করোনাভাইরাস: মসজিদ বন্ধ নিয়ে কী ভাবছেন বাংলাদেশের ধর্মীয় নেতারা

নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে জনসমাগম কমিয়ে আনতে সৌদি আরব, কুয়েতসহ বিভিন্ন দেশ অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য মসজিদ বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অভূতপূর্ব সিদ্ধান্ত নিয়ে নামাজ বন্ধ করা হয়েছে মক্কা ও মদীনার মসজিদেও।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 March 2020, 06:42 PM
Updated : 22 March 2020, 06:42 PM

বাংলাদেশে জনসমাগম কমানোর কথা বলা হলেও মসজিদ বন্ধের কোনো সিদ্ধান্ত এখন পর্যন্ত নেননি আলেম-ওলামা কিংবা সরকারের নীতি-নির্ধারকেরা।

সাময়িক পদক্ষেপ হিসাবে জুমার সুন্নত ঘরে কিংবা শবে মিরাজের ইবাদত ঘরে করার আহ্বান জানিয়েছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন।

তবে কভিড-১৯ এর মতো মহামারী ঠেকাতে মসজিদ বন্ধ করা যায় কি না, তা নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে বাংলাদেশের ইসলামী চিন্তাবিদদের মধ্যে।

তাদের কেউ বলছেন, মসজিদ বন্ধের মতো পরিস্থিতি এখনও তৈরি হয়নি, সময় হলে বসে সিদ্ধান্ত নেবেন কী করা যায়।

মসজিদ বন্ধের পক্ষে যারা মত দিচ্ছেন, তাদের বক্তব্য হচ্ছে- প্লেগ আর কুষ্ঠরোগের মহামারী ঠেকাতেমহানবী মুহাম্মদ (সা.)ও মানুষকে আলাদা থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। সংক্রামক রোগ ঠেকাতে সাহাবিদের আমলেও ঘরে থেকে নামাজ পড়ার কথা বলা হয়েছিল।

কয়েকটি হাদিসের বক্তব্য তুলে ধরে অধ্যাপক মুখতার আহমাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ”হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, একদিন বৃষ্টিপাত হচ্ছিল প্রচুর, মুহাম্মদ (সা.) তার মুয়াজ্জিনকে বললেন, যখন তুমি ‘আশহাদু আন্নাহ মুহাম্মাদার রাসুল্লাহ’ বল, তারপর তুমি বলবে, ‘সাল্লু ফি বুয়ুতিকুম’ বা তোমরা ঘরে নামাজ আদায় করো। এটা কিন্তু বোখারী ও মুসলিমের হাদিস।

”যখন মোয়াজ্জিন এটা বললেন, তখন লোকেরা এটা অপছন্দ করল। তখন আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস তাদের লক্ষ্য করে বললেন, আমার ও তোমাদের চেয়ে উত্তম যিনি, হজরত মুহাম্মদ (সা.) তিনিও বরং এটি করেছেন। তিনি এ কথা বলেছেন।”

তিনি বলেন, “বৃষ্টির দিনে যদি মসজিদে আসতে বারণ করা বা অনুৎসাহিত করা হয়, কারণ যিনি বৃষ্টি ভিজবেন, তিনি অসুস্থ হয়ে যেতে পারেন। অর্থাৎ কাদা শরীরে লেগে ক্ষত তৈরি হতে পারে এ কারণে যদি নামাজ আদায়ে বারণ করা হয়, তাহলে করোনাভাইরাসের মতো অভূতপূর্ব রোগের কারণে কি এই বিধান দিতে পারে না?

”অন্য সময়ে মসজিদে লোক পাওয়া যায় না, কিন্তু করোনাভাইরাসের মধ্যে আবেগ দেখাচ্ছি। এটা কিন্তু আবেগের বিষয় না, এটা এখন বাস্তবতা।”

আরেকটি হাদিসের উদ্ধৃতি মাওলানা মুখতার বলেন, “রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমাদের কেউ যদি ভাইরাস বা এ ধরনের কোনো সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়, তাহলে সে যেন কোনো সুস্থ ব্যক্তিকে আক্রান্ত না করে। কোনো এলাকায় যদি প্লেগ বা এ ধরনের সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়ে, সেখানে যেও না এবং সেখান থেকে কাউকে বের হতে দিবে না।

”যখন সংক্রামক কোনো রোগ ছড়িয়ে পড়বে, তখন আমাদেরকে অবশ্যই সতর্ক থাকা দরকার। আমরা যাতে অন্য কাউকে সংক্রমিত না করি। অথবা আমরা সংক্রমিত কি না, এখনো জানি না, ফলে অন্যদের মাঝে যাতে সংক্রমণ না ঘটে অথবা অন্যদের মাধ্যমে যাতে আমরা সংক্রমিত না হই, সে প্রচেষ্টা আমাদের গ্রহণ করা দরকার।”

নভেল করোনাভাইরাস ইতোমধ্যে দেড় শতাধিক দেশে আক্রান্ত করেছে ৩ লাখের বেশি মানুষকে; এতে মৃতের সংখ্যা ১৩ হাজার। দিন দিনই বাড়ছে আক্রান্ত ‍ও মৃতের সংখ্যা। বাংলাদেশে ২৭ জনের সংক্রমণের কথা সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মারা গেছেন তিনজন।

এক মুসল্লি কভিড-১৯ রোগ ধরা পড়ার পর পাকিস্তানের ইসলামাবাদে দুটি মসজিদ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দেশটিতে আক্রান্তের সংখ্যা ছয়শ ছাড়িয়েছে, মারা গেছে চারজন।

বাংলাদেশে মসজিদ কিংবা জুমার নামাজ বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনও আসেনি বলে মনে করছেন শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমান মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মৃত্যুবরণ করার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত যে কোনো পরিস্থিতিতে নামাজ আদায় করা ফরজ। এখন প্রশ্ন হল মসজিদে নামাজ আদায় হবে কি না। সেই বিষয়ে আলোচনার সময় এখনও আসেনি। কারণ বাংলাদেশে বাজার-ঘাট সব খোলা আছে।

”জেলখানা যদি দেখেন সেখানেও কিন্তু আসা-যাওয়া বন্ধ নেই। তাহলে এখনই মসজিদ বন্ধ করে দিতে হবে কেন?”

মাওলানা মাসঊদ বলেন, “এমন কোনো পরিস্থিতি যদি তৈরি হয়, যখন জুমা কিংবা মসজিদ বন্ধ করা লাগবে, তাহলে আলেম-ওলামারা বসে সিদ্ধান্ত নিবেন। কারণ ইসলাম তো কঠিন কোনো ধর্ম নয়, বরং উদার।”

বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা মিজানুর রহমানও মনে করেন, এখনই মসজিদে জামায়াত বা জুমার নামাজ বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো পরিস্থিতি ‘তৈরি হয়নি’।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে মসজিদ বন্ধ করে দেওয়ার পক্ষে-বিপক্ষে অনেক মত এসেছে।

“আমাদের আলেম-ওলামারা এখন পর্যন্ত বসে কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। পরিস্থিতি বিবেচনায় তারা দুয়েক দিনের মধ্যে বসে এ বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত হয়ত নেবেন।”

যা বলছে সৌদি আরবের ওলামা পরিষদ

ইসলামী চিন্তাবিদদের নিয়ে গঠিত কাউন্সিল অব সিনিয়র স্কলারসের ফতোয়ার ভিত্তিতে মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত এবং জুমার নামাজ সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে সৌদি আরব।

কুরআনের বিভিন্ন আয়াত ও বেশ কিছু হাদিসের বিশ্লেষণ করে নামাজ ও মসজিদ বন্ধের সিদ্ধান্ত দেন তারা।

সুরা বাকারার ১৯৫ নম্বর আয়াত যেখানে বলা আছে “এবং তোমরা নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিও না।” এবং সুরা নিসার ২৯ নম্বর আয়াত, খোনে বলা আছে “এবং নিজেদেরকে হত্যা করিও না। নিশ্চয় আল্লাহ্ তোমাদের প্রতি দয়াশীল।”- এই দুই আয়াতের ব্যাখ্যা করে তারা বলেন, এ দুটি আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, জীবননাশের কারণগুলো থেকে বেঁচে থাকা ওয়াজিব বা অবশ্য কর্তব্য।

এছাড়া নবীর (সা.) কিছু হাদিসেও মহামারির বিস্তৃতি লাভের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনের অপরিহার্যতা প্রমাণিত হওয়ার কথা তুলে ধরেন ইসলামী চিন্তাবিদরা।

এক হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, “কোন ব্যক্তি যেন তার অসুস্থ উটকে সুস্থ উটের কাছে না নিয়ে যায়।”

তিনি আরও বলেন, “কুষ্ঠরোগী থেকে সেভাবে পালাও যেভাবে সিংহ থেকে পলায়ন করো।”

নবী মুহাম্মদ (সা.) আরেকটি হাদিসে বলেন, “যদি কোন এলাকায় মহামারীর কথা শুনো তবে সেখানে যেও না। আর যদি কোন এলাকায় তোমাদের থাকা অবস্থায় মহামারী সৃষ্টি হয় তাহলে সেখান থেকে বের হয়ো না।”

ইসলামী চিন্তাবিদরা বলেন, শরিয়তের একটি সুসাব্যস্ত মূলনীতি হল, ‘নিজের অথবা অন্যের কোনও ক্ষতি করা যাবে না।’ এবং ‘যতটা সম্ভব ক্ষয়-ক্ষতি প্রতিহত করতে হবে।’

ফতোয়ার সিদ্ধান্তে তারা বলেন, “উপরোক্ত আলোচনার উপর ভিত্তি করে বলা যায়, বিশেষ প্রয়োজনে মসজিদে সব ফরজ এবং জুমার সালাত বন্ধ করা শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ। কেবল আজান দেয়াই যথেষ্ট।”

এক্ষেত্রে আজানে সাল্লূ ফী বুয়ূতিকুম বা আপনার বাড়িতেই সালাত আদায় করুন- এমন আহ্বান জানানোর সিদ্ধান্তও একটি হাদিসের বর্ণনা অনুসারে দেয় সৌদি কাউন্সিল অব স্কলারস।

কভিড-১৯ ছড়ানোর কারণ যখন ধর্মীয় সমাবেশ

মালয়েশিয়ায় করোনাভাইরাস ছড়ানোর বড় কারণ হয়েছে ১৬ হাজার লোক নিয়ে তাবলিগ জামাতের একটি সমাবেশ, দেশটিতে মালেয়শিয়ায় আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় সাড়ে ছয়শ’ জন এই সমাবেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

দুই দিন আগে নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই সমাবেশ থেকে কমপক্ষে ছয়টি দেশে কভিড-১৯ এর রোগী ছড়িয়েছে। ব্রুনেইয়ের ৭৩ এবং থাইল্যান্ডের ১০ জন আক্রান্তের সংযোগ পাওয়া গেছে এই সমাবেশের সঙ্গে।

২ মার্চ বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষিণ কোরিয়ায় আক্রান্তদের অর্ধেক শিনচেওনজি চার্চ অব জেসাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তখন পর্যন্ত দেশটিতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৭৩০।

এর আগে সিঙ্গাপুরে আক্রান্তদের একটি বড় অংশের সংযোগ পাওয়া গেছে একটি চার্চে গমনাগমনের সঙ্গে।

অন্যদিকে, ইরানের কওমে আগত শিয়া মতাবলম্বী পূণ্যার্থীদের মাধ্যমে মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার অনেক এলাকায় করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে। দেশটিতে শনিবার পর্যন্ত ২১ হাজার ৬৩৮ জনের করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়েছে। মৃতের সংখ্যা ১ হাজার ৬৮৫ জন।

এর মধ্যেই গত বুধবার লক্ষ্মীপুরের রায়পুর হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়ে করোনাভাইরাস থেকে মুক্তির দোয়া অনুষ্ঠান আয়োজন করলে তা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও শিরোনাম হয়।