনলাইন থেকে নিয়মিত বই কিনতাম। তারা ডেলিভারি সার্ভিস বন্ধ রেখেছে। দীর্ঘ সময় ঘরে আছি। কিন্তু নতুন কোন বই-ই কিনতে পারিনি।”

সাবেক সাংবাদিক শেখ মোহাম্মদ সালেহ রাব্বী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “করোনাকালে সবচেয়ে বিপদে আছেন পড়ুয়াদের সেই অংশটি যারা এখনও ইলেট্রনিক ডিভাইসে স্বচ্ছন্দ নন।

“লকডাউনের প্রস্তুতি হিসেবে আমি নিজে কিছু বই কিনেছিলাম পড়ব বলে। যদিও টানা প্রায় দু' মাস সাধারণ ছুটি চলবে ভাবিনি। কিন্ডল থাকায় আমি করোনাভাইরাস সংক্রমণের সময়ে বোকাচ্চিওর ডেকামেরন পড়ছি, কয়েকজন মিলে অনুবাদ করছি। কিন্তু বই পাওয়া যাচ্ছেনা বা বই জরুরি সামগ্রী না- এটা মেনে নেওয়া আসলে আমার জন্য কঠিন।”

প্রকাশনী সংস্থা এবং বইয়ের দোকান বাতিঘরের কর্ণধার দীপংকর দাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, লকডাউন শিথিলে পর ১০ মে দোকার খোলার সুযোগ দিলে তারা বিক্রয় কেন্দ্র খোলার একটি পরিকল্পনা নিয়েছিলেন, কিন্তু লোকবলের অভাবে খুলতে পারেননি।

তিনি বলেন, “বইয়ের সব ধরনের বিপণন এখন বন্ধ। অনলাইন বা দোকান যাই বলি না কেন। সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটি চলাকালে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি মানুষ আমাদের জিজ্ঞেস করা শুরু করেছে।

“সরকার ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান চালু করার পর কিছু মানুষ দোকানে এসেছে। কুরিয়ার সার্ভিস চালু না হওয়ায় অনলাইনে যারা ব্যবসা করে তারা ডেলিভারি দিতেই পারছে না।”

সঙ্কট তুলে ধরে দীপংকর বলেন, “সৃজনশীল বইয়ের যারা ব্যবসা করে তাদের মধ্যে ৫ শতাংশের অবস্থা ভালো। যারা টিকে থাকতে পারবে। বাকিদের অবস্থা ভালো না। দাঁড়াতেই পারবে বলে মনে হয় না।”

জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি ফরিদ আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “লকডাউনের মধ্যে যেসব ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বা ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাদের মধ্যে সৃজনশীল প্রকাশনার ক্ষতির পরমিাণ বেশি। এ কারণে যে, লকডাউন যখন তুলে নেওয়া হবে বা গত সপ্তাহ থেকে যে সীমিত আকারে ব্যবসা পরিচালনা অনুমতি দেওয়া হয়েছে সেখানেও সৃজনশীল বইয়ের ব্যবসা চালু হচ্ছে না।”

তিনি বলেন, “সকল ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পরেও বইয়ের বিক্রিটা চালু হতে সময় লাগবে। বই সৃজনশীলতা গঠনের জন্য বা অনেকে বিনোদন হিসেবে দেখে। খুব প্রয়োজনীয় একটি উপকরণ হিসেবে বইকে গ্রহণ করতে আমরা অনেকেই প্রস্তুত নই। যা্র ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের যে বেহাল অবস্থা সেটা ফিরে আসতে সময় লাগবে। এমন হতেও পারে আগামী ফ্রেব্রুয়ারিতে বই মেলার আগে এই ব্যবসা আর ঘুরে দাঁড়াতেই পারবে না।”

সময় প্রকাশনের স্বত্ত্বাধিকারী ফরিদ প্রকাশকদের টিকে থাকার জন্য বই কেনায় সরকারি বাজেট বাড়ানোর দাবি জানান।

“আমরা প্রধানমন্ত্রী, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে আবেদন জানিয়েছি। আমরা সাহায্য চাই না, সহযোগিতা চাই। আমরা অনুদান নয়, প্রণোদনা চাই। সরকারের বিভিন্ন খাত নিয়মিতভাবে বই কেনে। তাদের বাজেট কম। এই আপদকালীন সময়ে বই কেনার বাজেট বাড়িয়ে দেওয়ার আবেদন করা হয়েছে।”

এই প্রকাশক দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পাঠাগারগুলো খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়ে বলেন, “পাঠাগারে বসার ব্যবস্থা না করে বই ধার দেওয়ার বিষয়টি চালু করা যায়। এটা আগে ছিলো। এই প্রথাটা এই সময়ে অন্তত এক বছরের জন্য জরুরিভিত্তিতে চালু করা প্রয়োজন।”

অনুবাদ সাহিত্যিক জিএইচ হাবীব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পাঠকে বই পাওয়াটা নিশ্চিত করা জরুরি।

“বইপত্র যাতে সহজে পাঠকের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে পারে সেজন্য বিদ্যমান সরকারি ডাকঘর এবং কুরিয়ার সার্ভিসগুলোর সাহায্য নিয়ে প্রকাশক এবং পুস্তক বিপণিগুলো আলাদাভাবে বা যৌথভাবে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন।

“সেইসঙ্গে, সামনের দিনগুলিতে মহামারীজনিত দীর্ঘকালব্যাপী অচলাবস্থার কথা বিবেচনা করে প্রকাশকরা নিরাপদ ই-বুক প্রকাশের দিকেও নজর দিতে পারেন।”

এই সঙ্কটে প্রকাশকদের পাশে দাঁড়াতেও সরকারের প্রতি আহ্বান জানান লেখক জি এইচ হাবীব।

“বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের প্রণোদনার আওতায় প্রকাশনাকে অন্তর্ভুক্ত করা এবং তার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করছি।