পিকে হালদারের ব্যাংক হিসাব জব্দই থাকছে

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেডের (আইএলএফএসএল) অর্থ পাচারের ঘটনায় এর সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার হালদারসহ ২০ জনের ব্যাংক হিসাব ও পাসপোর্ট জব্দে হাই কোর্ট আদেশ বহাল রেখেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Feb 2020, 10:29 AM
Updated : 26 Feb 2020, 10:29 AM

হাই কোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে কোম্পানি ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের করা আবেদনের শুনানি করে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন চার বিচারকের আপিল বেঞ্চ বুধবার এ আদেশ দেয়।

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী তানজিব-উল আলম। আর ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের দুই পরিচালকের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী আহসানুল করিম।

এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার) ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের কোটি কোটি টাকা লোপাট করে বিদেশে পালিয়েছেন বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে।

টাকা ফেরত চেয়ে আইএলএফএসএলের ৭ বিনিয়োগকারীর করা মামলার শুনানি করে বিচারপতি মোহাম্মদ খুরশিদ আলম সরকারের হাই কোর্ট বেঞ্চ গত ১৯ জানুয়ারি পি কে হালদারের মা, স্ত্রী, ভাই, এবং ওই কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তাসহ মোট ২০ জনের পাসপোর্ট জব্দের আদেশ দেয়।

স্বরাষ্ট্র সচিবকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়, যাতে ওই ব্যক্তিরা কোনোভাবেই দেশ ছাড়তে না পারেন। এ নির্দেশ বাস্তবায়ন করে ১৫ দিনের মধ্যে আদালতকে জানাতে বলা হয় আদেশে।

পাশাপাশি বিচারাধীন মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আদালত ওই ২০ জনের নগদ অর্থ, গাড়ি, মজুদসহ স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি কোনও ব্যক্তি বা সত্তার কাছে হস্তান্তর না করতে নির্দেশ দেয়।

পি কে হালদার ছাড়া বাকিরা হলেন- আইএলএফএসএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম নুরুল আলম, পরিচালক জহিরুল আলম, এমএ হাশেম, নাসিম আনোয়ার, বাসুদেব ব্যানার্জী, পাপিয়া ব্যানার্জী, মোমতাজ বেগম, নওশেরুল ইসলাম, আনোয়ারুল কবির, প্রকৌশলী নুরুজ্জামান, আবুল হাশেম, মো. রাশেদুল হক, পি কে হালদারের মা লীলাবতী হালদার, স্ত্রী সুস্মিতা সাহা, ভাই প্রিতুষ কুমার হালদার, চাচাত ভাই অমিতাব অধিকারী, অভিজিৎ অধিকারী, ব্যাংক এশিয়ার সাবেক পরিচালক ইরফান উদ্দিন আহমেদ, পি কে হালদারের বন্ধু উজ্জ্বল কুমার নন্দী।

সেই সঙ্গে আদালত আইএলএফএসএলের এর স্বাধীন পরিচালক ও চেয়ারম্যান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ইব্রাহিম খালেদকে নিয়োগ দেয়।

নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগের বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়ে জানাতে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে নির্দেশ দিয়ে আদালত সেই আদেশে বলে, নতুন চেয়ারম্যানকে সুসজ্জিত স্বতন্ত্র অফিস কক্ষসহ মাসিক সম্মানী হিসেবে ৩ লাখ টাকা দিতে হবে।

এছাড়া পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত পি অ্যান্ড এল ইন্টারন্যাশনাল, পি অ্যান্ড এল অ্যাগ্রো, পি অ্যান্ড এল ভেনচার, পি অ্যান্ড এল বিজনেস এন্টারপ্রাইজ, হল ইন্টারন্যাশনাল, হল ট্র্যাভেলস, হল ট্রিপ, হল ক্যাপিটাল, হল টেকনোলোজি, আনন ক্যামিকেল, নর্দার্ন জুট, সুখন্দা লিমিটেড অ্যান্ড রেপটাইল ফার্ম সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যসহ প্রতিবেদন ১৫ দিনের মধ্যে যৌথমূলধনী কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরের নিবন্ধককে দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

হাই কোর্টের সে আদেশ চ্যালেঞ্জ করে আপিল বিভাগে আবেদন করেন আইএল এফ এসএল– এর দুই অংশীদার পরিচালক।

তাদের সেই আবেদন খারিজ করে দিয়ে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন চার বিচারকের আপিল বেঞ্চ বুধবার হাই কোর্টের আদেশ বহাল রাখলো।

আদেশের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবী তানজীব-উল আলম সাংবাদিকদের বলেন, “হাই কোর্ট খন্দকার ইব্রাহীম খালেদ সাহেবকে নিয়োগ দেওয়ার পর এ পর্যন্ত দুটি মিটিং করেছেন। এখন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ সাহেবের পরবর্তী পদক্ষেপের উপর নির্ভর করবে বাংলাদেশ ব্যাংক কী করবে।

“আইএলএফএসএল দেউলিয়া হোক তা বাংলাদেশ ব্যাংক চায় না। প্রতিষ্ঠানটি যাতে দেউলিয়া না হয় সেজন্য পরিচালকদের সাথে বসে আলোচনা করে সরকার পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে আশা করি।” 

পি কে হালদার যে টাকা বিদেশে পাচার করেছে সেটা আনা সম্ভব কিনা, এমন প্রশ্নে তানজীব উল আলম বলেন, ওই টাকা ফেরত আনার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংক বা ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের না। 

“যেহেতু সে একটা অপরাধ করেছে, এ বিষয়ে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। দুদক আছে। অর্থ পাচার আইনের বিষয়ে কয়েকটা প্রতিষ্ঠান আছে। ওই সব প্রতিষ্ঠান তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবে।

তিনি বলেন, “যে দেশে টাকা পাচার হয়েছে সে দেশের সঙ্গে মিউচুয়্যাল কো অপারেশেন চুক্তি আছে কি না সেটা দেখতে হবে। পত্রিকায় দেখেছি সে (পি কে হালদার) সম্ভবত টাকাটা কানাডায় নিয়ে গেছে। কানাডার সাথে বাংলাদেশ সরকারের ওই চুক্তিটা আছে।

“এ চুক্তির অওতায় সরকার যদি কানাডাকে জানায় যে, পি কে হালদার পাচার করা টাকা নিয়ে কানাডায় অবস্থান করছে। তাহলে ওই চুক্তির আওতায় কানাডা সরকার সহযোগিতা করবে বলে আমার বিশ্বাস। সে অনুযায়ী টাকাটা নিয়ে আসতে হবে।“

আরেক প্রশ্নে এ আইনজীবী বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনার উদাহরণ টানেন।

তিনি বলেন, “এর আগেও বিদেশে থেকে পাচার করা টাকা ফেরত আনার উদাহরণ আছে। আপনারা দেখেছেন সিঙ্গাপুর থেকে আরাফাত রহমান কোকো পাচার করা টাকা এসেছে। একই পদ্ধতিতে কানাডা থেকেও আনা যাবে যেহেতু চুক্তিটা আছে। এটার জন্য অ্যাটর্নি জেনারেলকে বিরাট ভূমিকা পালন করতে হবে।”

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, “অর্থ ফেরত আনার ব্যাপারে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় সেন্ট্রাল অথরিটি হিসেবে ছিল, এখন নেই।

“সেন্ট্রাল অথরিটি হিসেবে আগে যে সমস্ত রিকোয়েস্ট আমি পাঠিয়েছিলাম, সেগুলোর ব্যাপারে আমি কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। আমার মতে নতুন কোনো রিকোয়েস্ট পাঠাতে হলে সেটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পাঠাতে হবে।”

ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের দুই পরিচালকের আইনজীবী আহসানুল করিম সাংবাদিকদের বলেন, “পরিচালকদের ব্যাংক হিসাব জব্দ আছে, ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আছে। এর ফলে কোম্পানি চলছিল না। তাই আমরা আপিলের গিয়েছিলাম। এই বাধ্যবাধকতাগুলো পি কে হালদার ও তার সহযোগীদের জন্য আরোপ করা হোক। তাদের ধরা হোক। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটিকে বাঁচতে দেওয়া হোক।”

অবৈধ ব্যবসা ও কার্যক্রমের মাধ্যমে পৌনে ৩০০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) একটি মামলা করেছে।