অবসরের দিনলিপিতে বন্দিত্বের ছায়া

কর্মময় জীবন পেরিয়ে বয়সের বিচারে অবসরের গণ্ডিতে ঢুকেছেন যারা, নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব তাদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টির পাশাপাশি প্রাত্যহিক জীবনকেও করেছে অবসাদগ্রস্ত।

ফয়সাল আতিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 April 2020, 03:44 AM
Updated : 6 April 2020, 03:44 AM

নাতি-নাতনি ও স্বজনদের সঙ্গে আনন্দ-আলাপ, সমবয়সীদের সঙ্গে আড্ডা, নিয়মিত প্রার্থনা আর শরীর চর্চাসহ একটা নির্দিষ্ট কর্মসূচি ধরে যে প্রবীণরা এতদিন চলছিলেন, একমাস ধরে তা থমকে আছে।

বিশ্বে মহামারী রূপ নিয়ে আসা করোনাভাইরাসে বয়সীদের মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি হওয়ায় এই প্রবীণদের ঘরের একটি নির্দিষ্ট কক্ষে দিনরাত অবস্থান করতে হচ্ছে, মন চাইলেই মিলছে না স্বজনদের সাক্ষাৎ।

লকডাউনের এই পরিস্থিতিতে স্বজনদের নিয়ে ঘরোয়া আয়োজনের গণ্ডিও ছোট হয়ে গেছে তাদের।

ঢাকার আদাবরের বাসিন্দা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সানলাইফ ইনস্যুরেন্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসআর খান তার জীবনের আশিটি বছর অতিক্রম করেছেন বেশ ভালোভাবেই। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের আগে সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা অবধি নিজের ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন তিনি। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পরামর্শ দেওয়া কিংবা ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানিক বিমা প্রস্তুত করা ছিল তার দৈনন্দিন ব্যস্ততা।

এসব ছেড়ে একমাস ধরে নিজের বাসায় অবস্থান করলেও আতঙ্ক ও শঙ্কা পিছু ছাড়ছে না তার।

এসআর খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার অনেক বয়স হয়েছে; রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও আগের মতো নেই। এমন ভাইরাসে আমার খুব সহজে কাবু হয়ে যাওয়া খুব স্বাভাবিক।

“এই ভয়াবহ ভাইরাসের কারণে ডাক্তারদেরও কর্মক্ষত্র ত্যাগ করতে শোনা যাচ্ছে। আমি বৃদ্ধ মানুষ, এখন অন্য কোনো সমস্যা হলে তার কোনো চিকিৎসা পাওয়াও কঠিন হয়ে যাবে। এসব ভেবে ভেবে মনের মধ্যে একটা শঙ্কা কাজ করে।”

বাসায় দুটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা রাখতেন। ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কায় তা বন্ধ করে দিয়েছেন। টেলিভিশনের খবর আর ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করে সময় কাটে এখন। দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা স্বজনদের সঙ্গে টেলিফোনে কথাও বলেন তিনি।

“আগে প্রতিদিনই নাতি-নাতনিদের কারও না কারো সাথে দেখা হত। এ বয়সে তারাই আমার আনন্দের খোরাক। কিন্তু এখন কারও সাথেই দেখা করছি না।”

রাজধানীর ফার্মগেইটে ইন্দিরা রোডের বাসিন্দা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাজী আব্দুল মোতালেব।

২০১৭ সালে তিনি কর্মজীবনের ইতি টানলেও বাসার কাছে খামারবাড়িতে অফিস হওয়ায় নিয়মিত পুরনো সহকর্মীদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে সময় কাটাতেন। মসজিদে যেতেন, ওই এলাকার সমবয়সীদের সঙ্গে পার্কে, উদ্যানে শরীর চর্চা চলত তার।

গত মার্চের শুরু থেকে জীবনের রুটিন থেকে এই সব ব্যস্ততা বাদ দিয়েছেন তিনি। এক মাস প্রায় বাসার চার দেওয়ালের মধ্যেই পার হয়েছে তার।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জীবনে আমি কোনোদিন এভাবে থাকিনি। সব সময় বাইরে ঘোরাফেরা করে বেড়িয়েছি। এই বন্দি জীবন আর ভালো লাগছে না।

“জীবনে কখনও জেল খাটিনি। এখন এর চেয়েও কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে আছি। কী যে মানসিক চাপের মধ্যে আছি তা প্রকাশ করার ভাষা নেই।”

তবে ঘরবন্দি হলেও স্ত্রী, দুই মেয়ে, এক ছেলে ও এক মেয়ের জামাই ঘরে থাকায় নিঃসঙ্গতা নেই এই প্রবীণের জীবনে। পরিবারের সব সদস্য বাসায় অবস্থান করলেও চাকরির সুবাদে এক মেয়ে ও মেয়ের স্বামীকে মাঝে মধ্যে বাসার বাইরে যেতে হচ্ছে; যা তার আরেকটি দুঃশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

“ঘরে থেকেও নিরাপদ বোধ করছি না। এই অদৃশ্য ভাইরাস কখন কীভাবে ঘরে চলে আসে, তা তো বলা যাচ্ছে না। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ দেখেছিলাম। তখন লড়াইটা হয়েছিল চেনা শত্রুর সঙ্গে। এখনকার পরিস্থিতি তার চেয়েও ভয়ঙ্কর। কারণ এই শত্রুকে দেখা যাচ্ছে না, এর নেই কোনো প্রতিষেধক,” বলেন মোতালেব।

প্রবীণ বন্ধু নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হিসাবে দেশে ৬০ বছরের বেশি বয়সী এক কোটি ৩০ লাখ নাগরিক রয়েছেন।

গত ৮ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত দেশে ৭১ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৮ জনের, যাদের প্রায় সবার বয়সই ৬০ বছরের বেশি।

যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিডিসির এক হিসাবে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত ৪ হাজার ২২৬ জনের মধ্যে ৮০ শতাংশের বয়স ৬৫ বছরের বেশি।

মিরপুরের ৭২ বছর বয়সী ফরিদা বেগম দুই ছেলে ও ছেলের বউকে নিয়ে নিজের বাসায় থাকেন।

স্বাভাবিক সময়ে মাঝেমধ্যেই কেনাকাটা করতে বেরুতেন। প্রায় প্রতি শুক্রবারই ভাইবোনদের বাসায় গিয়ে সময় কাটাতেন। কিন্তু করোনাভাইরাস সেই জীবনের ছন্দপতন ঘটিয়েছে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বাইরে যেতে পারছি না। বারান্দা দিয়েই আশপাশ দেখছি আর টিভি দেখে খবরাখবর নিচ্ছি।

“পাশেই মেয়ের বাসা, ও প্রায়ই আসতো। এখন তো আসতে পারছে না। নিজেও কোথাও যেতে পারছি না। দমবন্ধ লাগছে, কতদিন এভাবে চলবে জানি না।”

নিজেকে নিয়ে সন্তানদের শঙ্কার কথা তুলে ধরে এ বৃদ্ধা বলেন, “ছেলেমেয়েরা আমাকে নিয়ে বেশি ভয় পাচ্ছে। একটু শরীর খারাপ লাগলেই ছেলেরা টেনশন করছে।”

অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি চাকুরে ষাটোর্ধ্ব আক্তার হোসেন জানান, বাসার বিল দেওয়া, মসজিদে নামাজ পড়া, বাজার করা, প্রতিবেশীদের সাথে সময় কাটানো- এভাবেই তিনি দিন কাটাতেন। এখন অনেকটা ঘরে বন্দি হয়ে পড়েছেন তিনি।

“আগে তো ঘরে বসে খেলা দেখতাম। এখন সেটিও নেই। হাইলাইটস দেখাও বোরিং হয়ে উঠেছে। করোনায় আক্রান্ত না হয়েই অর্ধেক অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। আগে নাতি-নাতনীরা আসতো, কিন্তু এখন ভিডিওকলে টুকটাক কথা হয়।"

ডায়াবেটিস থাকায় সকাল-সন্ধ্যা নিয়মিত হাঁটতে বেরুতেন মালিবাগের এই বাসিন্দা। ভাইরাসের কারণে সেটাও থেমে আছে।

“কতদিন যে এভাবে চলতে হবে, সেই ভয়ে আছি,” অস্বস্তির ঝরে তার কণ্ঠে।

গ্রামের চিত্রও ভিন্ন নয়

৬৮ বয়সী মহসীন আলী চৌধুরী ও ৬২ বছর বয়সী সেলিনা আক্তার থাকেন রংপুর সদরেই। প্রায় মাস খানেক ধরে ঘরবন্দি জীবন কাটাচ্ছেন তারা।

এই দম্পতির ছেলে সিরাজুস সালেকীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের বাসার তৃতীয় তলায় থাকেন বাবা-মা। তাদের হাঁটাহাঁটি বাধ্যতামূলক। বাবার হার্টে তিনটা ব্লক, এজন্যে রোজ বাইরে হাটতেন তিনি। দুজনকে নিয়ে আমাদের দুঃশ্চিন্তার শেষ নেই।

“সন্তান ও অন্যদের সঙ্গে নিয়মিত ফোনে যোগাযোগ হচ্ছে। টেলিভিশন দেখে, বাসার ভেতরে হাঁটাহাটি করে তাদের সময় কাটাতে হচ্ছে।”

বাসায় ভাড়াটিয়াসহ আত্মীয়দের আসা-যাওয়া বারণ রয়েছে। এমন কি নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য দরকার হলে ফোনে জানানো হয়, দোকানদার বাসায় পৌঁছে দেন।

৬৮ বছর বয়সী আবুল কাশেম চৌধুরী স্ত্রী ষাটোর্ধ্ব জান্নাতুল ফেরদৌসকে নিয়ে সন্তানের সঙ্গে চট্টগ্রাম শহরে থাকেন ।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সন্তানরা বাইরে  না যেতে অনুরোধ করেছে; নিজের নিরাপত্তার জন্য বাইরেও যাচ্ছি না। হাঁটাহাঁটি ও নামাজের জন্য বের হতাম; সেটাও বন্ধ এখন। বাসার ভেতরেই সেরে ফেলি এসব।”

তাদের সন্তান আমিরুল হক বলেন, “বাবা-মায়ের শরীর ভালো রাখা নিয়ে আমাদের চিন্তা সব সময়। নিয়মিত অনেক ধরনের ওষুধ খেতে হয়। এখন দরকার পড়লে মোবাইলে ডাক্তারের পরামর্শ নিচ্ছি; তাদেরকে বের হতে বারণ করেছি। আমরাও স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলছি; বাসায় আত্মীয় স্বজনের আনাগোনাও সীমিত করে ফেলেছি।”

কমাতে হবে মনের চাপ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আজিজুর রহমান মনে করেন, ঘরের মধ্যেই ব্যস্ত থেকে মনোচাপ দূর করতে পারেন প্রবীণরা।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই সময়ে বয়স্কদের ইতিবাচক চিন্তাভাবনা করতে হবে। বই পড়ার অভ্যাস থাকলে বই পড়ে সময় কাটাতে পারেন। অনলাইনে খবর পড়তে পারেন। টেলিভিশন দেখতে পারেন। ফোনে পরিচিতজনদের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারেন।

“একে অপরকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। যারা সুস্থ আছেন তারা অসুস্থদের মানসিকভাবে সহযোগিতা করতে পারেন। রোগটি সম্পর্কে অন্যদের সচেতন করতে পারেন।”

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব যত দীর্ঘ হবে, ততই মানুষের শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক ও মানসিক চাপ বাড়বে বলে মনে করেন এই মনোবিজ্ঞানী।

৬৮ বছর বয়সী সাবেক এই শিক্ষক বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে বয়স্করা যে সময়ের মধ্যে যাচ্ছেন, তিনি নিজেও তা পার করছেন। তার থেকে তিন বছর কম বয়সী স্ত্রী ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন।

“অন্যদের মতো আমাদের সময়গুলোও হতাশায় কাটত। কিন্তু আমরা তা এড়াতে পারছি, কারণ পাশের ফ্ল্যাটে মেয়ে থাকে। তার পরিবারের সাথে সময় কেটে যাচ্ছে।

“কিন্তু যেহেতু বাসায় আমরা দুইজন থাকি, সে কারণে আমরা সকালে নিয়ম করে অনলাইনে খবর পড়ি। দুইজন একসাথে বসে সময় কাটাই। চা খাই, গল্প করি। ফোনে আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধবদের খবর নেই। অন্যরাও এভাবে নিজেদের মত করে সময় ভাগ করে নিলে, মানসিক চাপ কাটিয়ে ওঠতে পারবে।”