আক্রান্ত ব্যক্তি ও পরিবারের সদস্যদের সামাজিক অপমান ও অপদস্থ হওয়া থেকে রক্ষায় সমন্বিত প্রতিরোধ দল গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
শনিবার এক ভার্চুয়াল আলোচনা অনুষ্ঠানে গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্সের সহযোগী অধ্যাপক শাহাদুজ্জামান বলেন, যারা কাউকে অপদস্থ করায় ভূমিকা রাখবেন তাদের আইনের আওতায় আনা দরকার। সামাজিক পর্যায়ে নানা রকম পদক্ষেপও নেওয়া উচিত।
“স্থানীয় পর্যায়ে যারা প্রশাসন আছেন, রাজনীতিবিদ আছেন, স্বেচ্ছাসেবী আছেন, অন্যান্য সংগঠন ও এনজিওরা আছেন- সবাই যৌথভাবে এন্টি স্টিগমা বা অপবাদ ও অপদস্থ করার যে চর্চাগুলো চলে, তা প্রতিরোধে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।”
বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ আয়োজিত ওই ওয়েবিনারে করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে মানুষের মধ্যে ভয় এবং সামাজিক অপবাদ (স্টিগমা) নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান।
ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) শিক্ষক সুমন রহমানের সঙ্গে যৌথভাবে ওই গবেষণা করেন এই চিকিৎসা-নৃবিজ্ঞানী।
গবেষণায় বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ধরনের গুজব, মানুষের কাছে তথ্যের স্বল্পতা ও ভুল ধারণা এবং মূলধারার গণমাধ্যমের বাইরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দ্বারস্থ হওয়ার বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়।
শাহাদুজ্জামান বলেন, “অপবাদের একটা ভয়ঙ্কর সংস্কৃতি নানান এলাকায় তৈরি হতে দেখা যাচ্ছে। কোভিড-১৯ রোগী এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা এখন এই অপবাদের শিকার হচ্ছেন। তাদের বাড়িঘরে হামলা করা হচ্ছে, তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে মানুষ এখন করোনাভাইরাস আক্রান্ত হলেও চিকিৎসা নিতে ভয় পাচ্ছে। স্বাস্থ্যকর্মীরা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।”
তিনি বলেন, “আক্রান্ত রোগীকে ফেলে পালাচ্ছে স্বজনরা, আক্রান্ত নিজেই আইসোলেশন থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। এসবই ঘটছে সামাজিকভাবে নিগৃহীত হওয়ার ভয় থেকে। ক্রমশ ব্যাপক আকার ধারণ করেছে এই ভয়। এতে করোনার সাথে লড়াইয়ে আমরা ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছি।
“আমাদের সামাজিক বন্ধন যেটা, সেটা হুমকির মুখে পড়ে গেছে। স্বাস্থ্যকর্মীদের ঝুপড়িতে রেখে দেওয়ার ঘটনা আমরা দেখেছি।”
অজানা থেকে মানুষের মধ্যে ভয়ের জন্ম হয় মন্তব্য করে শাহাদুজ্জামান বলেন, অজানাকে জানার পরিধির মধ্যে নিয়ে আসতে গণমাধ্যমে উপযুক্ত তথ্য ও নির্দেশনা দিয়ে সচেতন করতে হবে মানুষকে।
“খুব সতর্কভাবে এই বার্তাগুলো তৈরি করতে হবে এবং ছড়িয়ে দিতে হবে। অবাধ তথ্য যেমন নিশ্চিত করতে হবে, পাশাপাশি গুজবের ব্যাপারেও জিরো টলারেন্স থাকতে হবে।”
সেমিনারে আলোচনায় অংশ নিয়ে নাগরিক টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ডা. আব্দুন নূর তুষার বলেন, “সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতি আমাদের নির্ভরশীলতা তৈরি হচ্ছে, কারণ যেটাকে মূলধারার মিডিয়া বলা হয়, সেই মিডিয়াকে ট্রাস্ট করে না। এই ট্রাস্ট না করার জন্য অথরিটির একটা বড় দায়িত্ব আছে।
“উনারা যেটা করেছিলেন, প্রথমে যেটা করেছেন, গুজব প্রতিরোধ কমিটি, নানা ধরনের ধমক-ধমকের কমিটি। এ কারণে মানুষের মধ্যে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে, আমরা যেটা দেখি বা আমাদের যেটা দেখানো হয়, এটা ঠিক না। এটার পেছনে অনেক কিছু রয়ে গেছে। শুরু থেকে যদি স্বচ্ছতা বজায় রাখা হত, এই স্টিগমাটা কমে যেত।”
ভুল তথ্যের পেছনে মানুষের ছোটার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি আরও বলেন, “অনেক সময় মানুষ যেটা চোখের সামনে দেখছে, সেটা নিয়ে যারা অথরিটি তারা কথা বলছেন না।
“না বলার ফলে যেখান থেকে আমাদের তথ্য আসে, যেমন আইইডিসিআর যে সংখ্যাটা বলে, মানুষ সেটা বিশ্বাস করে না। মানুষ মনে করে এর চাইতে আরও বেশি আছে। আইইডিসিআরের আরোগ্য বা মৃত্যুর সংখ্যা মানুষ বিশ্বাস করে না।”
তুষার বলেন, “আমার মনে হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষের মধ্যে ধারণা থাকবে এমন নিয়ন্ত্রণের, ততক্ষণ পর্যন্ত স্টিগমাটাইজেশনকে আমরা প্রতিরোধ করতে পারব না। মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় যাবে এবং থানকুনি পাতা খাবে। আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় যখন ভুল তথ্যের ঢেউ বয়ে গেছে, তার বিপরীতে সঠিক তথ্যের ব্যবস্থা সেভাবে হয়নি।”
বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের আহ্বায়ক আহমেদ মুশতাক চৌধুরীর সঞ্চালনায় ওই আলোচনা অনুষ্ঠানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের শিক্ষক শাহানা সিদ্দিকী ও গবেষণা সহযোগী নাহেলা নওশীনের করা আরেকটি গবেষণা প্রতিবেদনও উপস্থাপন করা হয়।