সুপার সাইক্লোন আম্পান আসছে বিপদ সংকেত নিয়ে

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ‘সুপার সাইক্লোন’ আম্পান বাংলাদেশ উপকূলের হাজার কিলোমিটারের মধ্যে চলে আসার পর সমুদ্র বন্দরগুলোকে বিপদ সংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।  

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 May 2020, 10:33 AM
Updated : 18 May 2020, 05:41 PM

আবহওয়ার বিশেষ বুলেটিনে মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৭ নম্বর এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্র বন্দরকে ৬ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।

বাংলাদেশের ঘূর্ণিঝড় সংকেত ব্যবস্থায় ৫ থেকে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত একই মাত্রার ঝুঁকি বোঝায়। বন্দরকে ডান দিকে রেখে ঝড় গেলে ৬ এবং বন্দরের ওপর বা আশপাশ দিয়ে গেলে ৭ নম্বর সংকেত দেখাতে বলা হয়। দুই ক্ষেত্রেই নিশানে দুটি লাল রঙের সংকেত পতাকা দেখানো হয়।

ভারতের আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, আম্পান সোমবার বিকালে পরিণত হয়েছে ‘সুপার সাইক্লোনে’, যার বাতাসের শক্তি ঘণ্টায় প্রায় ২৫৫ কিলোমিটার।

তবে বুধবার দিনের দ্বিতীয়ার্ধে উপকূলে আঘাত হানার সময় এর শক্তি কিছুটা কমে আসবে বলে ভারতীয় আবহাওয়াবিদরা মনে করছেন। 

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান সোমবার সচিবালয় থেকে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বলেন, দেশের উপকূলীয় জেলাগুলোতে ১২ হাজার ৭৮টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যার আগেই ঝুঁকিপূর্ণ ও নিচু এলাকার বাসিন্দাদের আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়া হবে।

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট একটি গভীর নিম্নচাপ শনিবার রাতে ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নিলে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার সাইক্লোন সংক্রান্ত আঞ্চলিক সংস্থা এসকাপের নির্ধারিত তালিকা থেকে এর নাম দেওয়া হয় ‘আম্পান’। এটি থাইল্যান্ডের দেওয়া নাম।

রোববার রাতে সেটি ‘অতি প্রবল’ ঘূর্ণিঝড়ের রূপ পায় এবং ঘণ্টায় ১৩ কিলোমিটার বেগে পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশ উপকূলের দিকে ধেয়ে আসতে শুরু করে। সোমবার বিকালে তা সুপার সাইক্লোনে পরিণত হয়।

বাংলাদেশের আবহাওয়া অফিস বলছে, এ ঝড় আরও শক্তি সঞ্চয় করে উত্তর দিকে এগিয়ে এসেছে এবং পশ্চিম মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন দক্ষিণ বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থান করছে।

সোমবার রাত ৯টায় এ ঘূর্ণিঝড় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ১০২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে; কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৯৬০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে; মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৯২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৯১০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থান করছিল।

ওই সময় ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৯০ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২৫ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ২৪৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছিল।

আবহাওয়ার বিশেষ বুলেটিনে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় আম্পান আরও ঘণীভূত হয়ে উত্তর দিকে অগ্রসর হতে পারে এবং পরে দিক পরিবর্তন করে উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে এগিয়ে খুলনা ও চট্টগ্রামের মধ্যবর্তী অঞ্চল দিয়ে মঙ্গলবার শেষরাত থেকে বুধবার সন্ধ্যার মধ্যে বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করতে পারে।

ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের কাছে সাগর খুবই বিক্ষুব্ধ থাকায় মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।

উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলো ৭ নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে।

আর চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৬ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। উপকূলীয় জেলা নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং অদূরবর্তী দ্বীপ ও চর ৬ নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে।

২২ মে অমাবস্যা থাকায় এর প্রভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠবে জোয়ার। ঘূর্ণিঝড় ও অমাবস্যার প্রভাবে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম এবং আশপাশের দ্বীপ ও চরের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৪ থেকে ৫ ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।

আবহাওয়া অফিস বলছে, ঘূর্ণিঝড় উপকূল অতিক্রম করার সময় সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম জেলা এবং অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরে ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে। সেই সঙ্গে ঘণ্টায় ১৪০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার বেগে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে।

উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সকল মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলেছে আবহাওয়া অফিস। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।

আবার সুন্দরবন?

ভারতের আবহাওয়া অফিস বলছে, ঘূর্ণিঝড় আম্পান আরও শক্তিশালী হয়ে সোমবার বিকেলে সুপার সাইক্লোনে পরিণত হয়। তখন এর বাতাসের গতি ঘণ্টায় ২৫৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছিল। রাতে তা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে, তখন বাতাসের গতি ঘণ্টায় ২৬৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়বে।

তবে উপকূলে পৌঁছানোর আগে সামান্য কমে আসতে পারে এর শক্তি। অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের আকারে বুধবার বিকাল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের দীঘা এবং বাংলাদেশের হাতিয়ার মাঝামাঝি এলাকা দিয়ে আম্পান উপকূল অতিক্রম করতে পারে।

সে সময় বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১৫৫ থেকে ১৬৫ কিলোমিটার হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে ভারতের আবহাওয়া বিভাগ।

জয়েন্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টার আম্পানের সম্ভাব্য যে গতিপথ দেখিয়েছে, তাতে উপকূল অতিক্রম করার সময় এ ঝড়ের কেন্দ্র বা চোখ থাকতে পারে সুন্দরবনের ওপর।    

সাম্প্রতিক অতীতে ২০০৯ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় আইলা এবং ২০০৭ সালের নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড় সিডরও স্থলভাগে উঠে এসেছিল সুন্দরবন উপকূল দিয়ে।

এর মধ্যে আইলায় বাতাসের গতি ছিল ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১২০ কিলোমিটার। আর সিডরের শক্তি ছিল তার দ্বিগুণেরও বেশি, ঘণ্টায় ২৬০ কিলোমিটার।

সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় বুলবুল গতবছর নভেম্বরে ঘণ্টায় ১১৫ কিলোমিটার থেকে ১২৫ কিলোমিটার বেগের বাতাসের শক্তি নিয়ে একই দিক দিয়ে উপকূলে আঘাত হানে। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলকে অনেকটাই রুখে দেয় সুন্দরবন।

আবহাওয়া ও জলবায়ু গবেষক ড. মোহন কুমার দাশ জানান, এপ্রিল ও মে মাসে ঘূর্ণিঝড়ের মৌসুমে ভারত মহাসাগরে যেসব ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয়েছে, তার আগে অনেকগুলোই বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার উপকূলে আঘাত হেনেছে।

এর মধ্যে এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড় ছিল মালা (২০০৬), নার্গিস (২০০৭), বিজলি (২০০৯), মারুথা (২০১৭) ও ফণী  (২০১৯)। আর মে মাসের ঘূর্ণিঝড় ছিল আকাশ (২০০৭), আইলা (২০০৯), লায়লা (২০১০), ভিয়ারু (২০১৩), রোয়ানু (২০১৬), মোরা (২০১৭)।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশের দুর্যোগ মোকাবেলার সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমেছে।

বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের এ সিনিয়র গবেষক বলেন, “করোনাভাইরাস মহামারীর এ সময়ে ‘শূন্য ক্যাজুয়ালিটি’ পলিসি নির্ধারণ করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম নিতে হবে। সাধারণ জনগণ যেন সতর্কতা বোঝে, মানে ও স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে সচেতন থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে।”