করোনাভাইরাসে রূপালয়ে বিরূপ প্রভাব

করোনাভাইরাস সঙ্কটে প্রায় অবরুদ্ধ রাজধানীতে রূপ পরিচর্যার কেন্দ্রগুলোতে আঁধার নেমেছে। দুই সপ্তাহ ধরে বন্ধ রয়েছে অধিকাংশ সেলুন, বিউটি পার্লারগুলোও খুলছে না।

সুমন মাহমুদ জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 April 2020, 04:43 AM
Updated : 10 April 2020, 04:43 AM

কাকরাইলের শীতাপত নিয়ন্ত্রিত ‘উইমেনস ওয়ার্ল্ড’ ১৫দিন আগেও গমগম করত; এখন তা রয়েছে বন্ধ।

ওই প্রতিষ্ঠানের পাহারাদার আনসার আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পার্লার বন্ধ, ম্যাডামরা কেউ এখন আর আসেন না।”

নয়া পল্টনের বাসিন্দা নাসরিন আবা হোসেনের নিজের একটি পার্লার আছে, সেটাও এখন বন্ধ।

“করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়েছে পার্লারের উপরও। কিছু করার নেই, পুরো ওয়ার্ল্ডই তো এখন অ্যাবনরম্যাল,” বলেন তিনি।

নাসরিন বলেন, “আমাদের দেশের পার্লারগুলো চলে অনুষ্ঠানের উপর। মেয়েদের সাজ-গোজ হচ্ছে অনুষ্ঠানকেন্দ্রিক। এখন বিয়ে নেই, অন্য কোনো অনুষ্ঠানও নেই। সেজন্য পার্লার খোলা রেখেও লাভ নেই।”

তাছাড়া সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার যে নির্দেশনা, তা পালন করতে গেলে পার্লারের কাজ চালানো মুশকিল বলে জানান তিনি।

“পার্লারের কাজটা খুবই সেনসিটিভ এবং কাছাকাছি থেকে করতে হয় নিখুঁতভাবে। করোনাভাইরাস সংক্রামণ থেকে বাঁচতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার যে একটি বিষয় আছে, সেটা মেনে চলা খুবই কঠিন।”

সার্বিক পরিস্থিতিতে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নাসরিন বলেন, “যে দীর্ঘ শাটডাউন চলছে, তাতে এই ব্যবসা সচল রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। এটা আমাদের জন্য দুঃশ্চিন্তার।”

গত ২৬ মার্চ থেকে অবরুদ্ধ দশা শুরুর পর চুলকাটার কারিগর-নাপিতদের অধিকাংশই ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়ায় সেলুনগুলো খুলছে না।

ফকিরেরপুলের গরম পানির গলির মোড়ে রয়েছে কয়েকটি সেলুন। ১৫ দিন আগেও এসব সেলুনে চুল কাটার জন্য ভিড় লেগে থাকত। এখন চিত্র ভিন্ন।

ঘনবসতিপূর্ণ এই এলাকার বাসিন্দরা অধিকাংশ ব্যাচেলর ভাড়াটিয়া। তারা সেলুনেই দাড়ি কামানো

কিংবা চুল কাটানো, কলপ দেওয়ার কাজটি করান।

ফকিরেরপুলের এক মুদির দোকানের মালিক আমিনুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘চুল কাটার দোকান-পাট বন্ধ থাকায় মানুষজনকে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এগুলো তো মানুষের দৈনন্দিন জীবনে পরিচ্ছন্নতার একটি অংশ। এটা জরুরি বিষয়।

“আপনি যদি প্রতিদিন শেইভ করে থাকেন, আর এখন কয়েকদিন শেইভ না করে থাকতে হয়, তাহলে আপনার মন ভালো থাকবে না, চুল না কাটালে উশকো-খুশকো দেখাবে। এটাই স্বাভাবিক।”

চলমান লকডাউনে রাজধানীর ঘরবন্দি অনেকে শেইভ না করে দাড়ি রেখেছেন, মাথার চুলও বড় হয়ে গেছে অনেকের।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে মামুন খান নামে একজন বেসরকারি ফার্মের কর্মকর্তা শেইভ না করার চেহারা পোস্ট করে লিখেছেন, “আমি ঘরবন্দি হয়ে আছি। সেলুন বন্ধ থাকায় চুল কাটাতে পারছি না। এই অবস্থা আর কতদিন চলবে?”

মালিবাগ, শান্তিবাগ, শান্তিনগর, নয়া পল্টন, ফকিরেরপুল, বিজয়নগর, তোপখানা রোডের বিভিন্ন জায়গায় সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঘুরে কোথাও একটি সেলুনও খোলা দেখা যায়নি।

গুলবাগের গলির ভেতরে একটি সেলুন খোলা দেখা গেছে। এই সেলুনের মালিকও বাড়ি গিয়েছিলেন, কিন্তু ফিরে এসেছেন।

তিনি বলেন, “গ্রামের বাড়িতে ভালো লাগে না, অনেক কষ্ট করে ঢাকায় আসছি। দোকান খোলা নিষেধ, একটু করে খুলেছি যাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী টের না পায়।”

কেনো সেলুন খোলা রাখা যাচ্ছে না- প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “ভাই, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে আপনাকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। সেলুনে এই বিধি মেনে চলা খুবই কঠিন। সেজন্য সেলুনও খোলা রাখা যাচ্ছে না।”

ঢাকা মহানগরীতে দেড় কোটির বেশি মানুষের বসবাস। এখানে চুল কাটানোর অসংখ্য দোকানের পাশাপাশি রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সেলুন।

সেলুন বন্ধ হওয়া হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন নরসুন্দররাও।

ফকিরেরপুলের অমলেশ বলেন, “সেলুন বন্ধ হওয়ায় আমরা কষ্ট আছি। একেবারে বেকার বসে আছি, কোনো কামাই নাই। পেটে আগুন পুড়ছে। কবে যে সেলুন খুলবে কে জানে?”

মালিবাগের রেলগেইট বাজারে রেল লাইনের পাশে ঝুপড়ির ভেতরে দুটি চেয়ার এনে চুল কাটতে দেখা গেল গোপাল চন্দ্র ও অনিল চন্দ্র নামের দুই কারিগরকে।

গোপাল চন্দ্র বলেন, “স্যার সেলুনের দোকান খোলা নেই। এখানে অস্থায়ীভাবে কাজ করছি। কী করব, কাজ ছাড়া আর এভাবে চলতে পারছি না।”

গোপাল ও অনিলের এই ঝুপড়িতে ১১টা থেকে ১২টা পর্যন্ত দুটি শিশু, একজন বৃদ্ধকে চুল কাটাতে দেখা গেছে। এছাড়া লাইনে ছিলেন তিনজন।

চুল কাটিয়ে হাফিজুর রহমান বলেন, “কোনো সেলুন খোলা নেই। বাজার করতে এসে গোপালকে পেলাম। চুলটা কাটিয়ে নিলাম। যে গরম পড়েছে, চুল না কাটতে পেরে কয়েকদিন একটা অস্থিরতার মধ্যে ছিলাম।”