পাপিয়ার লাখ লাখ টাকার কারবার চলত নগদে: র‌্যাব

থাকতেন পাঁচ তারকা ওয়েস্টিন হোটেলের বিলাসবহুল কক্ষে, যার খরচ মিটিয়েছেন কোটি টাকা; ব্যবহার করতেন পাঁচটি গাড়ি; হোটেল কর্মচারীদের প্রতিদিন টিপসই দিতেন ৮-১০ হাজার টাকা।

লিটন হায়দার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Feb 2020, 02:54 PM
Updated : 27 Feb 2020, 06:48 PM

যুব মহিলা লীগের নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ বিশাল এই ব্যয় নগদেই মেটাতেন বলে জানিয়েছেন র‌্যাব কর্মকর্তারা। কিন্তু এই অর্থ তিনি পেতেন কোথায়- তার বৈধ কোনো উৎস পাওয়া যায়নি।

র‌্যাব কর্মকর্তাদের ধারণা, মাদক-অস্ত্র চোরাচালান, জমি দখল করিয়ে দেওয়া, হোটেলে নারীদের দিয়ে যৌন বাণিজ্য থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আসত ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠনের এই নেত্রীর হাতে।

চার মাস আগের ক্যাসিনো অভিযানের মতোই গত শনিবার ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে পাপিয়াকে গ্রেপ্তার এখন সারাদেশে আলোচিত ঘটনা। 

নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন পাপিয়া। গ্রেপ্তারের পর তাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দলীয় পরিচয়ের কারণে তিনি ছাড় পাবেন না বলেও প্রতিশ্রুতি এসেছে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছ থেকে।

ভারত যাওয়া সময় বিমানবন্দরে গ্রেপ্তার হন পাপিয়া, তার স্বামী নরসিংদীর সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মফিজুর রহমান ওরফে সুমন চৌধুরী ওরফে মতি সুমন এবং তাদের সহযোগী আরও দুজন।

ভারতে যাওয়ার সময়ও পাপিয়া ওয়েস্টিন হোটেলের প্রেসিডেনসিয়াল  স্যুইটের বুকিং বাতিল করেননি বলে জানিয়েছেন র‌্যাব-১ এর উপঅধিনায়ক সাফাত জামিল ফাহিম, যার একটি কক্ষের প্রতি দিনের ভাড়া দেড় লাখ টাকার বেশি।

তিনি সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত বছরের ১২ অক্টোবর সে প্রথম হোটেল ওয়েস্টিনের প্রেসিডেনসিয়াল স্যুইটটি ভাড়া নেয়। গ্রেপ্তারের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তার নামেই ছিল এই স্যুইট। তবে মাঝে বেশ কিছুদিন ছিলেন না।”

সাফাত জামিল জানান, এই স্যুইটে মোট চারটি কক্ষ। তবে আরও দুটো কক্ষ ভাড়া নেওয়া ছিল পাপিয়ার নামে।

গ্রেপ্তার পাপিয়ার বিরুদ্ধে যে মামলাগুলো হয়েছে, তার বিবরণ অনুযায়ী মোট ৫১ দিন ওই কক্ষ ছিলেন শামীমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ। আর এ জন্য বিল মিটিয়েছেন ৮১ লাখ ৪২ হাজার ৮৮৭ টাকা। আর এই হোটেলে এই সময়ের জন্য অবস্থানকালে বার ব্যবহারের জন্য ব্যয় করেছেন এক কোটি ২৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। প্রতিদিন হোটেল বেয়ারাদের টিপস দিতেন ৮/১০ হাজার টাকা।

এই বিল পাপিয়া নগদেই মেটাতেন জানিয়ে র‌্যাব কর্মকর্তা ফাহিম বলেন, তিনি কোনো চেক কিংবা ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেননি।

বিশাল অঙ্কের এই অর্থের উৎস কী, তার খোঁজ র‌্যাব কর্মকর্তারাও করছেন। তারা এটুকু নিশ্চিত এই অর্থ বৈধ পথে আসেনি।

র‌্যাব কর্মকর্তা সাফাত বলেন, দুটি র‌্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া তার আয়ের অন্য কোনো উৎস পাওয়া যায়নি।

পাপিয়ার ব্যবসার মধ্যে একটি ‘কার একচেঞ্জ’ নামে এফডিসি গেইটের পাশের একটি দোকান। এছাড়াও নরসিংদীতে একটি গাড়ি সার্ভিসিংয়ের প্রতিষ্ঠান।

‘কার একচেঞ্জ’ নামের দোকানের প্রকৃত মালিক জুবায়ের নামে এক ব্যাক্তি। এই প্রতিষ্ঠানে এক কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন পাপিয়া। এই টাকার কোন উৎস পায়নি র‌্যাব।

র‌্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, পাপিয়া এই টাকার উৎস বলতে পারেননি।

পাপিয়াকে গ্রেপ্তারের পর র‌্যাবের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ঢাকার ইন্দিরা রোডে তার দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট রয়েছে। নরসিংদী শহরে দুটি ফ্ল্যাট, গাড়ি, নরসিংদীর বাগদী এলাকায় কোটি টাকা মূল্যের দুটি প্লট রয়েছে।

গ্রেপ্তারের পর ওয়েস্টিনে পাপিয়ার নামে বুক করা প্রেসিডেনশিয়াল স্যুইট এবং ইন্দিরা রোডের 'রওশনস ডমিনো রিলিভো' ভবনে পাপিয়ার দুটি অ্যাপার্টমেন্টে অভিযান চালায় র‌্যাব।

কাছাকাছি সময়ে নরসিংদী শহরের ভাগদীতে পাপিয়ার বাবার বাড়ি এবং পশ্চিম ব্রাহ্মন্দীতে তার শ্বশুরবাড়িতেও অভিযান চলে।

ঢাকায় হোটেল কক্ষ আর পাপিয়ার বাসা থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, ২০ রাউন্ড গুলি, পাঁচ বোতল মদ, ৫৮ লাখ ৪১ হাজার টাকা, পাঁচটি পাসপোর্ট ও কিছু বিদেশি মুদ্রা উদ্ধারের কথা জানায় র‌্যাব।

গ্রেপ্তারের পর র‌্যাব হেফাজতে শামীমা নূর পাপিয়া

সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক শাফী উল্লাহ বুলবুল বলেছিলেন, “সুনির্দিষ্ট পেশা না থাকলেও তারা (পাপিয়া ও তার স্বামী) স্বল্প সময়ে বিশাল সম্পত্তি ও অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েছেন। এই বিশাল অর্থের প্রকৃত উৎস জানতে চাওয়া হলে সন্তোষজনক কোনো জবাব তারা দিতে পারেননি।”

র‌্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, মাদক-অস্ত্র, চোরাচালান, যৌন ব্যবসার সঙ্গে তদবির বাণিজ্যও ছিল পাপিয়ার অর্থের উৎস।

পাপিয়ার পাঁচটি গাড়ি ব্যবহারের প্রমাণ ইতোমধ্যে পেয়েছে র‌্যাব। বিভিন্ন ব্যবসায়ী এবং রাজনৈতিক নেতারা হোটেলে তার কাছে আসত বলে র‌্যাব তথ্য পেয়েছে। অনেকের সঙ্গে পাপিয়ার ছবি এখন সোশাল মিডিয়ায়ও ভাইরাল।

তবে কারা আসতেন এবং কী জন্য আসতেন, সে বিষয়ে এখনও নিশ্চিত কিছু  বলতে পারেনি র‌্যাব।

র‌্যাব-১ এর উপঅধিনায়ক সাফাত বলেন, “যে সময়কাল এই হোটেলে অবস্থান করেছিল সে, সেই সময়কালের সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া গেলে জানা যাবে। আমরা তদন্তের দায়িত্ব পেলে সিসিটিভি ফুটেজের জন্য হোটেল কর্তৃপক্ষের সহায়তা চাইব।”

পাপিয়া ওয়েস্টিনে অবস্থান কালে তার স্বামী সুমনও মাঝে মাঝে এসে থাকতেন বলে জানান র‌্যাব কর্মকর্তারা। যে চার তরুণীকে হোটেল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে, তারা পাপিয়ার বেতনভুক্ত বলে র‌্যাবে জানায়।

“রাজকীয়ভাবে এই মেয়েদের দিয়ে পাপিয়া তার নিজের বড় ওড়না পেছন থেকে ধরাতেন, এমন দৃশ্যও দেখেছেন অনেকে,” বলেন সাফাত জামিল।

রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে শামীমা নূর পাপিয়াকে

পাপিয়ার বিরুদ্ধে জাল মুদ্রা, অস্ত্র ও মদ উদ্ধারের ঘটনায় মোট তিনটি মামলা হয়েছে। ওই মামলায় তাকে ১৫ দিনের পুলিশ রিমান্ডেও পাঠিয়েছে আদালত।

“আমরা তদন্ত করছি। রিমান্ডে তার কাছ থেকে অনেক তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে,” বলেন র‌্যাব কর্মকর্তা সাফাত।

নরসিংদীর বাগদী মার্কাস এলাকায় পাপিয়ার একটি সেমি পাকা ঘর রয়েছে। তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে বা কোনো কাজ করলে সেখনে নিয়ে নির্যাতন করা হত বলে র‌্যাব জানতে পেরেছে।

র‌্যাব বলছে, নরসিংদী এলাকায় পাপিয়া ও সুমনের একটি ‘ক্যাডারবাহিনী’ আছে। যাদের মাধ্যমে নরসিংদীর বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসাসহ আধিপত্য বিস্তারের কাজগুলো তারা করতেন।

পাপিয়াকে গ্রেপ্তারে অভিযানে থাকা র‌্যাবের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, পাপিয়ার ধর্মীয় আচরণ পালনও বেশ জটিল।

এক কর্মকর্তা বলেন, পাপিয়া শিবলিঙ্গের পূজা করতেন, কালী পূজা করতেন নিয়মিত। আবার খ্রিস্টান ধর্মের প্রতীক ক্রুসও ব্যবহার করতেন। আবার কাবা শরিফের লোগোও নিজের কাছেও রাখতেন। খাজা মঈনুদ্দিন চিশতীর (রহ) নামের অদ্যাক্ষর দিয়ে নিজেদের দেহে ট্যাটুও করান তিনি।

“অবৈধভাবে অর্থ আয়ের জন্য প্রতিটি ধর্মের লোকদের বিশ্বাস স্থাপন করতে এটা তার কৌশল হতে পারে “ বলেন এক র‌্যাব কর্মকর্তা।