মহামারীর সময়ে দুর্ভোগ-দুশ্চিন্তায় অন্তঃসত্ত্বারা

মা হওয়ার উচ্ছ্বাস আর আনন্দে সময়টা কাটানোর কথা থাকলেও নতুন করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে উল্টো নানা সমস্যা আর দুশ্চিন্তা ভর করছে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের মনে।

কাজী নাফিয়া রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 May 2020, 08:50 AM
Updated : 5 May 2020, 12:16 PM

ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সরকারের ভাষায় ‘সাধারণ ছুটি’তে গণপরিবহন বন্ধ থাকা ও হাসপাতালগুলোর সেবা সীমিত হয়ে পড়ায় চিকিৎসক দেখানো ও পরীক্ষা-নিরীক্ষায় জটিলতায় পড়তে হচ্ছে অনেককে।

কেউ কেউ আবার সংক্রমণের আশংকায় হাসপাতালে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষায় যেতেও ভয় পাচ্ছেন।

অন্তঃসত্ত্বাদের বিড়ম্বনায় পড়ার কথা স্বীকার করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, রোগীদের সেবা না দেওয়া নৈতিকতাবিরোধী।

তবে চিকিৎসকরা রোগীদের স্বার্থেই সরাসরি দেখার চেয়ে টেলিমেডিসিনে জোর দিচ্ছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইংরেজি মাধ্যমের প্রভাষক শাহজীদা নাজনীন সুরভী এই সময়ে হাসপাতালে যাওয়াকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছেন।

তাই সব সময় ধানমন্ডির একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিলেও এখন আর সেখানে যাচ্ছেন না।

সম্প্রতি আজিমপুরে বাসার কাছেই একটি হাসপাতালে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়েছেন, টিকা নিয়েছেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “পরিস্থিতি সামনে আরও খারাপ হতে পারে। তাই যথাসম্ভব প্রোটেকশন নিয়েই কাজগুলো সেরেছি। এখন ২১ প্লাস সপ্তাহে অ্যানোমালি স্ক্যানটা করাতে পারব কিনা খুব চিন্তায় আছি।”

গর্ভাবস্থার ১৮ থেকে ২২ সপ্তাহের (পঞ্চম মাস) সময় অ্যানোমালি স্ক্যানের মাধ্যমে গর্ভস্থ শিশুর বৃদ্ধি স্বাভাবিক আছে কিনা এবং গর্ভফুল (প্ল্যাসেন্টা) এর গতিবিধির উপরে নজর রাখেন চিকিৎসক।

প্রথমবার মা হওয়ার উচ্ছ্বাসের পরিবর্তে এখন দুশ্চিন্তা ও মানসিক অস্থিরতায় ভুগছেন তিনি।

“আমার ডাক্তার ইমার্জেন্সি ছাড়া রোগী দেখছেন না। তাকে ফোনেও পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তার ফোন নম্বর আমার কাছে নেই, কারণ অ্যাপোয়েনমেন্ট নিয়ে তাকে দেখাতাম। তাই কোনো সমস্যায় পড়লে কিছুই করার থাকছে না। আর হুট করে অন্য ডাক্তারকে দেখাতেও ভরসা পাচ্ছি না।”

বাধ্য হয়েই ইন্টারনেট থেকেই বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ নিচ্ছেন তিনি।

জরুরি সমস্যায় ব্যক্তিগত ডাক্তারকে ফোনে পেলে অনেক সহায়তা হয় জানিয়ে সুরভী বলেন, “অনেক সময় ফোনে সব সমস্যা চিকিৎসককে বোঝানো যায় না। সেক্ষেত্রে ডিজিটালি পেমেন্টের মাধ্যমে হলেও নিয়মিত রোগীদেরকে অনলাইনে সেবা দেওয়া উচিত।”

গেণ্ডারিয়ার লিমা প্রীতম আজগর আলী হাসপাতালে যার অধীনে ছিলেন সেই চিকিৎসক এখন চেম্বার বন্ধ করে ফোনে সেবা দিচ্ছেন।

ফোনে ডাক্তারকে সব কিছু বোঝানো সম্ভব হচ্ছে না জানিয়ে এই গৃহিণী বলেন, “বাসার আশপাশেও তেমন কোনো ডাক্তার পাওয়া যাচ্ছে না। কেমন একটা ভয় কাজ করছে সব সময়।”

তার দুটি টিটেনাস টিকার ডোজ দেওয়ার কথা থাকলেও একটি দিয়েছেন, আরেকটি দিতে পারছেন না।

“হাসপাতালে যেতে ভয় লাগছে। কারণ হাসপাতাল থেকেও তো করোনাভাইরাস ছড়াচ্ছে।”

যে হাসপাতালটিতে নিয়মিত সেবাসহ সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন, এখন সেখানে তা করতে পারছেন না। প্রয়োজনে দূরের হাসপাতালে যেতে হচ্ছে তাকে।

লিমা বলেন, “যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে। আল্ট্রাসনোগ্রাম করাতে গিয়ে কোভিড-১৯ সম্পর্কেও নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে।”

পুরান ঢাকার হাসপাতালগুলোতে ভরসা করতে না পারায় বর্তমানে পান্থপথের বিআরবি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন লিমা। শেষ পর্যন্ত এই হাসপাতালেই সন্তান জন্ম দিতে পারবেন কিনা, তা নিয়েও সংশয়ে রয়েছেন তিনি।

“তখন এই হাসপাতালটি খোলা থাকবে কিনা কিংবা এই ডাক্তাররা সেবা চালিয়ে যাবেন কিনা জানি না, মাতৃত্বের চেয়ে এসব বিষয় নিয়েই বেশি ভাবতে হচ্ছে।”

গর্ভকালীন সময়ে ডাক্তার পরিবর্তন করায় নানা জটিলতার আশংকায় রয়েছেন তিনি।

গর্ভবতী মায়েরা যেন যেকোনো সমস্যায় হাসপাতালে সেবা পেতে পারেন, তাদের যাতে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে না হয়; সে পদক্ষেপ চান তিনি।

জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে মা হওয়ার প্রত্যাশায় থাকা এই নারী জন্মের পর বাচ্চার টিকাসহ অন্যান্য বিষয় নিয়েও চিন্তিত বলে জানান।

বেশ কিছু হাসপাতালে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের চিকিৎসার খরচ কম থাকলেও পরীক্ষা-নিরীক্ষা বন্ধ থাকায় অন্য হাসপাতালে যেতে গাড়ি ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ বাড়ায় চিন্তিত তারা।

সপ্তাহখানেক পর অস্ত্রোপচার হওয়ার কথা ওয়ারীর সাবিনা ইসলামের। কিন্তু তার বাসা করোনাভাইরাস সংক্রমিত এলাকায় হওয়ায় কয়েকটি হাসপাতাল ভর্তি নিচ্ছে না।

এমন পরিস্থিতিতে দিশেহারা এই নারী বলেন, “মগবাজারের একটি হাসপাতালে এতোদিন দেখিয়েছি। ৩৫ সপ্তাহ চলছে এখন। ৩৭ সপ্তাহে সিজার করার কথা।

“দুই দিন ধরে পেটে হালকা ব্যাথা, তাই আল্ট্রাসনোগ্রাম করে ডাক্তারের কাছ থেকে সিজারের ডেট নিয়ে আসব বলে গেলাম। কিন্তু ওয়ারী থেকে এসেছি জেনে দেখলই না, ফিরিয়ে দিল। এখন শেষ সময়ে কোথায় যাব কিছুই বুঝতেছি না।”

সাবিনা ইসলামের কথার সত্যতা মিলে আরেক ভুক্তভোগীর কথায়।

সম্প্রতি দ্বিতীয়বার মা হওয়া মিরপুর-১ নম্বরের বাসিন্দা ওই নারী বলেন, “আগে থেকেই জানতাম, অধিকাংশ হাসপাতাল এটা করছে (অন্তঃসত্ত্বাদের ফিরিয়ে দেওয়া)। একটি হাসপাতালে গিয়ে ফিরেও এসেছি।

“তাই মিরপুরে মা-র বাসায় থাকলেও তা গোপন করি। বনশ্রীতে আমার শ্বশুড়বাড়ি। সেই ঠিকানা দিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হই। তাছাড়া তো কোনো উপায় নেই। আমাদের এলাকায় করোনার প্রকোপ বেশি, তাই আমরা কি চিকিৎসা পাব না?”

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের প্রধান নিলুফার সুলতানা জানান, রোগীরা ভোগান্তিতে পড়লেও টেলিমেডিসিন সেবার মাধ্যমে পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।

“মহামারীর এই ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে কিছুটা সমস্যা হতেই পারে। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে কিছু সমস্যা হতে পারে। সে কারণে বলা আছে, কোনো সমস্যা অনুভব করলে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চলে আসতে।

“অনেক মায়েরাই বিষয়গুলো বুঝতে না পারায় দুশ্চিন্তায় থাকেন। তাদের কাউন্সিলিং করতে হবে, মন ভালো রাখতে হবে। ফোনে চিকিৎসা দেয়ার সময়ও তাদের সাহস দিতে হবে। কোনো সমস্যায় যেন হাসপাতালে চলে আসেন, সেটা বলতে হবে।”

রোগীদের সুবিধার্থেই তাদের চেম্বারে আসতে মানা করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “প্রাইভেট চেম্বারগুলো বন্ধ রাখার কারণ হচ্ছে রোগীরা গ্যাদারিং করে বসলে সামাজিক দূরত্ব মানা সম্ভব হয় না। ডাক্তারের কাছ থেকে ৩ বা ৬ ফুট দূরে থাকা সম্ভব না। সব রোগীদেরই এক্সামিন করতে হয়।

“রোগী থেকে আরেকজন রোগী সংক্রমিত হতে পারে। আবার রোগী থেকে ডাক্তার সংক্রমিত হলে উনি যত রোগী দেখবেন, সবাই সংক্রমিত হতে পারে। এই ভয়াবহতাটা কিন্তু একটা ভিজিটের চেয়ে অনেক অনেক বেশি। সে কারণেই প্রাইভেট চেম্বারগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে।”

এই চিকিৎসক বলেন, “আমরা এখন সারাক্ষণ টেলিমেডিসিন সেবা দিচ্ছি। তখন যদি কোনো রোগীর কোমরবিডিটি অর্থাৎ অন্য কোনো সমস্যা থাকে, তাদেরকে আমরা আসতে বলি।”

রোগীদের সেবাবঞ্চিত হওয়ার তথ্য পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোভিড-১৯ সংক্রান্ত মিডিয়া সেলের প্রধান অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমান খানও।

“যাদের করোনার লক্ষণ, উপসর্গ নেই তারা নন-কোভিড হাসপাতালে যাবেন। তবে আমি শুনতে পাচ্ছি, কিছু হাসপাতাল বলে- আপনার যে কোভিড-১৯ নাই সেই সার্টিফিকেট নিয়ে আসেন। এটা আসলে বিড়ম্বনারই সৃষ্টি করে।

“এজন্য আমরা হাসপাতালগুলোকে বলে রেখেছি, রোগী আসলে তাদের চিকিৎসা দিতে। যারা সন্দেহজনক তাদের একটা কর্নারে ট্রিটমেন্ট হবে, যারা সাধারণ তাদেরটা স্বাভাবিকভাবেই হবে।”

তিনি জানান, দেশের ১১০টি কোভিড হাসপাতাল ছাড়া নন-কোভিড হাসপাতালগুলোতে রোগীরা স্বাভাবিকভাবেই সেবা নিতে পারেন।

তবে প্রাইভেট হাসপাতালগুলো সরকারের শতভাগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না বলেও জানান তিনি।

হাবিবুর রহমান বলেন, “একজনের অধীনে আমি ছিলাম মাসের পর মাস, কিন্তু চূড়ান্ত মুহূর্তে তিনি দেখবেন না, সেটা তো নৈতিকতার মধ্যে পড়ল না। উনি প্রপার পিপিই পরে চেক করুক। খুব বেশি সন্দেহজনক মনে হলে করোনা চেক করে নিতে পারেন। প্রোপারলি পিপিই পরে নিলে তো ট্রিটমেন্ট করাই যায়।

“এগুলো অনেকখানি সাহস ও আন্তরিকতার বিষয়। সবক্ষেত্রে তো সরকার সবাইকে দিয়ে সব জায়গায় উপস্থিত থেকে বাস্তবায়ন করে দিতে পারবে না।”

প্রত্যন্ত অঞ্চলের যারা টেলিমেডিসিন সেবাও নিতে পারছেন না তাদের কমিউনিটি ক্লিনিক বা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।