এমিরেটসের একটি ফ্লাইটে শনিবার সকালে ঢাকায় আসার পর শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে তাদের সরাসরি নেওয়া হয়েছে আশকোনার হজ ক্যাম্পে।
সম্ভাব্য ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে এই ১৪২ ব্যক্তিকে সেখানে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে রাখা হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপন।
করোনাভাইরাস মোকাবেলায় হিমশিম খাওয়া ইতালি থেকে আরও শতাধিক ব্যক্তি আসছেন জানিয়ে তাদের নিয়েও একই পরিকল্পনা নিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, “ইতালিতে যেহেতু বেশি ছড়িয়েছে, তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সেখান থেকে যারাই আসবে, তারা কোয়ারেন্টিনে থাকবে। প্রথমে তারা বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে থাকবে, পরে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকবে।”
উহান ফেরত কারও মধ্যে ভাইরাস সংক্রমণের লক্ষণ না পেয়ে ১৪ দিন পর তাদের বাড়িতে ফেরার অনুমতি দেওয়া হয়।
আড়াই মাস আগে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরেই প্রথম নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছিল।
চীনে তিন হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটানোর পর এখন ইউরোপের দেশ ইতালিতে এই ভাইরাস সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ নিয়ে দেখা দিয়েছে।
গত ২৪ ঘণ্টায় ২৫০ জনের মৃত্যু ইতালিতে মৃতের সংখ্যা ১২শ ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে; আক্রান্তের সংখ্যাও বেড়ে এখন ১৭ হাজারের বেশি।
বাংলাদেশে যে তিনজনের দেহে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে, তাদের দুজনই এসেছেন ইতালি থেকে।
ইতালি থেকে আসা আরও অনেককে বিভিন্ন জেলায় ‘হোম কোয়ারেন্টিনে’ রাখার মধ্যে একসঙ্গে শতাধিক ব্যক্তিকে নিয়ে শনিবার আসে এমিরেটসের ফ্লাইটটি।
রোম থেকে দুবাই হয়ে সকাল ৮টায় এই ব্যক্তিরা ঢাকায় আসেন বলে জানান শাহজালাল বিমানবন্দর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসক ডা. শাহরিয়ার সাজ্জাদ।
কতজন এসেছেন- তাৎক্ষণিকভাবে তা জানাতে পারেননি তিনি।
“সাড়ে ৫টায় দুবাই থেকে যখন ফ্লাইট ডিপার্চার করে, তখন আমাদের জানানো হয়েছিল ১২৫ জন পূর্ণ বয়স্ক এবং দেড় বছরের একটি শিশু। পরে আমরা হিসেব মেলাতে গিয়ে দেখি মেলে না। সংখ্যাটি বেশি হতে পারে।”
পুলিশ পাহারায় বিআরটিসির কয়েকটি বাসে এই ব্যক্তিদের আশকোনা হজ ক্যাম্পে নেওয়া হয়। সেখানে তাদের স্বজনরাও ভিড় জমান।
সেখানে নেওয়ার সিদ্ধান্তে তাদের অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেন; কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে তর্কাতর্কিও করেন।
এরপর দুপুরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ইতালি ফেরত ব্যক্তির সংখ্যা ১৪২ জন জানিয়ে বলা হয়, তারা হজ ক্যাম্পে কোয়ারেন্টিনে থাকবেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এই নির্দেশ দিয়েছেন জানিয়ে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “পরবর্তী সময়ে আক্রান্ত দেশগুলো থেকে কোনো যাত্রী দেশে এলে তাকেও বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইন করা হবে।“
নির্দেশ অমান্যকারীর স্বাস্থ্যমন্ত্রী জেল-জরিমানার হুমকি দিয়েছেন বলেও জানানো হয় বিজ্ঞপ্তিতে।
এরপর আইইডিসিআরের নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা জানান, ইতালি ফেরত ওই বাংলাদেশিদের জ্বরের উপসর্গ না থাকলেও তাদের আরও পর্যবেক্ষণে রাখা হবে।
“পরে কোনো উপসর্গ যদি পাওয়া যায়, তবে তাদের হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার পরামর্শ দেওয়া হবে। যাদের হোম কোয়ারেন্টিনে সমস্যা হবে, তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে আনা হবে।”
এর ঘণ্টাখানেক পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে এসে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, প্রাণঘাতী ভাইরাসটির দেশে সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টিনে রাখার সিদ্ধান্ত।
তিনি বলেন, “যারা আসছে, সকলেই সুস্থ আছেন। কেউ অসুস্থ নাই। সেভাবে আমরা পাইনি।
“তাদের হজক্যাম্পে নিয়ে রেখেছি। সেখানে রেখে তাদের পরীক্ষা করব। তারা সংক্রমিত কি না, দেখব। আমরা জেনেছি তারা অনেকে সার্টিফিকেট নিয়ে এসেছে। তারা সেখানেও কোয়ারেন্টিনে ছিল। যদি দেখি সবাই সুস্থ সেক্ষেত্রে তাদের হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখব।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “১৪২ জন সেখানে এসেছে, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জেনেছি কোথা থেকে এসেছে।
“অনেকে হেলথ সার্টিফিকেট নিয়ে এসেছে। আজ বিকালে আরও ৩৪ জন আসবে। আগামীকাল ১৫৫ জন আসার কথা শুনেছি।”
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, “যেহেতু অনেক লোক ইতালি থেকে এসেছে, তাদের মধ্যে অনেকে দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় ছিল, তাই তাদের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে রেখেছি। একেবারে ছেড়ে দেব না। আমরা বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছি। নিজ নিজ বাড়িতে সরকারি তত্ত্বাবধানে তাদের হোম কোয়ারেন্টিনে রাখা হবে।”
ইতালি থেকে এসে যারা নিজ নিজ এলাকায় ফিরে গেছেন, তাদের উপর নজর রাখা হচ্ছে বলেও জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
“ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা নজর রাখছেন স্থানীয়ভাবে। জনগণও বিদেশ থেকে কেউ আসলে আমাদের জানাচ্ছে। সেখানে ডাক্তার ও পুলিশ যাচ্ছে, যাতে তারা বের না হন সে বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে বিদেশ থেকে আসা সবাইকে কোয়ারেন্টিনে রাখার কথা বলা হলেও তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কথায় স্পষ্ট, এক্ষেত্রে হোম কোয়ারেন্টিনের কথাই বলা হচ্ছে।
অর্থাৎ বিদেশ থাকা আসা ব্যক্তিরা তাদের বাড়িতে থাকবেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন, ঘর থেকে বের হবেন না। আর প্রশাসন তাদের উপর নজর রাখবে।
এক্ষেত্রে প্রশাসনের তৎপরতায় কোনো ঘাটতি নেই দাবি করে তিনি বলেন, “কোন জেলায় কতজন কোয়ারেন্টিন হচ্ছে, কীভাবে তারা আছে, প্রতিটি নিউজ আমাদের কাছে আছে।”
স্বাস্থ্য সচিব মোহাম্মদ আসাদুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “সারাদেশে ডিসি-ইউএনওদের নিয়ে কমিটি করা হয়েছে। তাদের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ রাখছি। স্থানীয়ভাবে কমিটি খুব অ্যাকটিভ। যারা এসেছে, তাদের চেকআপ করা হয়েছে।”
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, “জেলা-উপজেলার কমিটিগুলো খুব তৎপর। বিদেশ থেকে যারা আসছে তাদের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। কেউ গোপন করলে তথ্য গোপনের যে আইন, তা প্রয়োগ হবে। সেখানে জেল-জরিমানার কথা বলা হয়েছে।”
নভেল করোনাভাইরাস বৈশ্বিক মহামারী রূপ ধারণ করায় বাংলাদেশ ঝুঁকিমুক্ত না হলেও সরকার সংক্রমণ ঠেকাতে যথেষ্ট পদক্ষেপ নিয়েছে বলে দাবি করেন জাহিদ মালেক।
“করোনাভাইরাস যেখানে আছে, সেখানে তো একটু ঝুঁকি থাকেই। তবে গত দুই মাসে প্রতিরোধে আমরা যে ব্যবস্থা নিয়েছি সে ব্যবস্থা কোনো দেশই নেয়নি।”
সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “আমাদের দেশে যে করোনা আক্রান্ত রোগী পাওয়া গিয়েছিল তাদের মধ্যে ২ জনের শরীরে করোনাভাইরাস নেই।
“তৃতীয় জনের রিপোর্টও নেগেটিভ পাওয়া গেছে। আমরা আস্তে আস্তে তাদের ছেড়ে দেব।”
আইএসপিআর জানিয়েছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে আশকোনা হজ ক্যাম্পে ইতালি ফেরতদের ‘একসেস কন্ট্রোল ও নিরাপত্তায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছ’।
এই সংক্রান্ত খবর