কোভিড-১৯: প্লাজমা থেরাপির পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হচ্ছে দেশে

বিশ্বকে স্থবির করে দেওয়া কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপির কার্যকারিতা পরীক্ষা শুরু হচ্ছে বাংলাদেশে।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 May 2020, 10:52 AM
Updated : 14 May 2020, 11:05 AM

সেজন্য সব প্রস্তুতি ইতোমধ্যে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের হেমাটোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. এম এ খান।

বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমাদের হাত যে পরিমাণ কিট আছে তা দিয়ে শনিবার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু করতে পারব। সেজন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নীতিগত অনুমোদন নেওয়া হয়েছে।”

নতুন করোনাভাইরাস বৈশ্বিক মহামারী আকার ধারণ করায় লাখ লাখ রোগী সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে উন্নত দেশগুলোও। এই অবস্থায় নতুন এই রোগে আক্রান্তদের সারিয়ে তুলতে সেরে ওঠা ব্যক্তিদের রক্তের প্লাজমা অসুস্থদের দেওয়ার চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ নানা দেশ।

রক্তের তরল, হালকা হলুদাভ অংশকে প্লাজমা বা রক্তরস বলে। তিন ধরনের কণিকা ছাড়া রক্তের বাকি অংশই রক্তরস। মেরুদণ্ডী প্রাণীর শরীরের রক্তের প্রায় ৫৫ শতাংশই রক্তরস।

চিকিৎসকরা বলছেন, কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা এ ভাইরাস মোকাবেলা করে টিকে থাকতে অ্যান্টিবডি তৈরি করে। এই অ্যান্টিবডি করোনাভাইরাসকে আক্রমণ করে। সময়ের সাথে সাথে আক্রান্ত ব্যক্তির প্লাজমায় প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। ওই অ্যান্টিবডিই অসুস্থদের সারিয়ে তোলার জন্য ব্যবহার হবে।

অধ্যাপক খান বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যে কোভিড-১৯ রোগীরা আছেন তাদের ওপরই আপাতত এ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হবে। এছাড়া ঢাকার আরও দুয়েকটা হাসপাতালে রোগীদের ওপর প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগ করার পরিকল্পনা রয়েছে।

“সবচেয়ে বড় সেন্টার হবে আমাদের এখানে। এছাড়া কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে। আমাদের ক্রাইটেরিয়া মত রোগী পাওয়া গেলে তাদের ওখানেও করতে পারি। কিছু ডোনার আমাদের হাতে আছে। যারা ইতিমধ্যে কোভিড-১৯ থেকে সেরে উঠেছেন তাদের আহ্বান জানাচ্ছি তারা যেন প্লাজমা দিতে এগিয়ে আসেন।”

ডা. এম এ খান জানান, দাতার শরীর থেকে প্লাজমা সংগ্রহের জন্য একটি বিশেষ কিট প্রয়োজন হয়। এ ধরনের প্রতিটি কিটের দাম ১২ হাজার টাকা। প্লাজমাদাতার রক্তে অ্যান্টিবডির পরিমাণ জানতে যে পরীক্ষা করতে হয় সেজন্য স্পেন থেকে চারটি কিট আনার আদেশ দিয়েছেন তারা। প্রতিটি কিটের দাম পড়বে দেড় লাখ টাকা করে। একটি কিটে ৯০টি নমুনা পরীক্ষা করা যায়।

আপাতত ঢাকা মেডিকেলের নিজস্ব খরচে পরীক্ষামূলক পর্যায় শুরু করা হলেও বড় আকারে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করতে গেলে সরকারের সহায়তা লাগবে বলে জানান এ চিকিৎসক।

তিনি বলেন, “প্লাজমা সংগ্রহের কিট আমাদের হাতে অল্প কয়েকটা আছে। আমরা চাইলেই ডোনারের কাছ থেকে কিটের খরচ নিতে পারি না। আর রোগীরাও এই খরচ দেবে না। এজন্য সরকারকে এগুলো সরবরাহ করতে হবে।”

পরীক্ষামূলক প্রয়োগ বলে রোগীকে প্লাজমা থেরাপি দেওয়ার পর আরও কিছু পরীক্ষা করাতে হয়। কিছু পরীক্ষা ঢাকা মেডিকেলে হয়, কিছু পরীক্ষা বাইরে করাতে হবে।

করোনাভাইরাসের রোগীদের চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপির প্রয়োগ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে। ছবি: রয়টার্স

সেজন্যও আলাদা খরচ আছে জানিয়ে অধ্যাপক খান বলেন, “সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এখন পর্যন্ত কোনো নিশ্চয়তা দেয়নি। তারা এখনও নিশ্চুপ। তারা বলেছে মন্ত্রণালয়ে ফাইল পাঠিয়েছে। আমি যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি।”

বাংলাদেশে প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগ করে কোভিড-১৯ রোগীর চিকিৎসা করার সম্ভাব্যতা দেখতে এপ্রিলের শুরুতে আগ্রহের কথা জানান ঢাকা মেডিকেল কলেজের হেমাটোলজির অধ্যাপক ডা. এম এ খান। ১৯ এপ্রিল তাকে সভাপতি করে ৪ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। 

ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মাজহারুল হক তপন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সী ওই কমিটিতে সদস্য হিসেবে আছেন।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের রোগী দিন দিনই বাড়ছে। বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ১৮ হাজার ৮৬৩ জন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছে, মারা গেছে ২৮৩ জন। রোগী বাড়তে থাকায় চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে চিকিৎসকদের।

এক্ষেত্রে প্লাজমা থেরাপি কতটা কাজে আসবে জানতে চাইলে অধ্যাপক খান বলেন, এ বিষয়ে এখনও তারা শতভাগ নিশ্চিত নন।

“করোনাভাইরাসের জন্য এখন পর্যন্ত কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। আর প্লাজমা থেরাপির যেহেতু কোনো ক্ষতি নেই, সে কারণে এর পরীক্ষা চালাতে কোনো সমস্যা নেই। বিভিন্ন স্টাডিতে দেখা গেছে, ৪০ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত এটা কার্যকর হয়েছে।”

ডা. এম খান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যে প্রতিবেদন দিয়েছিলেন, সেখানে বলা হয়, কোভিড-১৯ থেকে সুস্থ হওয়া ব্যক্তির রক্তের প্লাজমা সংগ্রহ করে ফ্রিজিং করতে হবে। কোভিড-১৯ আক্রান্তদের মধ্যে যাদের অবস্থা খারাপের দিকে, তাদের শরীরে এই প্লাজমা প্রয়োগ করা হবে।

“কোভিড-১৯ হওয়ার পর জ্বর, কাশি ও গলাব্যথা শুরু হয়। ভাইরাসের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং ফুসফুস আক্রমণ করে। এই প্রদাহকালীন নানা ধরনের সাইটোকাইন এবং ক্যামোকাইন বেশি পরিমাণে নিঃসৃত হয়ে ফুসফুস জ্বালা করে। যন্ত্রণা তাৎক্ষণিকভাবে লাঘব করতে পারে প্লাজমা।”

প্লাজমা থেরাপির জন্য তহবিল যোগাড়ের অগ্রগতি জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আমিনুল হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব তারা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন। এ কাজের জন্য ফান্ড কীভাবে আসবে এটা এখনও ঠিক হয়নি। তবে কাজটা হবে।”