যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদন একপেশে, অগ্রহণযোগ্য: তথ্যমন্ত্রী

অনিয়মের অভিযোগবিদ্ধ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ‘অবাধ ও সুষ্ঠু’ হয়নি বলে তুলে ধরে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনকে ‘একপেশে’ আখ্যা দিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 March 2020, 03:03 PM
Updated : 13 March 2020, 03:32 PM

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্ট মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে গত ১১ মার্চ বাংলাদেশের ওপর যেই রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তা একপেশে ও অগ্রহণযোগ্য।”

উল্টো যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার পরিস্থিতির কথা তুলে ধরে তথ্যমন্ত্রী বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রে এ বছরের প্রথমদিকে নানাভাবে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। প্রতিবছর সেদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে বহু মানুষ হতাহত হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিনা ওয়ারেন্টে অনেক মানুষকে গ্রেপ্তারও করেছে।”

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বুধবার ২০১৯ সালের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বাংলাদেশে গত জাতীয় নির্বাচনে ব্যালটে সিল মারা, বিরোধী দলের পোলিং এজেন্ট ও ভোটারদের ভয় দেখানোর অভিযোগসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা তুলে ধরা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সংবিধানের ‘সুযোগ’ নিয়ে নির্বাচনে সংখ্যারিষ্ঠতা পেয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো শেখ হাসিনা ক্ষমতা পেলেও নানা অনিয়মে কলঙ্কিত হওয়া ওই নির্বাচনকে ‘অবাধ ও সুষ্ঠু বিবেচনা করা যায় না’।

“নির্বাচনী প্রচারণার সময়ও হয়রানি, ভয় দেখানো, নির্বিচার গ্রেপ্তার ও সহিংসতার বিশ্বাসযোগ্য এমনসব খবর ছিল যার কারণে অনেক বিরোধী প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা সভা-সমাবেশ ও অবাধে প্রচার চালাতে পারেননি।”

ওই নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশনের ‘বেশিরভাগ পর্যবেক্ষককে প্রয়োজনীয় সময়সীমার মধ্যে প্রত্যয়নপত্র ও ভিসা দেওয়া হয়নি’ বলেও প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে।

“ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের (ইডব্লিউজি) সদস্য ২২ এনজিওর মধ্যে মাত্র সাতটিকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অনুমতি দিয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, এনজিওবিষয়ক ব্যুরো ও নির্বাচন কমিশন।”

যেসব তথ্যের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্র এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তার উৎসের নির্ভরযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান।

শুক্রবার নিজ নির্বাচনী এলাকা চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনকে ‘অগ্রহণযোগ্য ও একপেশে’ আখ্যা দিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ।

তিনি বলেন, “যাদের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে এই রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে, সেই সমস্ত সংগঠনগুলো ইতিপূর্বেই বাংলাদেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। তারা ইতিপূর্বেও বাংলাদেশের পরিস্থিতির ওপর একপেশে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে।

“ইদানিং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্ট আমরা একপেশে দেখতে পাই। অ্যামনেস্টি বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, যেখানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য বাংলাদেশের মানুষ সোচ্চার।… সর্বগ্রহণযোগ্য বিচার নিয়েও প্রশ্ন তুলে যে অ্যামনেস্টি গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে, তাদের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে রিপোর্ট, সেটি গ্রহণযোগ্য নয়।”

এ ধরনের প্রতিবেদন বিশ্বব্যাপীই গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে বলে মন্তব্য করে তথ্যমন্ত্রী বলে, “সুতরাং আমরা কোনোভাবেই এ রিপোর্টকে গ্রহণ করতে পারি না।”

তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অনেক চমৎকার উল্লেখ করে হাছান মাহমুদ বলেন, “বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ দমনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র একসঙ্গে কাজ করছে। ভবিষ্যতেও আমরা একসঙ্গে কাজ করতে চাই। আমাদের এই কার্যক্রম আরো সুদৃঢ় করতে চাই।”

প্রায় তিন দশক পর গত বছর ১১ মার্চ অনুষ্ঠেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনেও ‘অনিয়ম হয়েছে’ বলে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়।

“নির্বাচন পরিচালনায় থাকা শিক্ষকরা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষে ব্যালটে সিল মেরেছে বলে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছেন।”

বিরোধী রাজনীতি দমনের উদ্দেশে্য ‘বিরোধী দলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা দিতে সরকার আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলিকে ব্যবহার করেছে’ বলে প্রতিবেদনে ইঙ্গিত করা হয়েছে।

“২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে ফৌজদারি অভিযোগে জড়িত করে তাদের অনেককে আটক করেছে বলে বিএনপি বরাবর অভিযোগ করে আসছে।”

এছাড়া দুই ডজনেরও বেশি সাম্প্রতিক মামলা থাকায় একযুগ আগের নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত বিএনপি নেতা খালেদা জিয়া আপিল করেও জামিনের সুযোগ নিতে পারেননি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

“এসবের মধ্যে অনেক অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল বলে মানবাধিকার পর্যবেক্ষকদের দাবি।”

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি)নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। ফাইল ছবি

ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে প্রত্যাখ্যান করা হলেও প্রতিবেদনটিতে ‘বাস্তবতার প্রতিফলন’ ঘটেছে মনে করেন দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এ প্রতিবেদন বাস্তবতারই প্রতিফলন বলে আমার মনে হয়। যে তথ্যগুলো তাদের স্বীকৃতিতে নেওয়া হয়েছে; তারা বিবেচনায় যে স্টাডিগুলো নিয়েছে তা ঠিক আছে মনে হয়।”

“এটা নিয়ে বিভিন্ন মহলে বিতর্ক থাকতে পারে। ওপিনিয়ন, মতামত থাকতে পারে। এটা আমলে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। উত্তরণের জন্য সরকারকে ও সংশ্লিষ্ট  প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার বিকল্প নেই।”

২০১৯ সালে ঘটে যাওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ করে এতে বলা হয়, সরকার বা সরকারের পক্ষে বেআইনিভাবে এবং নির্বিচার হত্যাকাণ্ড, গুম, নির্যাতন ও সরকার বা তার পক্ষে নির্বিচার বা বেআইনি আটক রাখার ঘটনা অব্যাহত রয়েছে।

এছাড়া হিংস্র ও ঝুঁকিপূর্ণ কারা পরিস্থিতি; ব্যক্তিগত গোপনীয়তায় নির্বিচার বা বেআইনি হস্তক্ষেপ, সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের নির্বিচার গ্রেপ্তার, ওয়েসাইট ব্লক করা, অপরাধমূলক মানহানির মতো মানবাধিকার লঙঘনের কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার ও সংঘবদ্ধ হওয়ার স্বাধীনতায় জোরালো হস্তক্ষেপ- যেমন এনজিওদের কার্যক্রমে বিধিনিষেধ; চলাফেরার স্বাধীনতায় উল্লেখযোগ্য বিধিনিষেধ, প্রকৃত, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি করে এমনভাবে রাজনৈতিক অংশগ্রহণে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে বলে যুক্তরাষ্ট্র মনে করে।

মানবপাচার, নারী-পুরুষ ছাড়া ভিন্ন লৈঙ্গিক পরিচয়ের (এলজিবিটি) মানুষদের উপর সহিংসতা ও সমলিঙ্গের যৌন সম্পর্ককে অপরাধ হিসেবে গণ্য করার মতো অপরাধ; স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়ন ও শ্রমিকদের অধিকার নিয়ন্ত্রণ এবং শিশু শ্রমের নিকৃষ্টতম ধরণের ব্যবহার।

প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্যাতন বা নিয়ম লঙ্ঘনের জন্য নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা ব্যাপক দায়মুক্তি পান এবং তাদের বিরুদ্ধে নামমাত্র তদন্ত ও বিচার করা হয়।

বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় উল্লেখযোগ্য সীমাবদ্ধতার উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংবিধানে সংবাদ মাধ্যমসহ মিডিয়াকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দেয়া হলেও অনেক ক্ষেত্রেই সরকার এই অধিকারের প্রতি সম্মান দেখাতে ব্যর্থ হচ্ছে।