‘যান আর জন’ চলাচলে কড়াকড়ি থাকার পরও শুধু পেটের দায়ে কিছু মানুষ রিকশা নিয়ে ঠিকই বের হন। কিন্তু যাত্রী কই? সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাগড়াও তো আছে। সবমিলিয়ে দিনশেষে যা আয় হয় তার চেয়ে ঢের বেশি হা-হুতাশ নিয়ে ফিরতে হয় তাদের।
সোমবার সকালে ঢাকার মৌচাক মোড়ে দেখা গেল পুলিশ সদস্যরা উল্টিয়ে রেখেছেন বেশকিছু রিকশা। আশপাশেই ছিলেন চালকরা। নিষেধাজ্ঞা না মেনে রাস্তায় বের হওয়ার সাজা। বর্তমান অবরুদ্ধ দশার খুবই পরিচিত দৃশ্য। সেখানে কথা হল আরজ আলী নামের এক চালকের সাথে।
অসহায় এই প্রৌঢ় বলেন, “বাবাজি, পেটের খিদার লাইগা হেই বেয়াইন (সকাল) বেলা রিকশা নিয়া বাইর হইছি। এখন বাজে সাড়ে ১০টা, মাত্র ৫০ টাকা কামাই করছি। এই মৌচাকে একটা খ্যাপ নিয়া আইছি, এমন সময় পুলিশ ধরছে, রিকশাটারে উল্টাইয়া রাখছে।”
টাঙ্গাইলের জব্বার সকালে পান্তা খেয়ে রিকশা নিয়ে বেরিয়েছেন। কিন্তু কামাই-রোজগারের যে অবস্থা দুপুরে কপালে কী জুটবে, তা নিয়ে চিন্তায় আছেন তিনি।
“গ্রামের কাজের অভাব, শহরে আইসাও বিপদে পড়ছি। সকালে পান্তা ভাত খাইছি, দুপুরে কী খামু জানি না। এই পর্যন্ত কামাই হয়েছে মাত্র ৮০ টাকা।”
মালিবাগ রেল গেইটের কাছে বস্তিতে স্ত্রী-দুই মেয়েকে নিয়ে থাকেন রহিম। দুইদিন ধরে ঘরে চাল-ডাল নেই। বাধ্য রাস্তায় নেমেছেন রিকশা নিয়ে।
রহিমের প্রতিদিন আয় হয় ১০০-২০০ টাকা। তবে পরিস্থিতিরে কারণে মালিকের জমা দিতে হয় কম। কিন্তু সোমবার পুলিশের হাতে পড়ে অনেকক্ষণ বসে থাকতে হয় তাকে।
“একটু কইয়া ছাড়াইয়া দেন না স্যার,” আরজ আলীর মতো রহিমও অনুরোধ করেন।
মৌচাকের মোড়ে এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে নগরবাসীকে ঘরে থাকতে বলা হয়েছে। এজন্যই তারা রাস্তায় যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করছেন।
মালিবাগ রেলগেইট এলাকায় বেলা ১২টার দিকে ১০-১২টি রিকশা আর তিনটি ব্যাটারিচালিত রিকশা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
সেখানে রিকশাচালক কলিমুল্লাহ বলেন, “সকাল ৮টা থেইকা ১২টা পর্যন্ত স্যার তিনটা খ্যাপ মারছি। অর্ধেক দিন বাকী আছে। মালিকরে দিতে হইব ১৩৫ টাকা। কেমন চলমু পোলাপান নিয়া?”
কলিমুল্লাহ জানান, মাসখানেক আগেও সকাল ৮টা থেকে ১২ পর্যন্ত সময়ে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা রোজগার করা গেছে।
সকাল ১১টায় শান্তিনগর মোড়ে গত কয়েকদিনের তুলনায় রিকশা একটু বেশিই দেখা গেল। তবে অধিকাংশই যাত্রীশূন্য।
রিকশাচালক করিম মিয়া বলেন, “খ্যাপ পাই না। অটো (বাটারিচালিত) রিকশার ডিমান্ড বেশি। দুই-একটা খ্যাপ যাও পাইতাম, তাও আবার অটোরিকশা দেখলে প্যাসেঞ্জার উঠতে চায় না। এই এক যন্ত্রণা।”
করিমের ভাষ্য, শুধুমাত্র পেটের জন্য রিকশা চালাচ্ছে। একদিন উপার্জন না করলে পরিবার নিয়ে অন্ধকারে তাকে থাকতে হয়।
ত্রাণ পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে বলেন, “দুই সাপ্তাহ আগে প্লাস্টিকের একটা ব্যাগে কিছু চাইল-ডাইল-আলু পাইছি। আর কোনো ত্রাণ-ট্রাণ পাই না। কেউ আমাগো ত্রাণ দেয় না।”
হোসেন বলেন, “সকালে লম্বা খ্যাপে সদরঘাট থেকে নতুন বাজার গেছি। আবার ফিরতি খ্যাপে দৈনিক বাংলা মোড়ে। কামাই মোটামুটি। তয় ভয় লাগে আর্মি-পুলিশ দেইখা। কারণ রাস্তায় অটো বাইর করা নিষেধ। কিন্তু কি করমু, পেটের জন্য নামছি।”
রিকশাচালকদের কষ্টটা খুব অনুভব করেন মতিঝিল ব্যাংক কলোনির বাসিন্দা সাব্বির হোসেন।
বললে, “রিকশাচালকদের দেখলে খুবই খারাপ লাগে। গত কয়েকদিনের তুলনায় আজকে রিকশা চলাচল একটু বেশি। কিন্তু খালি রিকশা। দেখলে মনে হবে, কষ্ট নিয়ে ওরা ঘুরছে যাত্রীর আশায়। যাত্রী তো সব ঘরে বন্দি।
“আপনি একটু চিন্তা করুন, রাস্তা খালি, রিকশাচালকরা যাত্রী খুঁজছে। আসলে আমরা একটা কঠিন সংকটের দিকে ধাবিত হচ্ছি। কী যে হবে জানি না।”