সোনিয়া-কচি: শেষে মৃত্যুই হল চিরবন্ধন

কর্মক্ষেত্রে পরিচয় থেকে তৈরি হয়েছিল গভীর বন্ধুত্ব; হরিহর আত্মা হয়ে উঠেছিলেন ত্রিশের কোঠার দুই তরুণী। সড়ক দুর্ঘটনায় নির্মম মৃত্যুও তাদের আলাদা করতে পারেনি।

জয়ন্ত সাহা নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Feb 2020, 09:02 AM
Updated : 28 Feb 2020, 09:07 AM

গত মঙ্গলবার রাতে ঢাকার বনানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ যায় বিপণন কোম্পানি পার্ল ইন্টারন্যাশনালের দুই কর্মী সৈয়দা দুলদানা আক্তার কচি ও সোনিয়া আমিনের।

শৈশবে বাবাকে হারানোর পর কচি মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে কিশোরগঞ্জ থেকে জীবিকার সন্ধানে চলে আসেন ঢাকায়। কারও মুখাপেক্ষী না হয়ে স্বাবলম্বী হবেন- এই ছিল স্বপ্ন।

আর সোনিয়া আমিন মাত্র নয় মাস আগে শুরু করেছিলেন জীবনের অন্য এক অধ্যায়। চাকরির সুবাদে ভারতে গিয়ে সেখানে গাঁটছাড়া বাঁধেন এক  তরুণের সঙ্গে। মহারাষ্ট্রে দিব্যি ছিলেন দুজনে। ছোট বোনের অসুস্থতা তাকে ফিরিয়ে আনে দেশে, আবার চাকরি নেন পুরনো প্রতিষ্ঠানে।

পার্ল ইন্টারন্যাশনালে কচি আর সোনিয়ার কাজের ক্ষেত্র ছিল বিপণন বিভাগ। সে বিভাগে কাজ করতে গিয়ে সখ্যতা গড়ে উঠে দুজনার।

সোনিয়া আমিন ও দুলদানা আক্তার কচি

সোনিয়াদের বাড়িতে কচির নিয়মিত যাতায়াত ছিল। সোনিয়ার বাবা মাও কাছে টেনে নিয়েছিলেন বাবা-মা হারা কচিকে।  কচি যেন হয়ে উঠেছিলেন সোনিয়াদের পরিবারের আরেক সদস্য।

সোনিয়ার বোন সোমা আমিন আর কচির বোন চুমকির কাছ থেকে জানা গেল এই দুই বান্ধবীর পথচলার গল্প। 

ভোলার মাছদেলদড়িয়া গ্রামে বাড়ি হলেও সোনিয়ার পরিবার মিরপুরের শাহআলী এলাকায় থাকে বহু বছর ধরে। সোনিয়ার বাবা রুহুল আমিন কাঁচামাল সরবরাহের কাজ করতেন।

সোমা জানান, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পর সোনিয়া পার্ল ইন্টারন্যাশনালের সেলস বিভাগে চাকরি নেন। পরে সুযোগ হয় ভারতে গিয়ে কাজ করার।

“ওখানে মোহসিন সৈয়দের সঙ্গে আপার পরিচয় হয়। বেশ কিছুদিন রিলেশনের পরে তারা বিয়ে করেন। পরে আমাদের জানান, তারা বিয়ে করে মহারাষ্ট্রে আছেন।”

চলতি বছরের শুরুর দিকে রক্তের সংক্রমণে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন সোমা। বোনের অসুস্থতার খবর পেয়ে দেশে চলে আসেন সোনিয়া। পুরনো প্রতিষ্ঠানেই আবার কাজ খুঁজে নেন। টেরিটরি সেলস ম্যানেজার কচির সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ায় নিবিড় বন্ধুত্বে।

সোমা বলেন, “কচি আপা সোনিয়া আপার সঙ্গে প্রায়ই আসতেন আমাদের বাসায়। আব্বা বলত, বাবা মা নাই মা, তুমি আমাদের বাসাতেই তো থাকতে পারো। কচি আপা আমাদের খুব আপন হয়ে গিয়েছিল অল্প দিনে। সোনিয়া আপাও মাঝেমধ্যে গিয়ে কচি আপার বাসায় থাকত। তারা খুব ভালো বন্ধু ছিল।”

কচির স্কুটিতে করে মঙ্গলবার রাতে বাসায় ফেরার পথে দুর্ঘটনায় পড়েন দুই বান্ধবী। সেই স্কুটি নিয়ে প্রায়ই সোনিয়াদের বাসায় যেতেন কচি।

সোমা জানান, মঙ্গলবার এক সিনিয়র বন্ধবীর বাসায় গিয়েছিলেন সোনিয়া আর কচি। সেদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকেও সোনিয়া ফোনে কথা বলেছিলেন বাসায়।

“ফোনে বলেছিল, রাতে আমাদের বাসাতেই থাকবে তুজন। বেশি রাত হওয়ার কথা না। পরে খবরে দেখলাম অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।”

কাঁদতে কাঁদতে সোমা বলতে থাকেন, “ভাই যদি পারেন, কোন গাড়িটা আপাদের স্কুটিরে ধাক্কা দিসিল, সেইটা একটু খুঁজে বের কইরেন। এমন কত ঘটনা হারায়া যায়। কেউ খোঁজ রাখে না। আপনারা আমার আপাদের কথা ভুইল্যা যায়েন না। তাদের ফ্রেন্ডশিপটা একটু দেখেন,… মৃত্যুর আগেও তারা একসাথে ছিল, মৃত্যুর সময়ও দুই বন্ধু একসাথে ছিল।”

কচির বড় বোন চুমকি আক্তার থাকেন কিশোরগঞ্জের ভৈরবে। টেলিফোনে সেখান থেকেই তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন কচির সংগ্রামী জীবনের গল্প।

কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার পালোটিয়া গ্রামের মেয়ে কচি ছোটবেলাতেই বাবাকে হারান। এসএসসি পাস করার পর চলে আসেন ঢাকায়। তেজগাঁ সরকারি মহিলা কলেজে পড়াশোনার পাশাপাশি শুরু করেন চাকরি।

চুমকি বলেন, “ও কলেজে থাকতেই আম্মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়ল। চিকিৎসা করালাম, কিন্তু আম্মা বাঁচলো না। বোনটা আমার একা একাই বাঁচতে চাইল। সবসময় বলত, আপা আমি নিজের পায়ে দাঁড়াব। আমার বোনটা…।”

বড়বোনের স্মৃতিতে ছোটবেলা থেকেই কচি ছিলেন বেশ দুরন্ত। মেয়ে বলে পিছিয়ে থাকার পাত্র তিনি ছিলেন  না। পার্ল ইন্টারন্যাশনালে চাকরি নেওয়ার পর দ্রুত একটি অবস্থান তৈরি করে নিতে পেরেছিলেন।

“আমার বোনটা খুব সাহসী ছিল। পরিবারের সবার প্রতি নজর ছিল। ফোন করত আমাকে। আমার ছেলেটা ঠিকমত স্কুলে যায় কি না… ঠিকমত খায় কি না, দুলাভাই কেমন আছে… সবসময় তার বাড়তি মনযোগ থাকত।”

কচির স্কুটি চালানো নিয়ে ভীষণ আপত্তি ছিল বড় বোন চুমকির।

“স্কুটি কেনার পরে সেটা চালায়ে একবার ভৈরবে আসলো। আমি বকাবকি করলাম। ও বললো, আপা হাইওয়ের জ্যামট্যাম ঠেলে আসতে হয়, স্কুটি হইলে তাড়াতাড়ি আসতে পারি। আমি এরপরও বলছিলাম, ওইটা চালাইস না।  সে কথা শুনল না। ওই স্কুটিই আমার বোনকে কেড়ে নিল। আমার পরিবারের কেউ তো আর থাকল না।”