পাপিয়ার ওয়েস্টিনযোগ: তদন্তে আসছে সোশাল মিডিয়ায় আসা নাম-ভিডিও

শামীমা নূর পাপিয়ার ওয়েস্টিন হোটেলকেন্দ্রিক কারবারে জড়িত হিসেবে যেসব রাজনীতিক, আমলা, ব্যবসায়ীদের নাম সোশাল মিডিয়ায় ঘুরছে, তাদেরও তদন্তের আওতায় আনছে পুলিশ।

লিটন হায়দার রুদ্র রুদ্রাক্ষ ও কামাল তালুকদারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 March 2020, 06:00 PM
Updated : 3 March 2020, 07:56 PM

পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) সোহেল রানা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই অভিযোগ ও মামলা সংক্রান্ত কিছু ভিডিও এবং কিছু তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে।

“আমরা প্রতিটি বিষয়ই আমলে নিয়েছি। প্রতিটি বিষয়ই গুরুত্ব সহকারে আমরা খতিয়ে দেখছি। এর মধ্যে যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ও রেলেভেন্ট ইলিমেন্ট আমরা পিক করছি। সবকিছু সাপেক্ষেই আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব।”

যুব মহিলা লীগের মতো একটি সংগঠনের একটি জেলার সাধারণ সম্পাদক হয়ে ওয়েস্টিনের মতো পাঁচতারা হোটেলের সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রেসিডেনশিয়াল স্যুইট মাসের পর মাস ভাড়া রেখে পাপিয়ার নানা অপকর্মে প্রভাবশালীদের মদদ থাকার বিষয়টি তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছেও স্পষ্ট।

এরই মধ্যে এতে জড়িত হিসেবে কয়েকজন সচিব, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের কর্মকর্তা, সংসদ সদস্য, টকশোর আলোচক, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীর নাম সোশাল মিডিয়ায় এসেছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, পাপিয়ার সঙ্গে জড়িত হিসেবে বিভিন্নভাবে যাদের নাম আসছে, তাদের মোবাইল ফোনের কল লিস্ট সংগ্রহের কাজ চলছে।

পাপিয়ার কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া মোবাইল ফোনে বহু ভিডিও পাওয়ার কথাও জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা, যেগুলো পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। 

ওয়েস্টিন হোটেলের মূল মালিক ব্যবসায়ী নূর আলীর সঙ্গে পাপিয়ার গল্প করার একটি ভিডিও  ইতোমধ্যে সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল।

 

তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ধারণা, ওয়েস্টিনের মালিক ও পরিচালনা কর্তৃপক্ষের শীর্ষ ব্যক্তিরা পাপিয়ার অপকর্মের কথা ভালোভাবেই জানতেন।

তাই ওয়েস্টিন হোটেলকেও তদন্তের আওতায় আনতে চাইছে র‌্যাব; যারা পাপিয়াকাণ্ডের তদন্তভার আনুষ্ঠানিকভাবে পেতে ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে।

গত ২২ ফেব্রুয়ারি পাপিয়াকে র‌্যাবই গ্রেপ্তার করেছিল; জাল মুদ্রা, অস্ত্র ও মদ উদ্ধারের ঘটনায় তিনটি মামলা তারাই করেছিল।

প্রথমে থানা পুলিশ তদন্ত শুরু করে পাপিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নিলেও একদিন বাদে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় গোয়েন্দা পুলিশকে (ডিবি)।

তিন মামলায় পাপিয়াকে ১৫ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে; জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে তার স্বামী নরসিংদীর সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মফিজুর রহমান ওরফে সুমন চৌধুরী ওরফে মতি সুমনকেও।

পুলিশ কর্মকর্তা সোহেল রানা বলেন, “জিজ্ঞাসাবাদে আমরা যে সব তথ্য পাচ্ছি, সেগুলো আমরা বিশ্লেষণ করছি। তার এই অপকর্মের সাথে যদি অন্য কারও কোনো রকমের সংশ্লিষ্টতা আমরা পাই। আমরা তাদেরকেও বিবেচনায় নিচ্ছি।

“আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব সহকারে এই তদন্তকে বিবেচনা করছি। এইক্ষেত্রে আমাদের চেষ্টা ও আয়োজনের কোনো অপর্যাপ্ততা থাকবে না।”

তিনি জানান, মুদ্রা পাচারের অভিযোগটি সিআইডি তদন্ত করছে।

পাপিয়াকাণ্ডে নানাজনের নাম আসার বিষয়ে সহকারী আইজি সোহেল রানা বলেন, “ইনভলবমেন্ট ও পার্টিসিপেশনের গুরুত্ব ও রেশিও সাপেক্ষে আমরা আইনের বিধিবিধান মোতাবেক উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করব, প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই।”

ওয়েস্টিন হোটেলের প্রেসিডেনসিয়াল স্যুইট

নূর আলীর সঙ্গে পাপিয়ার ভিডিও আসায় তাকে নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে কি না- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “তদন্তের স্বার্থে আমরা প্রত্যেকটি এভিডেন্স ও আলামতকে এবং প্রত্যেকটি উপকরণকে আমরা আমলে নিয়েছি, নিচ্ছি এবং আমাদেরকে নিতে হয়।

“এইক্ষেত্রেও আমরা এটি বিশ্লেষণ করে উপযুক্ততা সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করব।”

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিকে যে বা যারাই সহায়তা করেছে, প্রতিটিই আমলে নেওয়া হবে। অপরাধ সংগঠনে সহায়তার মান ও মাত্রা অনুযায়ী প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অপরাধী প্রভাবশালী হলে পার পেয়ে যাওয়ার পুরনো অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে পুলিশ কর্মকর্তা সোহেল রানা বলেন, “যাকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি, একটি রাজনৈতিক পরিচয় থাকা সত্ত্বেও তাকে গ্রেপ্তার করেছি এবং তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। এক্ষেত্রে কোনো কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।”

তদন্তাধীন বিষয় নিয়ে এর বেশি আর কিছু বলতে রাজি হননি সোহেল রানা।

পুলিশের ডিআইজি রুহুল আমিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তদন্তকারীরা ‘সবকিছুই’ তদন্ত করে দেখবে। অপরাধে কার কতটুকু সংশ্লিষ্টতা, তা দেখা হবে।

তদন্তের দায়িত্বে থাকা ডিবির উপকমিশনার মশিউর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় বলেন, মামলায় যে সব বিষয়ে অভিযোগ আনা হয়েছে, সে সবের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছেন তারা।

পাপিয়ার বিরুদ্ধে জাল মুদ্রা বাজারজাত করার উদ্দেশ্যে বহন এবং অর্থ দেশের বাইরে পাচারের অভিযোগে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলাটি হয়েছে বিমানবন্দর থানায়। অবৈধভাবে আগ্নেয়াস্ত্র নিজ হেফাজতে রাখার অভিযোগে অস্ত্র আইনে এবং বিদেশি মদ চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগে বিশেষ ক্ষমতা আইনে শেরে বাংলা থানায় অন্য দুটি মামলা হয়েছে।

এই তিনটি মামলা ছাড়াও মুদ্রা পাচার আইনে আরেকটি মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে সিআইডি।

সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তারা অনুসন্ধান শুরু করেছেন।

ব্যাংক, সঞ্চয় পরিদপ্তর, রিহ্যাবসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পাপিয়া এবং তার স্বামীর বিষয়ে তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছে সিআইডি। আগামী সপ্তাহে প্রতিবেদন পেলে মামলা হবে।

দুর্নীতি দমন কমিশনও পাপিয়ার সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে। এজন্য পাপিয়ার হোটেল লেনদেনের তথ্য চেয়ে ওয়েস্টিন হোটেল কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছে তারা।

গ্রেপ্তারের পর র‌্যাব হেফাজতে শামীমা নূর পাপিয়া

পাপিয়াকে গ্রেপ্তারের পর সমাজের উঁচুতলার লোকদের জন্য তার ‘যৌনসেবার কারবার’র কথা তুলে ধরে র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক শাফী উল্লাহ বুলবুল সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “তার (পাপিয়া) নামে ওই হোটেলের ‘প্রেসিডেনশিয়াল স্যুইট’ সব সময় বরাদ্দ থাকত।

“হোটেলে নিয়মিত কয়েকজন তরুণী থাকত, যারা তার ‘কাস্টমারদের’ বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণ করত। এজন্য তাদের মাসিক বেতন বরাদ্দ ছিল।”

কিন্তু এনিয়ে কোনো মামলা না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে র‌্যাব -১ অধিনায়ক বুলবুল মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ ধরনের অভিযোগ প্রমাণ করার মতো তাৎক্ষণিকভাবে কোনো আলামত ছিল না। এটার জন্য কিছুটা সময়ের প্রয়োজন।

“গ্রেপ্তারের পর যে বিষয়গুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সেই বিষয়টিকে সামনে রেখে মামলা করা হয়েছে।”

তিনি জানান, র‌্যাবের গোয়েন্দা ইউনিট ওয়েস্টিন হোটেলের সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ এবং সমন্বয়ের কাজ করছে।

“আমরা তদন্তের দায়িত্ব পেলে সব বিষয়ে খতিয়ে দেখব,” বলেন র‌্যাব কর্মকর্তা বুলবুল।

পাপিয়ার বিরুদ্ধে করা মামলা তিনটি তদন্তের ভার পেতে র‌্যাব যে আবেদন করেছে, তা গত রোববার পুলিশ সদর দপ্তর থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গেছে।

র‌্যাব-১-এর অধিনায়ক বুলবুল বলেন, “আবেদনটি মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। আশা করছি, আজ–কালের মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি পাওয়া যাবে।”

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিরাপত্তা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মোস্তাফা কামাল উদ্দীন মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ফাইলটি এখনও তার টেবিলে আসেনি।

মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, “আবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন শাখা ঘুরে তারপর আসবে সচিব ও মন্ত্রীর টেবিলে। তাই একটু সময় তো লাগবে।”

আরও খবর