দান বাক্স ফাঁকা, দুর্ভাবনায় মসজিদ কমিটি

গাজীপুর সদর উপজেলার পাইনশাইল সরকারবাড়ি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে প্রতি বছর রোজায় মানুষের কাছ থেকে যে দান পাওয়া যায়, সেখান থেকে খরচ শেষেও আড়াই লাখ টাকার মতো জমে। ওই অর্থ বছরের অন্য সময় মসজিদের কাজে লাগানো হত।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 May 2020, 11:21 AM
Updated : 5 May 2020, 11:21 AM

কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে লকডাউনের কারণে বাইরে থেকে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়া বারণ। ফলে দানের টাকাও আর বাক্সে আসছে না। এ নিয়ে দুর্ভাবনায় রয়েছেন মসজিদ কমিটির সদস্যরা।
 
নিষেধ থাকার পরও বিভিন্ন মসজিদে বাইরের লোকের নামাজ পড়তে যাওয়ার খবর আসছে। রমজান ঘিরে ধর্মীয় আবেগ, মহামারীর বিপদ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকা, নিয়ম মানার ক্ষেত্রে সচেতনতার অভাবে অনেকেই মসজিদে জামাতে নামাজ পড়ার বিষয়ে উৎসাহী হচ্ছেন। আবার আর্থিক কারণেও মসজিদ খোলা রাখতে আগ্রহী মসজিদ কমিটিগুলোর অনেকে।  

পাইনশাইলের ওই মসজিদ কমিটির সভাপতি মো. গিয়াস উদ্দিন মোক্তার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অন্যবছর রোজায় ইমাম-খতিব-মুয়াজ্জিনদের বেতন-বোনাস দেওয়ার পরও অতিরিক্ত টাকা মসজিদ ফান্ডে জমা হত। কিন্তু এবার মসজিদে মুসল্লির উপস্থিতি কমে যাওয়ায় রমজানে ইমাম-মুয়াজ্জিনদের বেতন-ঈদ বোনাসের টাকা জোগাড়ে মুসল্লিদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হবে।”

এই সঙ্কট কাটাতে সরকারের ‘প্রণোদনার’ পাশাপাশি বিধিনিষেধ তুলে দেওয়ারও দাবি করেছেন গিয়াস উদ্দিন।

তিনি বলেন, “প্রতি ওয়াক্তের নামাজ ছাড়াও জুমা ও তারাবির নামাজে মুসল্লির উপস্থিতি সরকার নির্ধারিত সংখ্যায় ঠিক রাখা সম্ভব হচ্ছে না। মসজিদ মুসল্লিদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হোক।”

বাংলাদেশে প্রায় সব মসজিদেই ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেমদের বেতন-ভাতা হয় নামাজ পড়তে যাওয়া মানুষের দান করা টাকা থেকে। আর রমজান মাস এলে সেই টাকা ওঠে কয়েকগুণ বেশি। সেই সঙ্গে যোগ হয় তারাবি বাবদ মানুষের দান। রোজার এই আয় দিয়েই চলে বছর।

দেশের গণ্ডি ছাড়ালেও এই চিত্র বদলায় না। করোনাভাইরাস মহামারীতে যুক্তরাজ্যের মসজিদগুলোও পড়েছে সঙ্কটে। এজন্য স্থানীয় মসজিদগুলোর তিন মাসের ভাড়া মওকুফ করে দিয়েছেন টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের মেয়র জন বিগস।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের হিসাবে, বাংলাদেশে মোট মসজিদের সংখ্যা ২ লাখ ৬৮ হাজারের বেশি। বাইরের মানুষের যাওয়া বন্ধ থাকায় এবার আয়ের পথ বন্ধ; তাই `প্রণোদনার’ দাবি তুলছেন বিভিন্ন মসজিদ কমিটির নেতা ও ইমামদের অনেকে।

শ্রীপুরের মাওনা হাজিপাড়া জামে মসজিদে গত ১ মে জুমার নামাজে ভিড় ছিল অন্য সময়ের মতই।

করোনাভাইরাস বৈশ্বিক মহামারী আকার ধারণ করার পর বিভিন্ন দেশ এমনকি সৌদি আরবও মসজিদে জামাত বন্ধ করে দেয়। কেননা এই রোগের কোনো প্রতিষেধক না থাকায় মানুষে মানুষে সংস্পর্শ এড়ানোই সংক্রমণ এড়ানোর একমাত্র পথ। তাছাড়া কয়েকটি দেশে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অনেকের জমায়েত ভাইরাসের বিস্তারেও ভূমিকা রেখেছিল।
বাংলাদেশে প্রাদুর্ভাব শুরুর পর গত ৬ এপ্রিল দেশের সব মসজিদে বাইরে থেকে মুসল্লি ঢোকার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় সরকার। বলা হয়, ইমাম-মুয়াজ্জিনসহ মসজিদের খাদেমরা মিলে পাঁচজনের জামাত হবে। আর জুমার নামাজে থাকতে পারবেন মসজিদসংশ্লিষ্ট ১০ জন।
এরপর রমজানে মসজিদে তারাবির জামাতে সর্বোচ্চ ১২ জনের অংশগ্রহণের সীমা ঠিক করে দেয় ধর্ম মন্ত্রণালয়। সেখানেও বাইরের কারও যোগ দেওয়ায় নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকে।
কিন্তু এসব নির্দেশনা আর রোগ সংক্রমণের তোয়াক্কা না করে দেশের বাইরের লোকের নামাজ আদায়ের খবর পাওয়া গেছে বিভিন্ন মসজিদে।
গত শুক্রবার গাজীপুর মহানগরের ভোগড়া, সদর উপজেলার ভাওয়াল মির্জাপুর, জগরী, পাইনশাইল, শ্রীপুর উপজেলার মাওনা এলাকার মসজিদে অন্য সময়ের মতই বেশি সংখ্যায় মুসল্লিদের উপস্থিতিতিতে জুমার নামাজ আদায় করতে দেখা যায়।
স্থানীয়রা বলছেন, এসব মসজিদে তারাবির নামাজেও থাকে অনেক মানুষের উপস্থিতি। ভাইরাস থেকে বাঁচতে উপস্থিতি কমানোর উদ্যোগ দেখা যায়নি মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকেও।
নিজের মসজিদের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে গাজীপুরের ডগরী সাইরুল্লাহ জামে মসজিদের ইমাম মো. আব্দুল বারী হাওলাদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অনেক মুসল্লি একা নামাজ পড়তে পারেন না। তারা গিয়ে মসজিদে জামাতবদ্ধ হয়েই নামাজ আদায় করতে চান। সরকারি নির্দেশ না মেনেই তারা মসজিদে গিয়ে হাজির হন। তখন তাদের ‘না’ বলতেও খারাপ লাগে।”
টঙ্গীর মাছিমপুর বাইতুল গাফুর জামে মসজিদের খতিব মুফতি হাফিজুল্লাহ কাশেমী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এই মসজিদে ‘অনেক কষ্টে’ মুসল্লিদের সরকারি সংখ্যা ঠিক রাখা হলেও আশপাশে অনেক মসজিদে তা ঠিক থাকছে না।
এক্ষেত্রে মুসল্লিদের ‘আবেগ, অজ্ঞতা, অবহেলা, অশিক্ষা’ জড়িত বলে মত দেন তিনি।
রাজধানীর অধিকাংশ মসজিদে সমাগম ১০-১২ জনের মধ্যে রাখা হলেও মানুষকে নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হচ্ছে বলে জানান মসজিদ কমিটির নেতা ও ইমামরা। অধিকাংশ জায়গায় 'খতম তারাবির' জায়গায় 'সুরা তারাবি' হচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
ঢাকার মোহাম্মদপুরের বায়তুল ফজল জামে মসজিদ কমিটির সভাপতি সুলতান আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকারি নির্দেশনা মেনে ১০-১২ জনের মাধ্যমে জুমা আর তারাবি পড়া হচ্ছে। সামাজিক দূরত্বও বজায় রাখা হচ্ছে।
“কিন্তু মানুষকে মানানো কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মানুষ যেভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়ে, কত দিন নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, সেটা বলা মুশকিল।”
মানুষের মধ্যে ‘মূর্খতা, উদাসীন ভাব ও ধর্মান্ধতা’ নিয়ম না মানার বড় কারণ বলে মন্তব্য করেন গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এসএম তরিকুল ইসলাম।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মসজিদ হল আল্লাহর ঘর, সেখানে গেলে কী হবে, এমন একটা ভাব। অথচ আমাদের চেয়ে যারা দ্বীন বেশি বোঝে, তারাও তো মহামারীর সময় মসজিদ বন্ধ রেখেছে।”
কিছু লোকের একগুয়েমির সঙ্গে ‘স্থানীয় রাজনীতিও’ মসজিদে জনসমাগম চালু রাখার পেছনে কাজ করছে বলে মন্তব্য করেন জেলা প্রশাসক।
গাজীপুর মহানগর পুলিশের কমিশনার মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, “এমন অনেকে আছেন, যারা হয়ত করোনাভাইরাস সংক্রমণের ধরণ বা ঝুঁকির কথা ভালোভাবে বোঝেন না বা জানেন না। তারাই মসজিদে জমায়েত হওয়ার চেষ্টা করেন।”
তবে টঙ্গীর মাছিমপুর বাইতুল গাফুর জামে মসজিদের খতিব মুফতি কাশেমী স্বীকার করেন, রোজায় মসজিদে বেশি উপস্থিতির সঙ্গে বেশি অর্থ পাওয়ার বিষয়টিও জড়িত।
“অন্য বছর এ মাসে মসজিদগুলো মুসল্লিদের কাছ থেকে একটা বড় অংকের টাকা পায়, যা দিয়ে তাদের বেতন বা বোনাসও দেওয়া হয়।”
করোনাভাইরাসের এই ক্রান্তিকালে তিনি ইমাম-মুয়াজ্জিন-খাদেমদের জন্য সরকারের `প্রণোদনা’ দেওয়ার দাবি জানান।
ঢাকার মোহাম্মদপুরের বায়তুল ফজল জামে মসজিদ কমিটির সভাপতি সুলতান আহমেদও মসজিদের আয়ে প্রভাব পড়ার কথা বলেছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “দান-অনুদানের বড় অংশ আসে রমজান মাসে। সেখান থেকে ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদেমদের বেতন দেওয়া হয়। একটি এতিমখানার খরচও আছে এর সঙ্গে।
“রোজায় বোনাসও দিতে হয়। এবার বেতন দিতেই কষ্ট হবে। আমরা সে কারণে আলাপ করছি, কীভাবে অন্তত বেতনটা দেওয়া যায়।”
এসব বিষয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক আনিস মাহমুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কেউ প্রণোদনার দাবি জানায়নি। দাবি এলে সেটা সরকার দেখবে।”

গত ১ মে গাজীপুরের ভোগড়া উত্তর পাড়ার একটি মসজিদে নামাজের জামাত হয়েছে ছাদেও।

মসজিদগুলোতে সরকারি নির্দেশনা মানার বিষয়ে তিনি বলেন, “যত জায়গা আছে, তার মধ্যে মসজিদেই সবচেয়ে বেশি সরকারি নির্দেশনা মানা হচ্ছে। মসজিদ বিপুল আকারে মানুষের উপস্থিতির খবর আমরা কোথাও পাইনি।
“কিন্তু মসজিদের সমাগম পুলিশ দিয়ে ঠেকানো যাবে না। মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি ও তাদেরকে উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে কিছুটা কাজ হবে।”
অর্থ-যোগ লন্ডনেও
যুক্তরাজ্যে প্রায় ৩০ লাখ মুসলমানের জন্য রয়েছে ১৭শর বেশি মসজিদ। শতকরা পাঁচ ভাগ মুসলিম জনগোষ্ঠীর এই দেশে ২৪ মার্চ থেকে লকডাউন শুরুর অন্য উপাসনালয়ের পাশাপাশি মসজিদগুলোও সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে।
স্থানীয় মুসলমানদের দানের পাশাপাশি ব্রিটিশ বিভিন্ন চ্যারিটি সংগঠনের সহায়তায় চলে এসব মসজিদ; যার অধিকাংশের অবস্থান ভাড়া করা ভবনে।
এই সঙ্কটকালে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল অব মস্কের আহ্বানে এসব ভবনের তিন মাসের ভাড়া মওকুফ করে দিয়েছেন ওই এলাকার মেয়র জন বিগস।
ইউরোপের অন্যতম বড় ইস্ট লন্ডন মসজিদের ট্রাস্ট্রি ও টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল অব মস্কের ট্রেজারার আব্দুল মুনিম জাহেদী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সারা দেশের মত টাওয়ার হ্যামলেটসের সব মসজিদ এবং ইস্ট লন্ডন মসজিদ বিশাল আর্থিক সঙ্কটের সম্মুখীন ।
“লকডাউনে যতটা না হয়েছে, এই রমজান মাসে মসজিদগুলো তাদের কার্যক্রম চালাতে না পারায় এবং দান-খয়রাত সংগ্রহ করতে না পারায় ক্ষতি হচ্ছে বেশি। মসজিদগুলোর মূল আয়ই হচ্ছে রমজানে প্রাপ্ত দান ও বিশেষ করে শুক্রবারে মুসল্লিদের কাছ থেকে পাওয়া চাঁদা।”
অন্য বছর প্রায় প্রত্যেক মসজিদে শতশত মানুষের জন্য বিনামূল্যে ইফতারের আয়োজন করা হত। শুধু ইস্ট লন্ডন মসজিদেই রোজার মাসে মানুষের দান থেকে আসত ৫ থেকে ৬ লাখ পাউন্ড।
মুনিম জাহেদী বলেন, “এখন দান বন্ধ হওয়ায় বিশাল সঙ্কটে পড়বে মসজিদ। তবে অনেকে অনলাইনে মসজিদে সাহায্য অব্যাহত রেখেছেন ।
“মানুষের জীবন বাচাঁনো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লকডাউন শুরুর সাথে সাথে কাউন্সিল অব মস্ক এবং এলএমসির পক্ষ থেকে সরকারের সকল নির্দেশনা মেনে চলার আহ্বান জানানো হয়েছে। সবাই এ বার্তাকে ইতিবাচক হিসাবে নিয়েছেন এবং মেনে চলছেন।”
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে ঢাকা থেকে তথ্য দিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক লিটন হায়দার ও মঈনুল হক চৌধুরী এবং নিজস্ব প্রতিবেদক মাসুম বিল্লাহ; গাজীপুর থেকে জেলা প্রতিনিধি আবুল হোসেন এবং যুক্তরাজ্য থেকে লন্ডন প্রতিনিধি সৈয়দ নাহাস পাশা। সম্পাদনা করেছেন মুনীরুল ইসলাম ও জাহিদুল কবির। ]