‘ঘরবন্দি’ শিশুদের চাই মনের খোরাক

বৈশ্বিক মহামারী নভেল করোনাভাইরাস আতঙ্কে স্কুল-কলেজের পাশাপাশি বাইরের জীবন বন্ধ হওয়ায় বদলে গেছে রাজধানীসহ সারা দেশের বাসা-বাড়িতে এক রকম বন্দি হয়ে পড়া স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের জীবন-চিত্র।

সুমন মাহমুদও কাজী নাফিয়া রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 March 2020, 11:39 AM
Updated : 3 April 2020, 01:56 PM

কয়েক দিন আগেও সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে নাস্তা করে স্কুল-কলেজে যাওয়া, সেখান থেকে ফিরে এসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম, তারপর বিকালে খেলাধুলা অথবা টিভি দেখা, সন্ধ্যায় আবার লেখাপড়ার টেবিলে বসা এবং কিছুক্ষণ টিভি দেখে আবার ঘুমাতে যাওয়া ছিল শিশুদের রুটিন।

এর মধ্যে বন্ধু-সহপাঠীদের সঙ্গে দেখা, ভাবের আদান-প্রদানে কেটে যাচ্ছিল শৈশব-কৈশোরের প্রাণচঞ্চল দিনগুলো। সেখানে হঠাৎ ছন্দপতন অতি সংক্রমক করোনাভাইরাস আতঙ্কে। এই ভাইরাস সংক্রমণ থেকে সুরক্ষায় সপ্তাহখানেক ধরে ঢাকাসহ সারা দেশের স্কুল-কলেজ বন্ধ রয়েছে, তার সঙ্গে ১০ দিনের সরকারি ছুটি ঘোষণায় অফিস-আদালতের পাশাপাশি বিপণিবিতান, দোকান-পাট সব কিছুই বন্ধ।

এখন ভাইরাস সংক্রমণ থেকে বাঁচতে বড়দেরই থাকতে হচ্ছে ঘরের ভেতর, শিশুরাও আরও আগে থেকে। প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থী অনেকটাই ঘরবন্দি হয়ে আছে। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থী পৌনে দুই কোটির মতো, আর মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী এক কোটির উপরে।

এই ঘরবন্দি জীবন শিশুদের ওপর মানসিক চাপ তৈরির পাশাপাশি তাদের শারীরিক বিকাশও ব্যাহত করছে বলে সতর্ক করেছেন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। শিশুদের জন্য ঘরের মধ্যে লেখাপড়ার চালিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি আনন্দদায়ক বিভিন্ন খেলা ও অন্যান্য কাজের ব্যবস্থা করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে সব এখন ছুটিতে। সবাইকে ঘরে থাকতে বলা হলেও বাসার গলিতে ক্রিকেটে মেতেছে শিশুরা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

এদিকে শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনায় রেখে ‘সংসদ টেলিভিশন চ্যানেলে’ রোববার থেকে  ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির ক্লাস ‘আমার ঘর, আমার স্কুল’-এর সম্প্রচার শুরু হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) এটা পরিচালনা করছে। এখানে শিক্ষার্থীদের বিষয়ভিত্তিক লেকচারের পাশাপাশি তাদের বাড়ির কাজ দেওয়া অর্থাৎ হোম ওয়ার্ক দেওয়া হবে।

যেভাবে কাটছে শিশুদের সময়

সারা দিন ঘরের মধ্যে থাকা শিক্ষার্থীদের অনেকের দৈনন্দিন রুটিনে যোগ হয়েছে লেখা-পড়ার সময়সূচি। অনেক ঘরের অভিভাবকরা এখন বাড়তি নজর রাখছেন তাদের ছেলে-মেয়েদের ওপর। ঠিকভাবে লেখাপড়া করছে কি না, স্কুলের সিলেবাস অনুযায়ী হোমওয়ার্ক কতটুকু হচ্ছে-ইত্যাদি নানা কিছু।

রাজধানীর মগবাজার, পশ্চিম মালিবাগ, এলিফ্যান্ট রোড, নয়া পল্টন ও কমলাপুরের সরকারি কলোনী এলাকার বাসা-বাড়ির অভিভাবকদের সঙ্গে আলাপ করে এই চিত্র পাওয়া গেছে।

মগবাজারের ডাক্তার গলির ৫/এ অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দা হাবিবুল্লাহ সিরাজী স্ত্রী, দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে বসবাস করেন। দুই ছেলে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার এবং মেয়ে ভিকারুন নিসা নূন স্কুলে পড়ে।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “করোনাভাইরাসের কারণে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। বাসায় এভাবে বন্দি থেকে ওরা হাঁপিয়ে উঠেছে। স্কুলের পড়ালেখায়ও তাদের মন বসে না। মে-জুন মাসে হাফইয়ারলি পরীক্ষা। কিন্তু স্কুল বন্ধ হয়ে ওদের লেখাপড়ার ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু কিছু করারও নেই, বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের ছোবল …।”

হাবিবুল্লাহ বলেন, “আমি আমার ছেলে-মেয়ের জন্য হোম স্কুল খুলেছি। প্রতিদিন সকালে তিন ঘণ্টা এবং সন্ধ্যায় দুই ঘণ্টার হোম স্কুল বসে। শিক্ষক আমি ও আমার স্ত্রী। কিছুটা হাসি-খুশি, বিরতি দিয়ে তাদের সিলেবাস ধরে লেখাপড়ার কাজটা যেটা স্কুলে হয়ে থাকে সেটা করার চেষ্টা করছি। এছাড়া তো কোনো পথও নেই।”

মা ফরিদা খানম বলেন, “স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়েছে ছেলে-মেয়েদের নিরাপত্তার জন্য। তবে তাদের শিক্ষাবর্ষ তো আর থেমে থাকবে না। সেজন্য প্রত্যেক অভিভাবকের উচিত হবে নিজের ঘরেই ছেলে-মেয়েদের একটু সময় দেওয়া।”

ক্ষুদ্র মুদি দোকানের মালিক আবদুল আলীম পরিবার নিয়ে থাকেন গুলবাগে টিনশেডের একটি ভাড়া বাসায়। তার এক ছেলে এক মেয়ে।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাসায় বাচ্চারা পড়া-লেখা করতে চায় না। ভীষণ চিন্তায় আছি ভাই। ওরা খালি খেলাধুলা আর মোবাইলে গেইম খেলতে চায়।

মহামারীর দিনে ঘরবন্দি জীবন। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

“স্কুল তো আজ হোক, কাল হোক খুলবে তখন কী হবে- এটা বাচ্চাদের বার বার বলছি। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না।”

এলিফ্যান্ট রোডের এ্যারোপ্লেন মসজিদ সড়কের একটি অ্যাপার্টমেন্টে এক বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তার বাসায় গিয়ে দেখা গেল, তিনি ড্রইং রুমকে স্কুল রুম বানিয়েছেন। শিক্ষক তিনি ও তার স্ত্রী। গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলে পড়ে তাদের দুই ছেলে।

আবদুল্লাহ সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি দুই ছেলেকে পড়াচ্ছি। তাদের মাম্মিও পড়াচ্ছে। এখন এটা ছাড়া কোনো পথ নেই। কারণ ওদের দুইজন প্রাইভেট কোচিংয়ে যেত, সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে।

“এখন যে অবস্থা ঘরই আবাস, ঘরই স্কুল- এটা মনে রেখে সামনে এগোতে হবে। করোনাভাইরাসের আতঙ্কে ভয় পেলে চলবে না।”

মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার একটি পেট্রোল পাম্পের দারোয়ান মুন মিয়া, থাকেন মালিবাগ রেলগেইটের বাগানবাড়িতে এক কক্ষের একটি ছোট্ট টিনের ঘরে।

দুই মেয়ে নিয়ে মনুর সংসার। মেয়েরা গুলবাগের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে।

মুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “স্যার, ছোট্ট ঘরে থাকি কোনো মতে। মাইয়া দুইটারে কষ্ট করে স্কুলে ভর্তি করাইছি। স্কুল বন্ধ তারা ঘুইরা বেড়ায়। ছোট্ট রুমে যে গরম, কী পড়ালেখা করব তারা? এজন্য আমি কিছুই বলি না। সন্ধ্যা হলে বাসায় আইসা বই পড়ে তারা।”

রাজধানীর একটি স্কুলের শিক্ষক আবদুল শহীদের মতে, এখন অভিভাবকদের অবশ্যই ছেলে-মেয়ের প্রতি আলাদা নজর দিতে হবে। পুরোটা সময়ে শিক্ষার্থীদের বাসা-বাড়িতে থাকতে হচ্ছে। অফুরন্ত সময় তাদের।

“অভিভাবকরাই পারেন একটা রুটিন করে তাদের গাইড করা। এটা তাদের করতে হবে। সময়টা ভালো নয়। সেজন্য ছেলে-মেয়েকে প্রোপার গাইডেন্সের মধ্যে রাখতে হবে।”

বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ

এই সময়ে শিশুদের আনন্দদায়ক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক তাজুল ইসলাম।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শিশুদের ওপর এই বন্দি দশার প্রভাবটা বেশি। খেলাধুলা-দৌড়াদৌড়ি, এসবই শিশুদের কাজ। গৃহবন্দি থাকাটা তাদের প্রকৃতির সাথে যায় না। জোর করেই তাদের এভাবে রাখতে হয়। কিশোর-কিশোরীরা স্কুলে গেলে বন্ধুদের সাথে গল্প করে, আড্ডা দেয়- কিন্তু এ সময়টাতে তা করতে পারছে না।"

এই সময়ে শিশুদের প্রতি বাড়তি খেয়াল রাখার পরামর্শ দিয়ে এই মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, “করোনাভাইরাসের খবরগুলোও তাদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করে। চার বছর বয়সী থেকে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে এর প্রভাবটা সবচাইতে বেশি। যারা মানসিকভাবে দুর্বল প্রকৃতির, আতঙ্কগ্রস্ত তাদের মধ্যে এর প্রভাবটা বেশি। যাদের মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা কম, তারাই বেশি মানসিকভাবে আক্রান্ত হবে।

“শিশুরা যেন ব্যায়াম, মেডিটেশন, বই পড়ার পাশাপাশি পরিমিত খাবার গ্রহণ করে সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।”

মহামারীর দিনে সবাইকে থাকতে হবে বাসায়, মুক্ত আকাশ মিলছে শুধু ছাদে। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

শিশুদের জন্য ঘরেই বিচিত্র আয়োজন রাখার পরামর্শ দিয়ে অধ্যাপক তাজুল ইসলাম বলেন, “তাদের পড়াশুনার বাইরে অন্যান্য কাজে উৎসাহ দিতে হবে। সঙ্গ দিতে হবে বড়দের। শিশুদের বোঝাতে হবে যে, কেন তাদের বাইরে যাওয়া যাবে না।”

ইনডোর গেমস, পড়াশুনায় উৎসাহের তাগিদ দিয়ে এই মনোবিজ্ঞানী বলেন, “তাদের শখের বই, গল্পের বই পড়তে দিতে হবে, যাতে আনন্দ পায় তা পড়তে দিতে হবে। মা-বাবার সাথে এক সঙ্গে গান গাওয়া, ছবি আঁকার মতো কাজগুলো করতে হবে। এ সময় তাদের সাথে বাবা-মাকে বেশি সময় কাটাতে হবে, শিশুদের আবেগ ও অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করতে হবে।

“শিশুদের করিডোরে নিয়ে হাঁটতে পারেন মা-বাবারা। শিশু যা চাচ্ছে, তার বিকল্প আনন্দের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।”

অভিভাবকদের শান্ত থেকে পরিস্থিতি সামলানোর পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল সাইকোলোজি বিভাগের অধ্যাপক শাহীন ইসলাম।

তিনি বলেন, “শিশুদের আগে বোঝাতে হবে কী কারণে তারা বাসায় আছে? শিশু যে বয়সী সেই হিসেবে তাকে বাস্তবতাটা বোঝাতে হবে।

“তাকে একটি রুটিন করে দিতে হবে, যেভাবে সে চলবে। সেখানে অবশ্যই বৈচিত্র্য থাকতে হবে। বাসার মধ্যে যদি আমরা একটা কর্নার করে দেই তাদের জন্য, যে এটা তোমার স্কুল, এটা তোমার খেলার জায়গা…এই সময়টায় তুমি এ কাজটা করবে-এগুলো শিশুকে বুঝিয়ে দিতে হবে।”

তবে শিশুদের ওপর কোনো কাজ চাপিয়ে না দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন এই অধ্যাপক।

“তারা যদি গান গাইতে চায়, ছবি আঁকতে চায়, গল্পের বই পড়তে চায় সেগুলো রুটিনের মধ্যে এনে দিতে হবে। শুধু তাকে বলে দিলে হবে না, মা-বাবার তাকে সঙ্গও দিতে হবে। তার বন্ধুদের সাথে মাঝে মাঝে কানেক্ট করিয়ে দেওয়া যেতে পারে অনলাইনে।”

অভিভাবকদের সৃজনশীলতা বাড়িয়ে শিশুদের জন্য আনন্দময় পরিবেশ তৈরির ওপর জোর দেন মনোবিজ্ঞানী শাহীন ইসলাম।

“আগে নিজেকে শান্ত হতে হবে। আমরা নিজেরাই তো অস্থির। সেটি হলে আমাদের অস্থিরতাটা ওদের মধ্যে চলে যাবে।"

এই ছুটির সময়ে শিশুরা অভিভাবকদের সাথে আরও বেশি সময় কাটানোর সময় পাচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।

“অনেক বাবা-মা অফিসের কাজটা এখন বাসায় থেকে করছে, এটাও শিশুদের বোঝানো দরকার। যেহেতু অফিসে যাওয়া-আসার সময়টা কমে যাচ্ছে, তাই সে সময়টা বাবা-মাকে বাচ্চাদের সাথে কাটাতে হবে।”

একই বিষয়ে তাগিদ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক  মাহফুজা খানম।

তিনি বলেন, “আজকাল বাবা-মা দুজনই ব্যস্ত থাকেন, সন্তানদের সময় দিতে পারেন না। যেহেতু এখন সময় পাওয়া গেছে, তাই বেশি সময় বাচ্চাদের সাথে কাটাতে হবে যেন তাদের বন্ডিংটা আরও স্ট্রং হয়।”

শিশুদের পছন্দের কাজে ব্যস্ত রাখার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “শিশুদের ইতিবাচক চিন্তাভাবনা করা আর মাইন্ড ডাইভার্ট করে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা আজকাল শুধু পড়াশুনাই চাপিয়ে দেই বাচ্চাদের ওপর, এখন এটা করলে চলবে না।”

তার মতে, শিশুদের গাছ কিনে দিয়ে তা পরিচর্যা করার কথা বলতে পারেন অভিভাবকরা। গাছটাতে তারা প্রতিদিন পানি দিলে, যত্ন নিলে তারা ব্যস্ত থাকবে, এক ধরনের প্রশান্তিও কাজ করবে তাদের।

“এখন যেহেতু তাদের পোষা প্রাণি-পাখি বা মাছ এসব দেওয়া যাবে না, তাই বারান্দা, ছাদ বা বাসার নির্দিষ্ট স্থানে খাবার দিলে অনেক সময় পশু বা পাখি আসে খাবার খেতে। এ ধরনের কাজে তাদের নিয়োজিত রাখলে তাদের মন ভালো থাকবে।”

এছাড়াও শিশুদের বিভিন্ন ধরনের রঙ কিনে দিয়ে ছবি আঁকা বা নতুন গল্পের বই এনে দিয়ে বই পড়ায় তাদের ব্যস্ত রাখার পরামর্শ দেন তিনি।