ইস্কাটনে আগুন: বাবার হাত ফসকে চিরতরে ঝরে গেল রুশদি

ভবনে আগুন লাগার বিষয়টি টের পেয়ে শিশু সন্তান এ কে এম রুশদিকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচের দিকে নামছিলেন বাবা-মা, এক ফাঁকে বাবার হাত ফসকে বেরিয়ে যাওয়া শিশুটি আগুন-ধোঁয়ার সঙ্গে লড়াইয়ে আর টিকল না।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদককামাল হোসেন তালুকদার, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Feb 2020, 01:53 PM
Updated : 27 Feb 2020, 04:15 PM

বৃহস্পতিবার ভোরে ইস্কাটনের দিলু রোডের পাঁচতলা ভবনের তৃতীয় তলার সিঁড়িতে শিশুটির পোড়া দেহ পড়েছিল। তার বাবা শহীদুল কিরমানি রনি (৩৯) ও মা জান্নাতুল ফেরদৌসও (৩৪) মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন শহীদুলের শরীরের ৪৩ শতাংশ এবং জান্নাতের ৯৫ শতাংশ পুড়ে গেছে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। 

ঢাকা মেডিকেলে কথা হয় জান্নাতুল ফেরদৌসীর ভাই শাহাদাত হোসেন বিপ্লবের সঙ্গে।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বোনের শরীর এতটাই পুড়ে গেছে যে তিনি কথা বলতে পারছে না। তবে রনি মৃদু স্বরে কথা বলতে পারছেন।

ইস্কাটনে আগুনে মারা গেছে এ জি চার্চ স্কুলের প্লে গ্রুপের ছাত্র এ কে এম রুশদি, গুরুতর দগ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন বাবা-মা

“রনি জানিয়েছেন, আগুন লাগার পর তারা তিনজন তৃতীয় তলার ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে নিচে আসার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু কীভাবে যেন রুশদি তার হাত থেকে ফসকে যায়। পরে তিনিও পায়ে প্রচণ্ড আঘাত পান।”

ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে নাতির পোড়া দেহ দেখে আসা রনির বাবা এ কে এম শহীদুল্লাহ ছিলেন অশ্রুসজল।

দৈনিক কালের কণ্ঠের সিনিয়র প্রোডাকশন ম্যানেজার শহীদুল্লাহ বলেন, মঙ্গলবারও ছেলে রনির বাসায় গিয়েছিলেন তিনি।

“রুশদিকে নিয়ে সকালবেলা এ জি চার্চ স্কুলে গিয়েছিলাম। দাদা ও নাতির সঙ্গে যে রকম খুনসুঁটি হয়, সে রকমই একটু মজা করেছিলাম,” দীর্ঘঃশ্বাস ছেড়ে বলেন ষাট ছুঁই ছুঁই এই দাদা।

রনির ভগ্নিপতি মনিরুজ্জামানও মর্গে পড়ে থাকা মৃতদেহটি রুশদির বলে জানান।

স্বজনরা জানান, শহীদুল কিরমানি রনি পুলিশ প্লাজায় ‘ভিআইভিপি এস্টেট ম্যানেজমেন্ট’ নামে একটি কোম্পানির ফাইন্যান্স ম্যানেজার। আর তার স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডের অর্থ বিভাগে চাকরি করেন।

তাদের গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর শিবপুরের ইটনা।

আগুন লেগেছিল ভবনের নিচতলার গ্যারেজে। সেখানে দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন একজন, পুড়ে গেছে পাঁচটি গাড়ি। আর তৃতীয় তলায় দগ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়ে শিশু রুশদি ও কলেজছাত্রী আফরিন জাহান জুঁথি। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

ভোর রাত সাড়ে ৪টার দিকে দিলু রোডের ওই পাঁচতলা ভবনের গ্যারেজে আগুন লাগে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের নয়টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আধা ঘণ্টার চেষ্টায় সকাল ৫টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

আগুন নেভানোর পর ভবন থেকে শিশুটি ছাড়াও আরও দুজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। তারা হলেন একটি বায়িং হাউজের কর্মী আব্দুল কাদের লিটন এবং এইচএসসি পরীক্ষার্থী আফরিন জাহান জুঁথি (১৮)।

ভবনের ছাদে দেওয়ালের উপর টিন দিয়ে তৈরি ঘরে জুঁথিদের বসবাস। মেয়েটি এবার ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি (বিজ্ঞান) পরীক্ষার্থী ছিলেন বলে হাতিরঝিল থানার এসআই আবুল বাশার মোল্লা জানান।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে লিটনের শ্যালক জহির আলম বলেন, ‘ক্লাসিক ফ্যাশন ইন্টারন্যাশনাল’ নামে একটা বায়িং হাউজে চাকরি করতেন তার ভগ্নিপতি। ভবনটির গ্যারেজের পাশে ও দ্বিতীয় তলায় ওই কোম্পানির অফিস। লিটন নিচতলায় থাকতেন।

লিটনের মৃতদেহ গ্যারেজে পাওয়া যায় বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা এরশাদ হোসাইন। আর রুশদি ও জুঁথির মৃতদেহ ছিল তিনতলার সিঁড়িতে।

ওই ভবনের নিরাপত্তাকর্মী লুৎফর রহমান বলেন, ভবনের নিচতলার একটি কক্ষে তিনি থাকেন। হঠাৎ দেখতে পান গ্যারেজের একটি ইলেকট্রিক বোর্ডে আগুন লাগে। ওই বোর্ডের পাশে একটি কাঠের চৌকি দাঁড় করানো ছিল। আগুন ওই চৌকিতেও লেগে যায়। এরপর মুহূর্তের মধ্যে একটি গাড়িতে আগুন লেগে যায়।

“তখন দৌড়ে গেইটের বাইরে চলে আসি এবং আগুন আগুন বলে চিৎকার করতে থাকি। আশপাশের মানুষ দৌড়ে এসে যে যার যার মতো ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেয়।”

আগুনে প্রাণহানির খবর শুনে সকালে দিলু রোডের ওই ভবনের সামনে ভিড় করেন উৎসুক জনতা।

এ সময় তিনি সবাইকে নিচে নামতে নিষেধ করেছিলেন জানিয়ে লুৎফর বলেন, “চিৎকার করে বলতে থাকি, ভবনের নিচে নামবেন না, নিচে অনেক আগুন সবাই ছাদে উঠে যান।”

তিনি জানান, ভবনের দ্বিতীয় তলায় একটি ফ্ল্যাট, তৃতীয় তলায় দুটি ফ্ল্যাট, চতুর্থ তলায় একটি ফ্ল্যাট, পঞ্চম তলায় দুই ফ্ল্যাট এবং ছাদে একপাশে দেয়াল তুলে উপরে টিন দিয়ে একটি পরিবার বাস করে। সব মিলিয়ে ভবনে সাতটি পরিবারের বসবাস।

ফ্ল্যাটের বাসিন্দা প্রতিটি পরিবারই এগুলো কিনে নিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ভবনের মূল মালিক আমেরিকায় থাকেন। তবে তার নাম তিনি জানেন না।

ছাদে রুম করে বসবাসকারী জুঁথির বাবা জাহাঙ্গীর আলম (৪২) পূর্ত ভবনে প্রশাসনিক সেকশনে চাকরি করেন। তার মা লাল বানু (৩৫) গৃহিণী।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বহুতল ওই ভবনের দুটি অংশ। যে অংশে গাড়ির গ্যারেজ সেই অংশের উপরের তলায় ভবনের বাইরের অংশে কালো দাগ রয়েছে। অন্য অংশ পরিষ্কার।

নিরাপত্তাকর্মী লুৎফুর রহমান বলেন, ভবনের দুটি অংশ হলেও বেরোনোর গেইট একটি।

পাশের ভবনের মালিক আকবর রশিদ বলেন, আগুন আগুন চিৎকার শুনে তিনি ঘর থেকে বের হয়ে আসেন। নিজের ভবনের বিদ্যুতের মেইন সুইচ বন্ধ করে দেন।

পাশের আরেক ভবনের বাসিন্দা একজন নারী বলেন, “চিৎকার শুনে প্রথমে মনে করেছিলাম কোনো চুরি বা ডাকাতির ঘটনা। কিন্তু পরে ধোঁয়া দেখে বুঝলাম আগুন লেগেছে।”

দিলু রোড থেকে ভবনটিতে যেতে এই গেইটের কারণে বাধা পায় ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি, পরে পাইপ দিয়ে পানি নিয়ে নেভানো হয় আগুন।

দিলু রোড থেকে এই ভবনে আসতে একটি গেইট দিয়ে ঢুকে বেশ খানিকটা এগোতে হয়। ‘ইউনাইটেড ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন’ লেখা ওই গেইটের কারণে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ভেতরে ঢুকতে পারেনি বলে স্থানীয়রা।

প্রায় ১০০ গজ দূরে গাড়ি রেখে পাইপে পানি নিয়ে আগুন নেভাতে হয়েছে বলে জানান তারা।

আগুনের খবর শুনে প্রথমে ফায়ার সার্ভিসের যারা ঘটনাস্থলে এসেছিলেন, তাদের নেতৃত্বে ছিলেন তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মো. ফয়সালুর রহমান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ভোর ৪টা ৩২ মিনিটে আগুনের খবর পান এবং ৪টা ৪০ মিনিটে ঘটনাস্থলে পৌঁছে যান।

“কিন্তু সড়কের তার এবং ওয়েলফেয়ার গেটের জন্য ভেতরে প্রবেশ করতে পারিনি। পরে পাইপ টেনে পানি নিয়ে আগুন নেভাতে হয়েছে।”

ওই ভবনে আগুন নির্বাপণের কোনো বন্দেোবস্ত ছিল না বলে জানান তিনি।

নিচে কোনো রাসায়নিকের গুদাম ছিল কি না জানতে চাইলে নিরাপত্তাকর্মী লুৎফুর রহমান বলেন, “নিচের গুদামে কাপড়, সুতা ও বিভিন্ন ধরনের কার্টন ছিল। কোনো কেমিকেল ছিল না।”

এই অগ্নিকাণ্ডে ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়া সুমাইয়া আক্তার (৩০), মাহাদি (৯) ও মাহমুদুল হাসান (৯ মাস) নামে আরও তিনজনকে ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা দেওয়া হয়। তারা ওই ভবনের পঞ্চম তলার বাসিন্দা। সবাই এখন শঙ্কামুক্ত বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।