রানা প্লাজা: বিচার শুরুর ‘গেরো’ খুলবে কবে জানেনা কেউ

সাত বছর আগে সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলাটির বিচার শুরুর জট এখনও খোলা সম্ভব হয়নি।

আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 April 2020, 10:19 AM
Updated : 24 April 2020, 10:23 AM

মামলাটির কার্যক্রমের ওপর আসামিপক্ষ সেই যে হাই কোর্ট থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে রেখেছে, সে গেরো থেকে এখনও বের হওয়া যায়নি। অথচ অভিযোগপত্র দায়েরের পর পেরিয়েছে চার বছর। এর মধ্যে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরুর তারিখ পিছিয়েছে ২০ বারের বেশি।

এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের প্রধান কৌঁসুলি খন্দকার আব্দুল মান্নান   এবং রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, কেউ বিচার শুরুর বিষয়ে সদুত্তর দিতে পারেননি।

তবে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পেশকার আমিনুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন, মামলাটিতে আগামী ৩০ জুলাই ফের সাক্ষ্যগ্রহণের দিন রয়েছে।

বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়ে যাওয়া সেই ঘটনার বিচারে দীর্ঘসূত্রতাকে ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও প্রহসন’ বলছেন শ্রমিক স্বার্থ নিয়ে সোচ্চার কর্মীরা।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভার বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন আট তলা রানা প্লাজা ধসে নিহত হন এক হাজার ১৩৫ জন; প্রাণে বেঁচে গেলেও পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয় আরও হাজারখানেক গার্মেন্ট শ্রমিককে।

ঘটনার দিনই সাভার থানায় দুটি মামলা হয়। পরের বছর দুর্নীতি দমন কমিশন দায়ের করে আরেকটি মামলা।

প্রথমটিতে হতাহতের ঘটনা উল্লেখ করে ভবন ও কারখানা মালিকদের বিরুদ্ধে মামলাটি করেন সাভার মডেল থানার এসআই ওয়ালী আশরাফ।

আর রাজউক কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিনের দায়ের করা অন্য মামলাটিতে ভবন নির্মাণে ত্রুটি ও নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ আনা হয়।

এর আগে আইনজীবী খন্দকার আব্দুল মান্নান জানিয়েছিলেন, সাত আসামির আবেদনে তাদের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনায় হাই কোর্টের স্থগিতাদেশ থাকায় বিচার শুরু করা যাচ্ছে না।

স্থগিতাদেশের আবেদনকারী সাত আসামির মধ্যে আবু বকর সিদ্দিক নামের একজন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।

এ প্রসঙ্গে খন্দকার আব্দুল মান্নান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হাই কোর্টে যাদের মামলা স্থগিত হয়ে গিয়েছিল, তাদের মধ্যে মোহাম্মদ আলী ছাড়া সবার স্থগিতাদেশ উঠে গেছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। কিন্তু হাই কোর্টের সংশ্লিষ্ট সেকশন থেকে আমরা এখনও স্থগিতাদেশ খারিজের আদেশটি পাইনি। যে কারণে আমরা সাক্ষ্য নিতে পারছি না।”

হাই কোর্টের স্থগিতাদেশ উঠে যাওয়ার পর শুনানি করতে প্রস্তুত আছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় থেকে কোনো খবর না আসলে আমরা কি করতে পারি? তারা উদ্যোগী হলে আমরাও উদ্যোগ নিতে পারি।”

এ প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, “আমাকে তো জানাতে হবে যে মামলাটিতে কার কার বিচার এখানে স্টে রয়েছে।না জানালে আমি কি করতে পারি?”

বিষয়টি জানানোর দায়িত্ব কার- এমন প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে মাহবুবে আলম বলেন, “যে আসামিদের বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে তাদের বাদ দিয়ে যাদের পক্ষে মামলার কার্যক্রম স্থগিত নেই তাদের বিচার শুরু হতে তো বাধা নেই।”

‘অবহেলা ও অবহেলাজনিত হত্যার’ অভিযোগে মামলা দায়েরের দুই বছর পর ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলায় সাক্ষী করা হয় ৫৯৪ জনকে।

আসামিদের আবু বক্কর সিদ্দিক ও আবুল হোসেন মারা যাওয়ায় এখন আসামির সংখ্যা ৩৯ জন।

২০১৬ সালের ১৮ জুলাই ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ এস এম কুদ্দুস জামান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন।

আসামিদের মধ্যে মো. শাহ আলম মিঠু, মো. আবুল হাসান ও সৈয়দ শফিকুল ইসলাম জনির বিরুদ্ধে প্রধান আসামি সোহেল রানাকে পালাতে সহযোগিতা করায় জন্য দণ্ডবিধির ২১২ ধারায় অভিযোগ আনা হয়। বাকি ৩৮ জনের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ গঠন করা হয়।

সোহেল রানা কারাগারে রয়েছেন। পলাতক রয়েছেন মাহবুবুর রহমান, কামরুল ইসলাম, মনোয়ার হোসেন বিপ্লব, সৈয়দ শফিকুল ইসলাম, রেজাউল করিম, নান্টু কন্ট্রাকটর ও নয়ন মিয়া।

রানার বাবা আব্দুল খালেক ও মা মর্জিনা বেগমসহ বাকি আসামিরা জামিনে রয়েছেন।

বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের অর্থ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম সবুজ।

“ভবন ধসে পড়ার আশঙ্কা থাকলেও ও পরিত্যক্ত জেনেও জোর করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভয় দেখিয়ে শ্রমিকদের বাধ্য করা হয়েছিল। এটি নিষ্ঠুরতম হত্যার ঘটনা। বিশ্বে সাড়া ফেলা মামলার বিচার যদি এরকম হয় তবে কি আমরা বলতে পারি না যে এগুলো বিচারের নামে প্রহসন?” বলেন এই শ্রমিক নেতা।

গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বলেন ,“আমার দুই-তিনজন আজ সাভারে রানা প্লাজায় নিহতদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে ফুল দিতে গিছিলাম ।কিন্তু সেখানে ঢুকতে দেয়া হয়নি।অথচ সরকার আবারে কারখানাগুলো খোলার উদ্যোগ নিয়েছে। এটি সরকারের দ্বৈত নীতি।

“আমরা মামলার দ্রুত বিচার চাচ্ছি শুরু থেকেই। কিন্তু আমরা জানতে পেরেছি সরকার মামলার বিচারের ব্যাপারে আন্তরিক নয়। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা বিচার নিয়ে নাটক করছে। সে কারণে মামলার কোনো তথ্যই রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবদের হাতে নেই। আর তা ছাড়া রানা ছাড়া সকল আসামি ইতোমধ্যে জামিনও পেয়ে গেছে।বিচারের নামে তারা প্রহসন করছে।”

রানা প্লাজা ধসের পর ইমারত নির্মাণ আইনে দায়ের করা মামলাটিতেও সাক্ষ্যগ্রহণ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আনোয়ারুল কবির বাবুল।

অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় থেকে এ বিষয়ে পদক্ষপ নেয়া হচ্ছে না জানিয়ে তিনি বলেন, “কয়েকজন আসামি অভিযোগ গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিভিশন মামলা করেছেন। রিভিশন মামলাটির আদেশ না পাওয়ায় সাক্ষ্যগ্রহণ হচ্ছে না। তারিখের পর তারিখ চলে যাচ্ছে।”

নথিপত্রে দেখা যায়, রাজউকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিনের করা এই মামলায় ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ভবনের মালিক সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। প্রায় দুই বছর আগে অভিযোগ গঠনও হয়েছে।

দুর্ঘটনার পর যে কয়েকটি মামলা হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা মামলায় সাজা হয়েছে রানা ও তার মায়ের।

সম্পদের হিসাব দাখিল না করায় রানার তিন বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। একই সঙ্গে তাকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়।

২০১৭ সালের ২৯ অগাস্ট ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৬ এর বিচারক কে এম ইমরুল কায়েস এ রায় দেন।

আর জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও মিথ্যা তথ্য দেওয়ার মামলায় রানার মা মর্জিনা বেগমকে ছয় বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। কারাদণ্ডের পাশাপাশি তার সম্পদের ৬ কোটি ৬৭ লাখ ৬৬ হাজার ৯৯০ টাকা বাজেয়াপ্ত করেন বিচারক।

২০১৮ সালের ২৯ মার্চ জজ ইমরুল কায়েস এ মামলারও রায় দেন।

ঢাকার আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি আনোয়ারুল কবির বাবুল জানান, রানার বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলা ও মাদকের মামলাও বিচারাধীন।