বিদেশ ফেরতদের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিতে কঠোর বার্তা

বাংলাদেশে আরও তিনজন কভিড-১৯ রোগী পাওয়ার প্রেক্ষাপটে নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টিনে থাকা নিশ্চিত করতে কঠোর হচ্ছে সরকার।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 March 2020, 06:31 PM
Updated : 16 March 2020, 06:32 PM

বিদেশে থেকে আসা সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে রাখার সিদ্ধান্ত দিয়েছে মন্ত্রিসভা।

আইইডিসিআর হুঁশিয়ার করেছে, বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে কেউ না থাকলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিদেশ থেকে আসা বাংলাদেশিদের ঘুরে বেড়ানোর খবরে কূটনীতিকরা উদ্বেগ জানানোয় সরকারের কঠোর হওয়ার কথা তাদের জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে এ মোমেন।

কোয়ারেন্টিনের নির্দেশনা না মানলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর হবে বলে হুঁশিয়ার করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।

বিদেশ প্রত্যাগতদের ‘হোম কোয়ারেন্টাইন’ নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ একগুচ্ছ নির্দেশও দিয়েছে।

আড়াই মাস আগে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথম নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর ওই শহর থেকে আসা বাংলাদেশিদের ঢাকার আশকোনার হজ ক্যাম্পে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছিল। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের পর তাদের ১৪ দিন পর ছাড়া হয়েছিল।

চীন থেকে দ্রুতই বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে করোনাভাইরাস; কভিড-১৯ রোগীর সন্ধান মিলতে থাকে ইউরোপেও।

কিন্তু চীনের উহান থেকে আসা বাংলাদেশিদের পর আর কাউকে সরকারিভাবে কোয়ারেন্টিনে না রেখে তাদের বাড়িতে কোয়ারেন্টিনে থাকতে বলা হয়।

তার মধ্যেই ইতালি থেকে আসা দুজনের মধ্যে প্রাণঘাতী এই ভাইরাস ধরা পড়ে, তাদের একজনের স্বজনের দেহেও তা ছড়ায়।

সোমবার দেশে কভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা পৌঁছে যায় আটজনে। এর মধ্যে নতুন আক্রান্ত তিনজন ইতালি প্রবাসী একজনের পরিবারের সদস্য।

শনি ও রোববার যারা বিদেশ থেকে এসেছেন, তারা প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকতে না চাওয়ায় এবং আগে আসা অনেকের বাইরে ঘুরে বেড়ানোর খবরে সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে কঠোর নির্দেশনা আসে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকের পর মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, “সরকারি প্রোগ্রাম, ট্রেনিং বা সাধারণ লোকজন যেই (বিদেশ থেকে) আসুক, তাকে অবশ্যই ১৪ দিন বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে, এ বিষয়ে কারও ছাড় নেই, এটা স্পষ্ট।”

যদি কেউ কোথাও এ নির্দেশনা লঙ্ঘন করেন, তার বিরুদ্ধে সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন তিনি।

সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইনে সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে সরকারি দায়িত্ব পালনে বাধা দিলে বা নির্দেশনা না মানলে সর্বোচ্চ তিন মাসের জেল ও ৫০ হাজার টাকার শাস্তির বিধান রয়েছে। আর মিথ্যা বা ভুল তথ্য  দিলে সর্বোচ্চ ২ মাসের কারাদণ্ড বা ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড হতে পারে।

মানিকগঞ্জে সৌদিফেরত একজনকে রোববার ওই আইনে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করার বিষয়টিও তুলে ধরেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

তিনি বলেন, “রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার সোমবার দেশে ফিরেছেন। তাকে বলে দিয়েছি তুমি অবশ্যই ১৪ দিন বাধ্যতামূলক কোরারেন্টিনে থাকবে, এর মধ্যে অন্য অপশন নেই।

“যে কোনো অফিসার বা প্রাইভেট লোক হোক, যারাই বিদেশ থেকে আসবে, যে দেশ থেকেই আসবে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। যদি তার কারণে, সে যেই হোক, কোনো কিছু ঘটে আইনানুগভাবে তাকে ফেইস করতে হবে।”

রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরাও বলেন, এ বিষয়ে কঠোর হতে জেলা পর্যায়ে গঠিত কমিটিকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

নভেল করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী মহামারীর আকার নেওয়ার মধ্যে ১৫ মার্চ পর্যন্ত ৬ লাখ ৬ হাজার ১২ জন বাংলাদেশি দেশে এসেছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় এসেছেন ৯ হাজার ৭৬৫ জন। দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছাড়াও স্থল ও সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করেও এসেছেন এসেছেন অনেকে। 

দেশের বিভিন্ন এলাকায় থাকা বিদেশ ফেরতদের বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার কিছু ঘটনা আইইডিসিআরের নজরে এসেছে বলে জানান অধ্যাপক ফ্লোরা।

বিদেশ ফেরতদের পরিবারের সদস্যদের সচেতনতার উপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে না পারলে এ রোগের বিস্তার ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়বে।

“আমরা আবারও অনুরোধ করছি, যারা বাইরে থেকে আসছি, তারা যেন পরিবার থেকে দূরত্ব বজায় রাখি। আমরা যেসব ব্যবস্থা নিচ্ছি তাতে সমাজ থেকে তাদের দূরে রাখতে পারব। যদি পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে দূরে রাখা না যায়, তাহলে এ রোগের সংক্রমণ ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়বে। সেক্ষেত্রে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে যেতে হবে।”

আইইডিসিআরের পরিচালক বলেন, হোম কোয়ারেন্টিনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে তারা আরও শক্ত ব্যবস্থা নেবেন।

“আমরা সহানুভূতিশীল হয়ে হোম কোয়ারেন্টিন করেছিলাম; সে বিষয়টা থেকে আমরা সরে এসে কিছুটা কঠোর হওয়ার দিকে যাচ্ছি।”

তবে তিনি বলেন, কারও কোনো ‘অত্যাবশ্যকীয়’ প্রয়োজন থাকলে অনুমতি সাপেক্ষে বাইরে বের হওয়া যাবে।

রোববার পর্যন্ত সারাদেশে ২ হাজার ৩১৪ জন বিদেশফেরত মানুষের হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার কথা জানিয়েছিল আইইডিসিআর।

তবে এ বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্তি ও আতঙ্ক ছড়াচ্ছে জানিয়ে সোমবার সংবাদ সম্মেলনে হালনাগাদ কোনো তথ্য জানানো হয়নি।

সোমবার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে একজন কূটনীতিক জানতে চান, “আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে জেনেছি, মানুষ কোয়ারেন্টিন ক্যাম্পে থাকছে না। তাহলে আপনি কীভাবে নিশ্চিত হন, তারা সেল্ফ কোয়ারেন্টিনে থাকবে?”

জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, “আমাদের জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় নেতাদের বলা হয়েছে, যারা বিদেশ থেকে আসবে তারা বাড়িতে কোয়ারেন্টিনে থাকবে। যদি কেউ সেটা না মানে তাহলে আমরা তাদের প্রতিবেশী ও পরিবারের সদস্যদের বলছি, যাতে তারা আমাদের জানায়।

”গতকাল একজন কোয়ারেন্টিন থেকে বের হয়ে গিয়েছিল, সেজন্য আমাদের স্থানীয় প্রশাসন তাকে ধরে জরিমানা করেছে। ভবিষ্যতে আমরা এদেরকে বাধ্য করব। আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এ ব্যাপারে ওয়াকিবহাল।”

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার বলেন, “সব আগত যাত্রীকে আমরা একটা ডিক্লারেশন ফর্ম পূরণ করতে দিচ্ছি, তাদের স্থানীয় ঠিকানা, টেলিফোন নম্বর, বিমানের সিট নম্বর পূরণের জন্য। যাতে আমরা লোকদের খুঁজে পেতে পারি। এ কারণে কেউ যদি পালিয়ে যায়, তাহলে তাকে আমরা ফেরত আনতে পারব।”

কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তিদের ঘরে ঢোকাতে পুলিশও সক্রিয় বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল।

ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, “আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেখানেই আইন অমান্য হচ্ছে সেখানেই ব্যবস্থা নিচ্ছে।

“আর গাজীপুরের কালীগঞ্জে জনগণই স্বপ্রণোদিত হয়ে একজনকে ধরে নিয়ে ঘরে আবদ্ধ করেছে। সবাই সতর্ক হয়ে গেছে।”

এদিকে বিদেশ প্রত্যাগতদের হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য বিভাগের নির্দেশনা অনুসরণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে সবাইকে।

>> হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তি ১৪ দিন ঘরের বাইরে বের হবেন না এবং নিজ বাড়ির নির্ধারিত একটি কক্ষে অবস্থান করবেন।

>> পরিবারের অন্যান্য সদস্য দেশে প্রত্যাগত সদস্যের হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করবেন।

>>  কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ওই ব্যক্তির সংস্পর্শে আসতে পারবেন না।

>> গঠিত কমিটিসমূহ সম্প্রতি বিদেশ প্রত্যাগত ব্যক্তিদের বাড়ি চিহ্নিত করবেন এবং তাদের গৃহে সার্বক্ষণিক অবস্থানের বিষয়ে তদারকি করবেন।

>> গঠিত কমিটিসমূহ হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকার জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি (যেমন: পৌর মেয়র, পৌর কাউন্সিলর, ইউপি চেয়ারম্যান, ওয়ার্ড মেম্বার, ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য সহকারী, কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার, পরিবার কল্যাণ সহকারী, পরিবারকল্যাণ পরিদর্শিকা, গ্রাম পুলিশ, স্থানীয় সাংবাদিক) সম্পৃক্ত করবেন।

>> যদি কোয়ারেন্টিনকৃত ব্যক্তি উপর্যুক্ত নিয়ম ভঙ্গ করেন, তবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এবং থানার ওসিদের সহায়তা গ্রহণ করবেন।

>> হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তি অসুস্থ হলে স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ এবং প্রয়োজনে স্থানীয় সিভিল সার্জন, হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক এবং উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করবেন।

>> কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তিগণ যদি নিয়ম ভঙ্গ করেন তাহলে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

>>  প্রতিদিন এ বিষয়ে জেলাভিত্তিক একটি প্রতিবেদন তৈরি করে সংশ্লিষ্ট সিভিল সার্জন নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ও মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগে পাঠাবেন।