২৭৭ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে পাঠানো হল ভাসানচরে

বঙ্গোপসাগরে কয়েক সপ্তাহ ধরে নৌকায় ভাসতে থাকা আরও ২৭৭ জন রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে ভাসানচরে কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়েছে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকও নোয়াখালী প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 May 2020, 11:22 AM
Updated : 8 May 2020, 02:50 PM

এই রোহিঙ্গাদের মধ্যে ১৮০ জন নারী এবং ৯৭ জন পুরুষ ও শিশু রয়েছে বলে নোয়াখালীর পুলিশ সুপার (এসপি) মো. আলমগীর হোসেন জানিয়েছেন।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মাহবুব আলম তালুকদার শুক্রবার দুপুরে ২৮০ জন রোহিঙ্গাকে উদ্ধারের কথা জানিয়েছিলেন।

পরে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নৌবাহিনীর সদস্যরা নৌকা থেকে রোহিঙ্গাদের উদ্ধার করে ২৮০ জনের কথা বলেছিল। তাদের তত্ত্বাবধানেই গত রাতে এই রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন গুণে দেখেছে উদ্ধারকৃত রোহিঙ্গা মোট ২৭৭ জন।”

সাগরে ভাসতে থাকা রোহিঙ্গা বা সমুদ্রে এ ধরনের যাদের পাওয়া যাবে তাদের ভাসানচরে পাঠানো হবে বলে জানান তিনি।

ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের ব্যবস্থাপনায় পুলিশ পরিদর্শক, সহকারী পুলিশ পরিদর্শক ও কনস্টেবল মিলিয়ে ৪৯ জন পুলিশ সদস্যকে মোতায়েন করা হয়েছে বলে এসপি আলমগীর হোসেন জানিয়েছেন।

নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক (ডিসি) তন্ময় দাস জানান, রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর ভাসানচর রোহিঙ্গা পুনর্বাসন ক্যাম্প স্বপ্নপুরীতে রাখা হয়েছে।

কোস্ট গার্ড ও নৌবাহিনীর কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বুধবার গভীর রাতে বাংলাদেশের জলসীমায় রোহিঙ্গাদের বহনকারী ওই কাঠের নৌকাটি ভাসতে দেখা যায়।

এরপর নৌকাটিকে বৃহস্পতিবার নিয়ে যাওয়া হয় নোয়াখালীর ভাসানচরে, যেখানে এর আগে আরও ২৮ রোহিঙ্গাকে পাঠানো হয়েছিল গত ৪ মে।

নৌবাহিনীর একজন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে রয়টার্স জানিয়েছে, এই রোহিঙ্গারা অভুক্ত ছিলেন এবং তারা তাদের খাবার ও পানি দিয়েছেন।

“এখন পরিকল্পনা তাদের ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টিনে রাখা। পরে সরকার তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।”

কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির ও তার বাইরে অবস্থান নিয়ে থাকা প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে নিয়ে নানা সামাজিক সমস্যা সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে তাদের একটি অংশকে হাতিয়ার কাছে মেঘনা মোহনার বিরান দ্বীপ ভাসান চরে স্থানান্তরের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।

এ লক্ষ্যে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে ২৩১২ কোটি টাকা ব্যয়ে মোটামুটি ১০ হাজার একর আয়তনের ওই চরে এক লাখের বেশি মানুষের বসবাসের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

সরকার বলছে, রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্য সব ব্যবস্থাই ভাসান চরে গড়ে তোলা হচ্ছে। সেখানে গেলে কক্সবাজারের ঘনবসতিপূর্ণ ক্যাম্প জীবনের চেয়ে ভালো থাকবে তারা।

তবে সাগরের ভেতরে জনমানবহীন ওই চরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের পরিকল্পনা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার মধ্যে।

এখন করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে সাগরে নৌযান থেকে উদ্ধার রোহিঙ্গাদের কোয়ারেন্টিনের জন্য ওই স্থাপনা ব্যবহৃত হচ্ছে। কক্সবাজারে শরণার্থী শিবিরে জনাকীর্ণ পরিসরে থাকা রোহিঙ্গাদের মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঘটলে তা ভয়ানক হয়ে ওঠার ঝুঁকি রয়েছে।

গত সপ্তাহে সাগরে একটি নৌযানে ভাসতে থাকা ২৮ রোহিঙ্গা ও এক বাংলাদেশি ‘দালালকে’ উদ্ধার করে ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই চরে এখন বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্কও রয়েছে।

ফাইল ছবি

বাংলাদেশের জলসীমায় রোহিঙ্গাবাহী আরও কোনো নৌযান আছে কি না, সে বিষয়ে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড নজর রাখছে বলেও রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

পাঁচশর মতো রোহিঙ্গাকে নিয়ে পাচারকারীরা সপ্তাহ দুয়েক আগে ট্রলারে করে মালয়েশিয়ায় পৌঁছানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তাতে ব্যর্থ হওয়ায় রোহিঙ্গাদের ট্রলার সাগরে ভাসতে থাকে। রোহিঙ্গাদের নৌযান ভিড়তে দেবে না বলে ইঙ্গিত দিয়েছে থাইল্যান্ডও।

এর আগে গত ১৫ এপ্রিল বাংলাদেশের ঊপকূলরক্ষীরা রোহিঙ্গাদের একটি নৌযান উদ্ধার করেন, যেটা দুই মাস আগে মালয়েশিয়া ফিরিয়ে দিয়েছিল।

প্রায় ৩৯০ জন অভুক্ত রোহিঙ্গা ওই নৌযানে ছিলেন, যাদের অধিকাংশের বয়স ২০ বছরের নিচে।  তাদের মধ্যে ১০০ জনের মতো না খেয়ে মারা যান বলে উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গারা জানিয়েছিলেন।

মেডিসিন সান ফ্রন্টিয়ার্সকে (এমএসএফ) ১৪ বছরে এক কিশোরী বলেছিলেন, “অনেকের পা ফুলে যায় এবং প্যারালাইজড হয়ে পড়েন। অনেকে মারা যান এবং তাদের সাগরে ফেলে দেওয়া হয়। সাগরে আমরা নিঃসম্বল অবস্থায় ছিলাম, প্রতিদিনই মানুষ মরছিল। আমাদের মনে হচ্ছিল, আমাদের নরক থেকে আনা হচ্ছে।”

ওই নৌযান থেকে উদ্ধার হওয়াদের চিকিৎসা দেওয়া এমএসএফের একজন টিম লিডার বলেন, “তাদের হাড্ডিসার দেহে অনেকের শুধু প্রাণটাই অবশিষ্ট ছিল।”

বেশ কয়েক বছর ধরেই মিয়ানমারের নিপীড়ন ও বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরের জীবন থেকে বেরোনোর তাগাদায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌযানে চড়ে সাগরপথে থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের উদ্দেশে যাত্রা করে আসছে রোহিঙ্গারা।

২০১৫ সালে থাইল্যান্ডে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানের মুখে পাচারকারীরা সাগরে মানুষ ভর্তি কার্গো ফেলে পালিয়ে যাওয়ার পর কয়েকশ রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়।

জাতিসংঘ সম্প্রতি সাগরে ভাসতে থাকা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার আহ্বান জানালেও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলো এখন করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সীমান্তে আরও কড়াকড়ি করেছে। এমনকি মুসলিম প্রধান মালয়েশিয়া সরকারেরও রোহঙ্গিাদের প্রতি সহমর্মিতা ‘হারিয়ে গেছে’ বলে রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

মালয়েশিয়ায় রোহিঙ্গাবিরোধী রোষের শিকারদের একজন জাফর আহমেদ আবদুল গনি। তিনি রোহিঙ্গাদের জন্য মালয়েশিয়ার নাগরিকত্ব দাবি করেছেন বলে খবর প্রকাশের পর তার ফেইসবুক অ্যাকাউন্টে আক্রমণাত্মক মন্তব্যের ঝড় বয়ে যায়, আসতে থাকে প্রাণহানির হুমকিও। পরে ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করতে বাধ্য হন রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার জাফর।