ছোট ছোট টব ও পলিথিন ব্যাগের মাটির মধ্যে রোপন করা অনেক চারা গাছের সবুজ পাতা শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে; দেখলে মনে হবে যেন ‘গাছে দুর্ভিক্ষ’ লেগেছে।
বুধবার বেইলি রোড, বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল ও শিশু একাডেমীর পাশের ফুটপাতে নার্সারির চারা গাছগুলোতে ‘মৃত্যু যন্ত্রণার ভাষাহীন অভিব্যক্তিই’ যেন প্রকাশ পেয়েছে।
বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম প্রাঙ্গণে এম মনসুর আলী হ্যান্ডবল জাতীয় স্টেডিয়ামের দেয়ালঘেষে গড়ে উঠা নার্সারির কর্মী সোহেলও তুলে ধরলেন সেই পরিস্থিতি।
তিনি বলেন, “লকডাউনের কারণে স্টেডিয়ামের পানি সাপ্লাই বন্ধ। দেখেন, ঘাস জ্বইলা যাইতেছে, গাছে চারা মারা যাইতেছে। একটা গাছের চারা করতে কত পানি দিতে হয়, কত সার দিতে হয়, কত যত্ন করতে হয়- হেইডা আপনারে বুঝাইয়া কইতে পারমু না।
লকডাউনের আগের দিনও এই নার্সারিটিসহ রাজধানীর অন্যগুলো চেহারা ছিল ‘এক টুকরো নিসর্গ’। সবুজের ছোঁয়ায় যে কারো চোখ আটকে যেত রাস্তার পাশে নার্সারির টবে টবে সারি করে সাজিয়ে রাখা ফুল-ফল-ঔষধির চারার দিকে। গোলাপ, ক্যাকটাস, পাতাবাহার, অর্কিডের বর্ণিল রং, গাছের সৌন্দর্য মুগ্ধ করে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে। এই আকর্ষণ থেকেই বৃক্ষপ্রেমীরা নিজেদের বাড়ি-বাসার আঙিনা কিংবা ঘরের বারান্দায় গাছ লাগানোর জন্য চারা কিনে নিয়ে যান।
বেইলি ড্যাম্প অফিসার্স কোয়ার্টার্সের পাশেই ছোট একটা নার্সারি। পাশে ভিকারুন্নিসা নুন স্কুল ও কলেজ। ছোট এই নার্সারিতে ছোট-বড় ফুলের টবও বিক্রি হয়। শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের অনেকে এই নার্সারী থেকে নিয়ে যান বাহারি সব ফুলের চারা।
বুধবার গিয়ে দেখা গেল, সেই নার্সারি বন্ধ হয়ে আছে, পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে ফুলের টবগুলো। ফুটপাতের পাশে দেয়াল ঘেষা নার্সারিতে রয়েছে ২০০-৩০০ চারা; কিছু মাঝারি ধরণের গাছ-গাছড়া ওরয়েছে। এগুলোর বেশিরভাগই এখন মৃত্যুপ্রায়।
নার্সারির সামনের ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন বেইলি রোড়ের বাসিন্দা সরকারি কর্মকর্তা এসএম আমিন উদ্দিন। তিনি বললেন, “একটু লক্ষ্য করে দেখুন, শুধুমাত্র পানির কারণেই যে এই সব চারা গাছ মারা গেছে, সেটা তাদের চেহারাই ফুটে উঠছে- এটা সত্যিই বেদনার সংবাদ।”
বেইলি রোডের আশিয়ান-গুলফিশান অফিসার্স কোয়ার্টার্সেরন দেয়ালের পাশে রয়েছে আরেকটি নার্সারি। সেখানে গিয়ে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। নানা জাতের অর্কিডগুলো তার ফুলের পাঁপড়িতে রং ছড়াচ্ছে। গোলাপ, জুঁই, বেলি, পাতাবাহারসহ বিভিন্ন ফুলের চারা গাছ সারিতে সারিতে প্রাণবন্ত দেখাচ্ছে।
‘‘ আমরা সরকারি কোয়ার্টার্সের মধ্যে একটা টিনশেডে থাকতে পারি বলে নার্সারির গাছগুলো ঠিক আছে। তা না হলে বাড়িতে চলে যেতে হত।”
তিনি বলেন, “করোনার কারণে কোনো বিক্রি নাই, কষ্টের মধ্যে আছি। গত ২৬ দিনে একজনও আসেনি একটা চারা নিতে।”
ছিন্নমূল বৃদ্ধা জহুরা বলেন, “ফুটপাতে থাকি, নার্সারিগুলো বন্ধ। রাতে অনেকে নার্সারির পলিথিন তুইলা গাছের চারা চুরি কইরা নিয়া যায়।”
ফুটপাতের এই সব নার্সারি পাশেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের দৃশ্য ভিন্ন। সবুজ বাগানে নানা রঙের ফুলে বর্ণিল দেখাচ্ছিল পরিবেশ।
শিশু একাডেমীর নিরাপত্তা কর্মী রফিক বলেন, “সরকারি ছুটির কারণে নার্সারিগুলো বন্ধ। কেউই এখানে খাকে না। লম্বা বন্ধ থাকার কারণে গাছের চারা মরে যাচ্ছে।”
নার্সারি বন্ধে নিজের বেদনা কথা জানিয়ে নয়া পল্টনের বাসিন্দা মাহবুব উদ্দিন বলেন, “আমার বারান্দায় টবে বিভিন্ন রকমের ফুল গাছ রয়েছে। প্রতিদিন নিজেই এখন পানি দেই, টবের মাটি নিড়ানি দিয়ে দেই। কি সন্দুর গাছের জীবন।
“আজকে নার্সারি বন্ধ হওয়ায় সেখানে গাছের যে দুরবস্থার কথা আপনি শুনালেন আমি খুবই বেদনাহত হয়েছি। গাছ-গাছালি মানুষ না হলেও তাদেরও তো জীবন আছে। গাছের জীবনের সাথে মানুষের জীবন ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। গাছের দেয়াও অক্সিজেনে মানুষ বেঁচে থাকে।”
“লকআউটের কারণে আমি নোয়াখালী এসেছি। আমি জানি আমার দোকানের গাছের চারাগুলো অনেকগুলোরই এখন প্রাণহীন হয়ে গেছে। কি করব বলেন? পুলিশ অফিসাররা এসে বলে গেছেন, একটাও দোকানও খোলা থাকবে না, কেউ এখানে থাকতে পারবে না। নিরূপায় হয়ে চলে এসেছি।
“এই ব্যবসায় পুঁজি কম লাগে বলে কয়েক বছর ধরে এটা করছি। এই ব্যবসা করে আমি আনন্দ ও মানুষের ভালোবাসা দুইটাই পেয়েছি। অতি যত্ন দিয়ে নার্সারি চারাগুলো বেড়ে উঠার যে নির্মল আনন্দ সেটা বুঝিয়ে বলতে পারছি না। নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসার এই গাছের চারাকে। এই প্রাণের সবুজ গাছগুলো করুণ অবস্থা আমি অনুমাণ করতে পারছি কিন্তু কিছু করতে পারছি না। ঢাকায় আসতেও পারছি না।”