বুধবার ফেইসবুক লাইভে সংবাদ সম্মেলন করে ‘শিক্ষক-চিকিৎসক-লেখক-গবেষক-শিল্পী সমাজ’র পক্ষ থেকে এ আহ্বান জানানো হয়।
সরকারের বিরুদ্ধে শৈথিল্য, অমনযোগিতার অভিযোগ তুলে মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, খাদ্য ও আশ্রয় সংস্থানের জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে জরুরি করণীয় ৮ দফা সুপারিশও তুলে ধরা হয়েছে সংবাদ সম্মেলনে।
তারা ৩ মাসব্যাপী ত্রাণ সরবরাহ, কর্মহীনদের নগদ অর্থ বিতরণ, গৃহহীন ও বসবাস অযোগ্য স্থানে বসবাসকারীদের সরকারি স্থাপনায় থাকার ব্যবস্থা, সব নাগরিকদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত এবং কৃষকদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান।
সংবাদ সম্মেলনে ৮ দফা সুপারিশের প্রস্তাবনা তুলে ধরেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।
তিনি বলেন, ‘আমরা লক্ষ্য করছি যে, যেসব দেশের সরকার এই ভাইরাস মোকাবিলায় ত্বরিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, নাগরিকদের ন্যূনতম খাদ্য, আশ্রয়ের সুরক্ষায় যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে এবং যেসব দেশে স্বাস্থ্যসেবা খাতের দৃঢ় ভিত্তি আছে, সেসব দেশই এই সঙ্কট মোকাবেলায় সাফল্য দেখিয়েছে।
“এই তিনটি ক্ষেত্রেই দুর্বলতা, শৈথিল্য, অমনোযোগ ও যথাযথ প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকার অভাবে বাংলাদেশ অনেক বেশি হুমকির সম্মুখীন। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধান, মতবিনিময়, দেশ-বিদেশের পরিস্থিতি ও গৃহীত পদক্ষেপ পর্যালোচনা করে, সতর্কতামূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি, স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে করণীয় বিষয়গুলো নির্ধারণ করে তা দেশের সর্বস্তরের মানুষ ও সরকারের কাছে উপস্থিত করছি।’
সংবাদ সম্মেলনে উন্নয়ন ও অর্থনীতির গবেষক মাহা মির্জা বলেন, “কোভিড ১৯ মোকাবেলা করতে গিয়ে আসলে আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থার গলদগুলো আমাদের চোখের সামনে চলে এসেছে।
“আমরা বহুদিন ধরে বলে আসছি শুধু হাজার হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্প তৈরি করলেই উন্নয়ন হয় না। মানুষের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও বাতাসের মত ন্যূনতম শর্তগুলো পূরণ করতে না পারলে কোটি কোটি টাকার মেগাপ্রকল্প মানুষকে বাঁচাতে পারবে না।”
তিনি বলেন, “আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব ১০ হাজার জনের জন্য মাত্র ৩ জন চিকিৎসক, ১ জন নার্স, ১ হাজার জনের জন্য মাত্র একটা হাসপাতাল বিছানা। আমাদের জাতীয় বাজেটের এক শতাংশেরও কম স্বাস্থ্যখাতে খরচ করা হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম।
“অথচ দু’শ মিলিয়ন ডলার খরচ করে চায়না থেকে সাবমেরিন কেনা হচ্ছে। রাশিয়ার সাথে ৮ হাজার কোটি টাকার অস্ত্র চুক্তি হয়েছে। কিন্তু এই করোনা পরিস্থিতির কারণে পটুয়াখালীর যে কৃষকের তরমুজটা নষ্ট হচ্ছে, সেটা ঢাকায় পরিবহন করার কোনো ইচ্ছা সরকারের নেই। কুড়িগ্রামের কৃষকের যে সবজিগুলো নষ্ট হচ্ছে সেগুলো কারওয়ান বাজার পর্যন্ত নিয়ে আসার প্রস্তুতি সরকারের নেই। আমাদের খাদ্যের পুরো সাপ্লাই চেইনটা আজ কলাপসড হয়ে গেছে।’
করোনাভাইরাস সঙ্কট মোকাবেলায় সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক তানজীম উদ্দিন খান।
তিনি বলেন, “প্রথম থেকেই স্বাস্থ্য সংক্রান্ত, রোগ সংক্রমণ সংক্রান্ত, অর্থনৈতিক মন্দা এবং সামাজিক বিশৃঙ্খলা সংক্রান্ত সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার দরকার ছিল। চারটা ঝুঁকিকে বিবেচনায় নিলে করোনা সঙ্কটের বহুমূখী চরিত্রগুলো মোকাবেলা করা যেত। একমুখী চিন্তা দিয়ে একে মোকাবেলা করা যাবে না।’
সংবাদ সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক মোশাহিদা সুলতানা, সংগঠক ফিরোজ আহমেদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সায়েমা খাতুন, প্রকৌশলী অনুপম সৈকত শান্ত। সংবাদ সম্মেলনটির সঞ্চালনায় ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সামিনা লুৎফা।
৮ সুপারিশ
>> কর্মহীন, স্বল্প আয়ের মানুষদের (মজুর, বেকার, ক্ষুদে ব্যবসায়ী) ঘরে ঘরে খাদ্যসামগ্রী, নগদ অর্থ ও ত্রাণ পৌঁছানো।
>> শিল্প ও প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক কর্মচারী, পেশাজীবীদের বকেয়া পরিশোধ করতে হবে, ছাঁটাই বন্ধ করতে হবে, ছুটিকালীন মজুরি দিতে হবে।
>> কোভিড-১৯ সহ সকল রোগের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে হবে। কোভিড-১৯ চিকিৎসায় জেলা-উপজেলা পর্যায়ে স্বতন্ত্র বিশেষায়িত হাসপাতাল ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রতি জেলায় ল্যাব স্থাপন করে টেস্টের সংখ্যা বাড়াতে হবে। ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। পর্যাপ্ত ও মানসম্মত পিপিই দিতে হবে। আবাসিক হোটেল, গেস্ট হাউজগুলোতে তাদের থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
>> কৃষক ও খামারিদের পণ্য বাজারজাতকরণ এবং যুক্তিসঙ্গত দামে বিক্রি নিশ্চিত করতে হবে। সরাসরি কৃষক ও খামারি থেকে সরকারের খাদ্যপণ্য ক্রয়ের পরিধি বাড়াতে হবে। কৃষককে স্বল্পসুদে দেয়া ঋণের পরিধি ও পরিমাণ বাড়াতে হবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সরকার, ব্যাংক ও এনজিও প্রদত্ত ঋণের সকল কিস্তি স্থগিত করতে হবে।
>> মহাদুর্যোগ মোকাবিলায় অবাধ তথ্য প্রবাহ এবং নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
>> দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে হবে, বাজারে খাদ্যদ্রব্য সহ প্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হবে। মজুতদার, চোরাকারবারিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ভেঙে ফেলতে হবে। সারাদেশের চালচোর, ত্রাণচোরদের কঠোর হস্তে দমন করতে হবে।
>> জাতীয় সক্ষমতা বিকাশে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ ও গবেষণা বাড়াতে হবে।
>> দীর্ঘমেয়াদে উন্নয়ন দর্শনে মৌলিক পরিবর্তন আনা অপরিহার্য। জনগণের জীবন ও নিরাপত্তাকেই উন্নয়নের প্রধান শর্ত হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।