তাই তো নালন্দা স্কুলের প্রথম শ্রেণীর ছাত্রী রিসাত মাইনুন চৌধুরী রংতুলির ইচ্ছা হয় ঘরটাকেই স্কুল বানিয়ে ফেলতে।
শহরের ফ্ল্যাটবন্দি জীবনে শিশুদের মানিয়ে রাখতে বেগ হচ্ছে অভিভাবকদের। তারা বলছেন, স্কুল বন্ধ, খেলতে না পারা ও বন্ধুদের সঙ্গে দেখা না হওয়ায় প্রথমদিকে অনেক বিরক্তি দেখালেও এখন কিছুটা হলেও পরিস্থিতি বুঝতে পারছে শিশুরা।
পরিবর্তিত এই বাস্তবতায় পাল্টে গেছে শিশুদের জীবনঘড়িও। আগে যেখানে সকালে ঘুম থেকে হাত-মুখ ধুয়ে খাবার খেয়ে স্কুলে যেতে হত, এখন অনেকেরই ঘুম ভাঙছে বেলা করে।
সারা দিন ঘরের মধ্যে কিছু সময় লেখাপড়ার পর অফুরন্ত অবসরে টেলিভিশন দেখা, বাবা-মায়ের সঙ্গে খেলা ও দুষ্টুমিতে কাটছে তাদের সময়। আবার অনেকে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে স্মার্টফোনে, নানা ধরনের গেম খেলা ও কার্টুন দেখায়।
স্কুল বন্ধের এই সময় কেমন লাগছে জানতে চাইলে প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী রংতুলি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলে, “স্কুলে যেতে পারছি না। স্কুল কেমন ছিল সেটাও প্রায় ভুলে গেছি। গুগল ক্লাস করি। মনে হয় এই ঘরটাকে স্কুল বানিয়ে ফেলি।
“স্কুল বন্ধ থাকায় বন্ধুদের সাথে তো এখন দেখাও হয় না। ফোনে কল দিয়ে কথা বলি।”
মেয়েকে নিয়ে রংতুলির মা রিফাত মোবাশশেরা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রথম দিকে বিরক্ত করত খুব। এখন একটু অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। কারণ আমরা বাইরে যাচ্ছি না। স্কুলে যেভাবে পড়ায় আমরা সেভাবে পড়াই না দেখে একটু বিরক্ত হচ্ছে।”
মিরপুরের ঢাকা এডভেন্টিস প্রিসেমিনারি অ্যান্ড স্কুলের নার্সারির ছাত্র উসাইদ কবির ফাতিন।
ফাতিনের বাবা সাংবাদিক রিয়াদুল করিম জানান, স্কুল বন্ধের পর প্রথম দিকে কিছুটা বিরক্ত করত ফাতিন। প্রতিদিন বিকালে বাসার নিচে খেলতে যেতে জিদ করত। তবে আস্তে আস্তে পরিস্থিতি বুঝতে পারছে সে।
ফাতিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলে, “করোনাভাইরাস তো তাই বাইরে যাই না। বন্ধুদের সাথে দেখা হয় না। এখন দেখা করাও যাবে না।”
এদিকে ‘লকডাউন’ শব্দটির অর্থ নিজের মতো করে বুঝতে পেরেছে পল্লবীর অ্যাপ ট্রি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের গ্রেড ওয়ানের ছাত্রী তাহিয়া চৌধুরী মৃদিতা।
বাসায় কী কর জানতে চাইলে মৃদিতা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলে, “বাসায় খেলতে পারি না। বাসায় খাই, গোসল করি, পড়ি। বাবার আইপ্যাড দেখি। মাঝে মাঝে একটু একটু কার্টুন দেখি।
“স্কুলে যেতে মন চায়, করোনাভাইরাসের জন্য যেতে পারি না। বন্ধুদের ফোন নম্বর জানি না। থাকলে কথা বলতাম। এখনও তো লকডাউন।”
লকডাউন কী জানতে চাইলে সে বলে, “এই যে ঘরে আছি এটাই লকডাউন।”
করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে বিশ্বের অধিকাংশ দেশে এখন মানুষের ঘর থেকে বেরোনো সীমিত হয়ে গেছে, বন্ধ হয়ে গেছে কল-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বাইরের কাজকর্ম।সীমিত হয়ে গেছে সব ধরনের যানবাহন, নৌযান ও বিমান চলাচল। এই পরিস্থিতিকে বলা হচ্ছে লকডাউন।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়তে থাকায় গত ২৬ মার্চ থেকে সরকারি ছুটি ঘোষণার পাশাপাশি লকডাউন চলছে। তবে তারও প্রায় দুই সপ্তাহ আগে ১৪ মার্চ থেকে স্কুল-কলেজসহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয় করোনাভাইরাস সংক্রমণের আতঙ্কে।
এই অবস্থায় শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পোষাতে সংসদ টেলিভিশনে ক্লাস চালু করেছে সরকার। তবে ওই ক্লাস বুঝতে সমস্যা হচ্ছে বলে জানিয়েছে বাগেরহাটের সপ্তম শ্রেনির শিক্ষার্থী নুসরাত ইসলাম তৃষা।
সে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলে, “বাসাতেই বসে থাকি। বই পড়ছি। টেলিভিশনে ক্লাস হয় সেটা দেখি। বুঝতে একটু অসুবিধা হয়। এখানে তো স্যারকে প্রশ্ন করতে পারছি না।”
ঘরবন্দি এই দশা মেনে নিতে চায় না মোহাম্মদপুর সংলগ্ন ঢাকা উদ্যানে গৃহশ্রমিক মায়ের সঙ্গে থাকা শিশু পারভেজ হোসেন।
পারভেজ বলে, “মাদ্রাসায় অনেক বন্ধু। একলগে ফুটবল ক্রিকেট খেলতাম। এহনতো মা খ্যালতে দেয় না।”
ঘরে বসে কী কর জানতে চাইলে সে বলে, “হুজুর পড়া দিছে সেইগুলান করি। আর মুবাইলে নাটক দেখি। মামা মায়ের মুবাইলে নাটক লুড (ডাউন লোড) কইরা দেয়।”
পারভেজের মা সালমা খাতুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সারা দিন চউখ্যে চউখ্যে রাখতে হয়। খালি বাড়ির বাইরে যাবার ধান্দা করে। এমুন সময় বাইরাতে দেওন যায় না। একছের বিরক্ত করে।”
এ সময়ে শিশুদের সঙ্গে রাগারাগি না করে তাদের সময় দেওয়া ও বোঝানোর পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহফুজা খানম।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখানে অভিভাবকদের বোঝাতে হবে, কেন তারা বাসায় আছে। তাদেরকে তাদের মতো করে বোঝাতে হবে। বাচ্চারা বুঝতে পারলে ওরা মেনে নেয়।”
সময়টাকে শিশুর শিক্ষার কাজে লাগানোরও পরামর্শ দিয়ে এই অধ্যাপক বলেন, “এখন একটা বড় সুযোগ হচ্ছে, বই পড়ার অভ্যাস করানো। যারা পড়তে পারে, বুঝতে পারে তাদের উপযোগী বই পড়তে দিতে হবে। একদম ছোটদের ছবি আঁকার চর্চা করানো যেতে পারে।”