‘হ্যালো লারনেড স্যামসাং’

ভার্চুয়াল শুনানিতে এসেছেন একজন আইনজীবী তার স্মার্টফোন নিয়ে; কিন্তু ভিডিওতে যখন যুক্ত হয়েছেন তখন বিচারককে বলতে হল- ‘হ্যালো লারনেড স্যামসাং’। কারণ আইনজীবী তার নাম যুক্ত না করায় ডিভাইসের নামে তাকে সম্বোধন করতে হল বিচারককে।

প্রকাশ বিশ্বাসপ্রকাশ বিশ্বাস আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 May 2020, 02:59 AM
Updated : 30 May 2020, 11:03 AM

আরেক আইনজীবী আবার স্মার্টফোনের অডিও চালু না করেই শুনানিতে যোগ দেওয়ার পর বিচারক তাকে শুনতে পাচ্ছিলেন না।

আবার জামিন শুনানি শেষ হয়েছে, কিন্তু আইনজীবীর খবর নেই; কেননা তিনি অনলাইন হয়েছিলেন কোনো দোকানে বসে কিংবা অন্য কারও স্মার্টফোনে। ফলে আবেদন করে উঠে যাওয়ায় তাকে পাওয়া যাচ্ছে না খুঁজে।

এ সব সমস্যায় বিরক্ত হচ্ছেন বিচারকরা। তারা বলছেন, হাতে লেখা জামিন আবেদনও স্ক্যান করে জমা দিচ্ছেন আইনজীবীরা। যেগুলো ডাউনলোড করার পর ঝাপসা অক্ষরগুলো বোঝা যাচ্ছে না। আবার ইন্টারনেটের ধীর গতিও ফেলছে ঝক্কিতে।

উচ্চ আদালতের মতোই দেশের নিম্ন আদালতগুলোতে ভার্চুয়াল শুনানি শুরু হওয়ার পর ঢাকার আদালতে গত কয়েক দিনে এমন বিচিত্র ঘটনা দেখা যাচ্ছে হরহামেশা।

এই পরিস্থিতিতে আদালতে পুলিশের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তাদের ঠিকই নথি নিয়ে দৌড়াতে হচ্ছে বিচারকের কাছে। ফলে যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই পদ্ধতি প্রবর্তন হল, তাই ব্যাহত হচ্ছে।

পরিকল্পনা থাকলেও করোনাভাইরাস সঙ্কটে অনেকটা অপ্রস্তুত অবস্থায় বাংলাদেশের আদালতে শুরু হয়েছে ভার্চুয়াল শুনানি; যাতে সমস্যায় পড়েছেন আইনজীবীরা।

কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে দীর্ঘ সাধারণ ছুটির মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে আদালতের বিচারকাজ চালানোর অধ্যাদেশ জারির পর গত রোববার ‘প্র্যাকটিস ডাইরেকশন’ দেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। তার ভিত্তিতে শুরু হয় নতুন ধরনের আদালত কার্যক্রম।

ছোঁযাচে রোগের সংক্রমণ এড়াতে আদালত বন্ধের এই সময়ে নিম্ন আদালতে শুধু জামিন আবদনের ভার্চুয়াল শুনানি হচ্ছে। কিন্তু অনভ্যস্ততার কারণে ইতোমধ্যে বিভিন্ন জেলায় আইনজীবীরা তা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন।

ঢাকার আদালতে তা নানা বিপত্তির মধ্য দিয়েই চলছে।

একজন আইনজীবীকে যেভাবে শুনানিতে অংশ নিতে হয়

ভার্চুয়াল আদালতের কার্যক্রমে অংশ নিতে একজন আইনজীবীকে আদালতের নির্ধারিত ওয়েবসাইটে (mycourt.judiciary.org.bd) নিবন্ধন করতে হয়। নিবন্ধনে জন্য দুটি জিনিস প্রয়োজন। প্রথমত, একটি মোবাইল ফোন নম্বর এবং দ্বিতীয়ত একটি ইমেইল ঠিকানা।

মোবাইল কিংবা ল্যাপটপের সাহায্যে এই ওয়েবসাইটে ঢুকে একজন আইনজীবী প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে নিবন্ধন করবেন। সঙ্গে সঙ্গে আইনজীবীর দেওয়া মোবাইল ফোন নম্বরে একটি এসএমএস যাবে। এসএমএম পাওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আবার ওয়েবসাইটে ঢুকে নিজের পাসওয়ার্ড তৈরি করতে হবে।

এরপর তিনি লগইন করে ওয়েবসাইটে ঢুকে জামিনের আবেদনসহ সব প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারবেন। জামিনের আবেদন বাটনে চেপে নির্ধারিত ফরম পূরণ করত হয়। ওই আবেদনপত্রে ওকালতনামাসহ অন্যান্য নথি সংযুক্ত করা যায়।

সব তথ্য ও কাগজপত্র সংযুক্ত করার পর ‘আবেদন করুন’ অপশনে ক্লিক করলে জামিনের আবেদনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। তখন একটা ট্র্যাকিং নম্বর দেওয়া হবে। পরবর্তী সময়ে আবেদনের অবস্থা জানতে হলে ওই নম্বরটি দিয়ে সার্চ দেওয়া যাবে।

ভার্চুয়াল শুনানিতে অংশ নেওয়ার জন্য একটি কম্পিউটার কিংবা একটি স্মার্টফোন থাকলেই চলবে। যে কোনো ভিডিও চ্যাটিং অ্যাপ ব্যবহার করে ভার্চ্যুয়াল শুনানিতে অংশ নেওয়া যায়।

 

ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতের একজন বিচারক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের কাছে আজ যে সব আবেদন জমা পড়েছে, তার মধ্যেও অনেকেরই নানা তথ্য ঠিক ছিল না। আমরা বিপদে পড়ছি এদের নিয়ে।”

ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের ব্যক্তিগত সহকারী জহিরুল কাইয়ুম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আনকোরা এ বিষয়টি নিয়ে সবার বেশ পরিমাণ বেগ পেতে হচ্ছে। তবে কেবল শুরু তো, আস্তে আস্তে অভ্যাস হযে যাবে।”

ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে মহানগরীর বিভিন্ন মামলার রাষ্ট্রপক্ষে নথি তত্বাবধান, প্রতিবেদন তৈরি, বিচারকদের কাছে নথিপত্র উপস্থাপন, অভিযোপত্র গ্রহণসহ অনেক রকমের বিচার পূর্ব শুনানির দায়িত্ব পালন করে থাকে পুলিশের অপরাধ, তথ্য ও প্রসিকিউশন বিভাগ।

এই বিভাগের উপ-কমিশনার মো. জাফর হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখনও ফুল ই্কুইপমেন্ট নিয়ে ফুল সুয়িংয়ে কাজ শুরু হয়নি। অনেক আইনজীবী সফটওয়্যার পূরণ করতে পারছেন না। ফলে জামিন শুনানিতে অসুবিধার সৃষ্টি হচ্ছে।”

তিনি বলেন, “আমাদের ওয়েবক্যামওয়ালা ডিভাইস যেমন ল্যাপটপ বা কম্পি্উটারে এক্সট্রা ওয়েবক্যাম নেই। শুধু ব্যক্তিগত স্মার্ট ফোনে কাজ করা তো সমস্যা।

“আমাদের জামিন আবেদনের লিঙ্ক যদি আবেদন জমার সঙ্গে সঙ্গে পাঠানো হয়, তবে   শুনানির জন্য প্রস্তুতি, বিচারকদের ডাইরেকটিভ আদেশ অংশের আগের অংশ নথিতে লেখা বা তোলা সম্ভব হত। সেটি করা হচ্ছে না। ফলে আমাদের পুলিশের সাধারণ নিবন্ধন কমর্কর্তাদের (জিআরও) অতিরিক্ত লোড নিতে হচ্ছে।”

প্রশিক্ষণের গুরুত্ব তুলে ধরে পুলিশ উপ-কমিশনার জাফর বলেন, “আমাদের একদম প্রাথমিক কিছু প্রশিক্ষণ নেওয়া আছে, কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়।”

বিষয়টি নিয়ে কথা বললে বেশ কয়েকজন আইনজীবী অসন্তোষ জানিয়ে বলেন, প্রশিক্ষণ ছাড়াই এই ধরনের কার্যক্রমের শুরু হওয়ায় জটিলতা পোহাতে হচ্ছে তাদের।

ঢাকা আইনজীবী সমিতির কার্যনিবাহী পরিষদের অফিস সেক্রেটারি এইচ এম মাসুম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকারি আইনজীবী ছাড়া অন্য আইনজীবীদের তো কোনো প্রশিক্ষণ নেই। পাইলট প্রজেক্ট হিসাবে একটা জেলার অথবা যে কোনো একটা মহানগরীর আদালতকে সিলেক্ট করে প্রথমে কাজ শুরু করা উচিৎ ছিল। প্রথমেই সবগুলো জেলা ও মহানগরীতে শুরু করে দেওয়া ঠিক হয়নি।”

কাজ শুরুর পর সমস্যার দিক তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমাদের (সমিতি) কাছে অনেক আইনজীবী এসে বলছেন যে তারা আবেদন করেছেন, কিন্তু কোনো রিপ্লাই পাচ্ছেন না।

“অনলাইনে দরখাস্ত জমা পড়ার পর অটো রিসিভ মেইল রিপ্লাই হলে সাধারণ আইনজীবীরা উপকৃত হবে।”

আইনজীবীদের নানা সমস্যার কথা জানাতে বৃহস্পতিবার ঢাকার মহানগর দায়রা জজের সঙ্গে সমিতির নেতারা দেখা করেছেন বলেও জানান মাসুম।

আরেক আইনজীবী সিরাজুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি গত ১২ মে মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে মাদক মামলায় একটি জামিন আবেদন সঠিক নিয়মে অনলাইনে শুনানির জন্য জমা দিয়েছি। কিন্তু এখনও তারিখ পাইনি।”

তিনি বলেন, “এসবের চাইতে বরং সপ্তাহে দুই দিন প্রধান কয়েকটি আদালত জরুরি শুনানি নেওয়ার জন্য খোলা গেলে বিচার প্রার্থীদের উপকার হবে।”

তার মতোই আরও কয়েক আইনজীবী বলেন, বিচারক, আইনজীবী, বিভিন্ন স্তরের আদালত কর্মচারী, ভেন্ডারকে তো আদালত পাড়ায় আসতেই হচ্ছে। তাহলে প্রচলিতভাবে শুনানিতে আর কী সমস্যা।

ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হোসেন আলী খান হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তিনি বেশ কয়েকটি মামলায় এদিন আসামির জামিন চেয়ে পক্ষে আদেশও পেয়েছেন।

ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি আবদুল্লাহ আবু বিডনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কাজ সবে মাত্র শুরু হয়েছে, সঙ্কট তো থাকবেই, সমাধানও খুঁজে বের করতে হবে।”

আইনজীবীরাও ধীরে ধীরে একে অভ্যস্ত হয়ে যাবেন বলে মনে করেন জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী।

তবে তিনি স্বীকার করেন, ভার্চুয়াল শুনানিতে তিনি এখনও অংশ নেননি। এসব শুনানিতে জামিনের বিরোধিতা করার জন্য রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটররা থাকছেন।

ঢাকার আদালতের জ্যেষ্ঠ একজন বিচারক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভারতে ই-জুডিশিয়ারি শুরু হয়েছে ২০০৩-০৪ এর দিকে, কিন্তু এখনও তারা কাজ শেষ করতে পারেনি। আমাদের এখানে তো সূচনা হল মাত্র। এই সমস্যা কেটে যাবে।”

দীর্ঘ সময় আদালত বন্ধ থাকায় রুটি-রুজির প্রশ্নে অনেক আইনজীবী যেমন ভার্চুয়াল শুনানিকে স্বাগত জানিয়েছেন, তেমনি নানা সীমাবদ্ধতা নিয়ে একে মন্দের ভালো বলছেন কয়েকজন বিচারক।

একজন বিচারক বলেন, “এটাকে আসলে ভারর্চুয়াল আদালত বললে ভুল বলা হবে। এটি আসলে অনলাইন শুনানির একটি প্রক্রিয়া চালু হল মাত্র। ভার্চুয়াল শব্দটির ব্যঞ্জনা ও আর   পরিসর অনেক ব্যাপক। 

“যখন এজাহার, মামলার রাষ্ট্রপক্ষে পুলিশের আবেদন, আদালতে পাঠানো প্রতিবেদন সবই অনলাইনে পাওয়া যাবে, অনলাইনে অর্ডার শিট তৈরি করা যাবে, তখন ভার্চুয়াল বলা যায়। সেটা করতে গেলে টোটাল সিস্টেমে পরিবর্তন করতে হবে।”

একজন মহানগর হাকিম বর্তমান পদ্ধতিতে ভিডিও চ্যাটিং অ্যাপের মাধ্যমে শুনানিতে হ্যাকারদের হানার আশঙ্কার কথাও জানান।