সোমবার ধানমন্ডিতে পিবিআই সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে ব্যুরোর মহাপরিচালক বনজ কুমার মজুমদার বলেন, চিত্রনায়িকা শাবনূরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে পারিবারিক কলহ আর স্ত্রী সামিরা হকের কারণে মা নিলুফা চৌধুরী ওরফে নীলা চৌধুরীকে ছেড়ে থাকার মানসিক যন্ত্রণায় ভুগেই অভিমানী সালমান শাহ আত্মহত্যার পথ বেছে নেন বলে তাদের মনে হয়েছে।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তার মধ্যে ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ইস্কাটন রোডে নিজের বাসা থেকে সালমান শাহর (চৌধুরী মোহাম্মদ শাহরিয়ার ইমন) লাশ উদ্ধার করা হয়।
তখন ঘটনাটিকে আত্মহত্যা ধরে সে সময় অপমৃত্যু মামলা হলে তাতে আপত্তি জানায় তার পরিবার। ১৯৯৭ সালে সিআইডির তদন্ত প্রতিবেদনে ঘটনাটিকে ‘আত্মহত্যা’ এবং ২০১৪ সালে বিচার বিভাগীয় তদন্তে ‘অপমৃত্যু’ বলা হয়। সালমানের মা নীলা চৌধুরী সেসব প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করলে তদন্তভার আসে পিবিআইয়ের হাতে।
সালমানের স্ত্রী সামিরা এখন সামিরা হক ওয়াইজ
সহকর্মী শাবনূরের সঙ্গে সিনেমার শুটিংয়ে সালমান শাহ
সালমান শাহর প্রথম ও দ্বিতীয় সুরতহাল প্রতিবেদন, ভিসেরা রিপোর্ট, কেমিক্যাল রিপোর্ট, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন, বিশেষজ্ঞ মেডিকেল বোর্ডের মতামত, হস্তলিপি বিশারদের মতামত, সালমান শাহর বাসায় প্রবেশ ও বের হওয়ার পথ নিয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত, জব্দ করা আলামত, আগের তদন্ত প্রতিবেদন ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য পর্যালোচনা করে পিবিআই ৬০৯ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছে জানিয়ে ব্যুরোর প্রধান বলেন, মঙ্গলবার এই প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়া হবে।
“তদন্তে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে, সালমান শাহ খুন হননি; সালমান শাহর মৃত্যুর ঘটনাটি আত্মহত্যা জনিত।”
সালমান শাহর মৃত্যুর এক বছর ১৯৯৭ সালের ২৪ জুলাই তার বাবা কমরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী হত্যার অভিযোগ তুলে অপমৃত্যুর মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত করার আবেদন জানিয়েছিলেন।
তখন অপমৃত্যুর মামলার সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগের বিষয়টি একসঙ্গে তদন্ত করতে সিআইডিকে নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। ১৯৯৭ সালের ৩ নভেম্বর আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে সিআইডি জানায়, তারা আত্মহত্যার আলামতই পেয়েছে।
২০১৪ সালের ৩ আগস্ট ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের কাছে বিচার বিভাগীয় তদন্তের প্রতিবেদন দাখিল করেন মহানগর হাকিম ইমদাদুল হক। তাতে অপমৃত্যুর কথাই বলা হয়।
নীলা চৌধুরী বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদনও প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি ২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মহানগর হাকিম জাহাঙ্গীর হোসেনের আদালতে ওই প্রতিবেদনের বিষয়ে ‘নারাজি আবেদন’ দাখিল করেন।
তখন হত্যাকাণ্ডের আসামি হিসেবে সালমানের স্ত্রী সামিরা, তার মা লতিফা হক লুসি, ব্যবসায়ী ও চলচ্চিত্র প্রযোজক আজিজ মোহাম্মদ ভাই, রুবি, রিজভী আহমেদ ওরফে ফরহাদ, সহকারী নৃত্যপরিচালক নজরুল শেখ, ডেভিড, আশরাফুল হক ডন, মোস্তাক ওয়াইদ, আবুল হোসেন খান ও গৃহকর্মী মনোয়ারা বেগমের নাম উল্লেখ করেন নীলা চৌধুরী।
এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ‘বিউটিশিয়ান’ রাবেয়া সুলতানা রুবি ২০১৭ সালে ফেইসবুকে এক ভিডিওতে বলেন, আত্মহত্যা নয়, হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন সালমান শাহ এবং তা করিয়েছিল তারই স্ত্রী সামিরা হকের পরিবার।
এ নিয়ে তুমুল আলোচনা শুরুর পর আবার নিজের ওই বক্তব্য অস্বীকার করেছিলেন এই নারী। তবে সালমান শাহর পরিবার হত্যার অভিযোগ নিয়ে বরাবরই অনড় ছিল।
সোমবার পিবিআইয়ের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, মৃত্যুর সময় সালমান শাহ পরনে যে পোশাক ছিল, তার পকেটে পাওয়া গিয়েছিল আত্মহত্যার চিরকুট। সেই চিরকুট হস্তলিপি বিশারদকে দিয়ে পরীক্ষা করানো হয়েছে। তিনি ওই লেখা সালমান শাহের বলে মতামত দিয়েছেন।
১.সালমান শাহ ও চিত্রনায়িকা শাবনূরের অতিরিক্ত অন্তরঙ্গতা।
২. স্ত্রী সামিয়ার সঙ্গে দাম্পত্য কলহ।
৩. মাত্রাধিক আবেগপ্রবণতা ( এ কারণে আগেও একাধিকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন)।
৪. মায়ের প্রতি অসীম ভালোবাসা এবং জটিল সম্পর্কের বেড়াজালে পড়ে পুঞ্জীভূত অভিমান।
৫. সন্তান না হওয়ায় দাম্পত্য জীবনে অপূর্ণতা।
সালমানের বাসায় রান্নার কাজ করা মনোয়ারা বেগমের জবানবন্দির বরাতে পিবিআই মহাপরিচালক বনজ কুমার মজুমদার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সালমান তার স্ত্রী সামিরা এবং শাবনূর দুজনকেই খুব ভালোবাসতেন।
“তিনি শাবনূরকেও বিয়ে করে দুই স্ত্রী নিয়ে সংসার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সামিরা সতীনের সংসার করতে রাজি হননি। ”
নব্বইয়ের দশকে ঢাকাই সিনেমার সবচেয়ে জনপ্রিয় জুটি ছিল সালমান-শাবনূর
বলা হয়, মাত্র সাড়ে পাঁচ বছরের চলচ্চিত্র-জীবনে ২৭টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করা সালমান শাহ ঢাকাই সিনেমার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। নব্বইয়ের দশকে যারা বয়সে ছিলেন কিশোর-তরুণ, তাদের অনেকের হৃদয়েই সালমান শাহ বাংলাদেশের ‘সেরা রোমান্টিক অভিনেতা’ হয়ে থাকবেন।
রুপালি পর্দার সালমান শাহর আনুষ্ঠানিক সাম শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন। সিলেটের জকিগঞ্জে নানাবাড়িতে ১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর তার জন্ম। কমর উদ্দিন চৌধুরী ও নীলা চৌধুরীর বড় ছেলে ছিলেন তিনি।
আদমজি ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ড. মালেকা সায়েন্স ইনস্টিটিউট থেকে গ্র্যাজুয়েশন করা ইমন ১৯৯২ সালে বিয়ে করেন সাবেক ক্রিকেটার শফিকুল হক হীরার মেয়ে সামিরাকে; তখন তার বয়স ২২ বছর। সামিরার মায়ের ছিল বিউটি পার্লারের ব্যবসা।
মঈনুল আহসান সাবেরের লেখা ধারাবাহিক নাটক ‘পাথর সময়’ এর একটি চরিত্র দিয়ে ইমনের অভিনয় ক্যারিয়ার শুরু। ১৯৯৩ সালে তিনি রূপালী পর্দায় আবির্ভূত হন সালমান শাহ নামে।
কেয়ামত থেকে কেয়ামত সিনেমার পোস্টার
শহুরে আধুনিক শিক্ষিত তরুণের ইমেজ দিয়ে দর্শকদের মন জিতে নেওয়া সালমানের অধিকাংশ সিনেমা ব্যবসা সফল হওয়ায় নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে তার চাহিদা ছিল তুঙ্গে।
‘অন্তরে অন্তরে’, ‘দেনমোহর’, ‘স্বপ্নের পৃথিবী’, ‘তোমাকে চাই’, ‘বিচার হবে’, ‘আনন্দ অশ্রু’, ‘প্রেমযুদ্ধ’, ‘এই ঘর এই সংসার’, ‘সত্যের মৃত্যু নেই’, ‘মায়ের অধিকার’, ‘আশা ভালোবাসা’সহ সালমান অভিনীত সিনেমাগুলো মধ্যবিত্ত দর্শককে হলে ফেরায়।
মৌসুমীর পাশাপাশি শাবনাজ, লিমা, শিল্পী, বৃষ্টির বিপরীতে বিভিন্ন সিনেমায় দেখা গেছে সালমান শাহকে, তবে শাবনূরের সঙ্গেই তার রসায়ন সবচেয়ে বেশি দর্শকপ্রিয় হয়। এই জুটির ১৪টি সিনেমাই বক্স অফিসে দারুণ সাফল্য পায়।