প্রান্তের কাছে নিভু নিভু ভাষাগুলো

রক্ত দিয়ে মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ে বিশ্বজুড়ে সমাদৃত বাঙালির এই জনপদেই দায়িত্বশীলদের অবহেলা-অযত্নে হারিয়ে যেতে বসেছে অনেকগুলো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মায়ের ভাষা।

রিয়াসাদ সানভীজয়ন্ত সাহা ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Feb 2020, 04:26 PM
Updated : 21 Feb 2020, 06:07 AM

শিক্ষা, কর্মসংস্থান, এমনকি ঘরের বাইরে পা ফেললে অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ কোথাও এসব ভাষার চল না থাকায় সেগুলোর টিকে থাকাই এখন কঠিন হয়ে পড়ছে বলে জানিয়েছেন এসব ভাষা গোষ্ঠীর সদস্যরা।

২০১০ সালের শিক্ষা নীতিতে আদিবাসী শিশুদের নিজেদের ভাষা শেখার সুযোগ করে দেওয়ার লক্ষ্যে তাদের জন্য আদিবাসী শিক্ষক ও পাঠ্যপুস্তকের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছিল। আদিবাসী অধ্যুষিত যে সব এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই সেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের কথাও বলা হয়েছিল।

এরপর দশককাল কাটলেও এগুলোর বাস্তবায়ন ঘটেনি। এখনও অনেকগুলো ভাষার লিখিত রূপই নেই, তা করার কোনো উদ্যোগও দৃশ্যমান হয়নি। আবার কয়েকটি ভাষায় প্রাক প্রাথমিকের বই প্রণয়ন করা হলেও সব এলাকার জনগোষ্ঠীর কাছে তা পৌঁছায়নি।

কেন পৌঁছায়নি তা জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের শীর্ষ কর্তা বলেছেন, স্থানীয় প্রশাসন থেকে তথ্য দেওয়ার পর সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেন তারা।

তবে উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা বলেছেন, তার এলাকায় এই ভাষিক গোষ্ঠীর মানুষ আছে, তা এই প্রতিবেদকের কাছেই প্রথম শুনলেন তিনি।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখন ৪০টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ১৪টি ভাষাকে বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন গবেষকরা।

বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা চর্চার কী অবস্থা, তার একটি ধারণা পেতে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলায় বসবাসরত বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর মাঝে যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

বিপন্ন হিসেবে যে ১৪টি ভাষাকে চিহ্নিত করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে ‘সৌরা’ ভাষা, শ্রীমঙ্গলের সীমান্তবর্তী গ্রাম রাজঘাটে বসবাস সৌরা জনগোষ্ঠীর। পেশায় তারা চা বাগানের শ্রমিক।

রাজঘাটের সৌরা পল্লীতে ২২টি পরিবারের বাস। সেখানকার অধিবাসীরা জানান, তাদের আদি নিবাস ভারতের রাঁচিতে। উনিশ শতকের প্রথম দিকে সিলেটের উত্তরভাগে পাল্লাকামডি চা বাগান তৈরি হয়। সে সময় তারা এখানে এসে বসতি গাড়েন।

নিজেদের ভাষার চর্চা নিয়ে জানতে চাইলে পল্লীর বাসিন্দা যামিনী সৌরা বলেন, “পরিবারের মধ্যে এই ভাষায় কথা বললেও বাইরে গিয়ে এ ভাষায় কথা বলার সুযোগ নেই। আজকাল অনেকে এ ভাষাকে উড়িয়া বা জংলি ভাষার সাথে মিলিয়ে ফেলে। আমাদের তাই কথা বলতে হয় বাংলা ভাষায়। চা বাগানের ভেতরে কেউ কেউ উড়িয়াতেও কথা বলেন।” 

নিজ ভাষায় কথা বলতে না পেরে অশীতিপর উর্মিলা সৌরা জীবন সায়াহ্নে এসে ফিরে যেতে চান তার আদি নিবাসে।

“ইচ্ছে তো করে রাঁচিতে ফিরে যাই। নিজের ভাষায় প্রাণ খুলে কথা বলি। এখানে তো গ্রাম থেকে বের হলেই আর সৌরা ভাষায় কথা বলা যায় না।”

সৌরারা আজকাল নিজেদের পরিচয় সংকটে ভুগছেন মন্তব্য করে রাজঘাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিজয় বুলার্জী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তারা এখন নিজেদের সৌরা বলছে না, বলছে ভীম। তাদের ভাষা কেউ বোঝে না। নিজেদের মাঝেও তারা এখন আঞ্চলিক বা বাংলা ভাষায় কথা বলছে। আস্তে আস্তে ওদের ভাষাটাই হারিয়ে যাচ্ছে।”

সৌরা পরিচয় না দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে পল্লীর বাসিন্দা অলকুমার সৌরা বলেন, “সৌরা ভাষা ও জাতি এখন অনেক অবহেলার মধ্যে আছে। সৌরা বললে লোকে বলে, এটা কোন জাতি? আমরা এখন তাই আমাদের ভিম জাতি বলি। ভিম আমাদের আদি দেবতা। তিনি শক্তির প্রতীক।”

নিজেদের ভাষা হারিয়ে যেতে বসেছে জানিয়ে আক্ষেপ করে অলকুমার সৌরা বলেন, “আমাদের প্রজন্মের পরে আর কেউ সৌরা ভাষাটি পড়তে পারবে না। তখন নতুন প্রজন্মকে আমাদের অক্ষর, বর্ণমালাগুলো পড়াবে কে?

“আমাদের যদি কোনো স্কুল থাকত, যদি প্রাথমিক পর্যায়ে আমাদের শিশুরা নিজ মাতৃভাষায় পড়াশোনা করতে পারত, তাহলে হয়ত আমাদের ভাষাটি টিকে যেতে পারে।”

 

বিপন্ন ভাষা রক্ষায় বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, ভাষাবিদ ও আদিবাসী ভাষাকেন্দ্রিক সংগঠনগুলোর সম্মিলিত উদ্যোগ এনডেঞ্জারড ল্যাঙ্গুয়েজ প্রজেক্টের তথ্য মতে, অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষা সৌরা ভারতের উড়িষ্যা, অন্ধ্র প্রদেশ, তামিলনাড়ু ও বিহারেও রয়েছে। সৌরা ভাষার লিখিত হরফ রয়েছে। ভারতের অন্ধ্র প্রদেশে শ্রীকাকুলুম জেলার অক্ষর ব্রহ্ম যুব নির্মল সংঘ হতে ‘সোরা প্রাইমারি’ নামে একটি পাঠ্যপুস্তক বের হয়েছে। ওই বই এনে এখানে সৌরা ভাষার চর্চা করেন গুটিকয়েক মানুষ।

ভাষা যেন হারিয়ে না যায় সেজন্য অন্তত মুখে মুখে ভাষাটি টিকিয়ে রাখতে চান প্ল্লীর আরেক বাসিন্দা উর্মিলা সৌরা।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা বলতে থাকব, ছোটরা শুনে শুনে শিখবে। আমরা তো ঘরে বলি। আমাদের ভাষাটা আমরা ছাড়ব না। কেমনে ছাড়ব আমরা? নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরাও শুনে শুনে এই ভাষায় কথা বলবে। শেষ পর্যন্ত এই ভাষাটাকে আমরা ধরে রাখব।”

সৌরা ভাষা নিয়ে উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে শ্রীমঙ্গল উপজেলার সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী বলেন, “আমি আসলে সৌরা জনগোষ্ঠীর নামই জানি না। আপনাদের কাছ থেকে প্রথম শুনলাম। খবর নিয়ে দেখব।”

সাদ্রি ভাষার বই ছাপা হলেও পায়নি এলাকাবাসী

সরকার এ বছর গারো, চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরার পাশাপাশি সাদ্রি ভাষায় প্রাক প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক তৈরি করলেও তা পৌঁছায়নি মৌলভীবাজারের এই ভাষাগোষ্ঠীর বসতিতে।

সেখানে এই বই কেন দেওয়া হয়নি জানতে চাইলে এনসিটিবির মহাপরিচালক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রথমত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যরা তাদের চাহিদার কথা জানাবেন স্থানীয় প্রশাসন বা জনপ্রতিনিধিদের। উপজেলা প্রশাসন থেকে তথ্য যাবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে।  সেখান থেকে আমরা চাহিদার কথা জানতে পারলে তবেই বই পৌঁছে দেব। এনসিটিবি হয়ত সে তথ্য পায়নি।”

এ বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রাক প্রাথমিক শাখার কর্মকর্তা মহিউদ্দীন আহমেদ তালুকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শ্রীমঙ্গল উপজেলা থেকে সাদ্রি ভাষার বইয়ের কোনো আবেদন পাননি বলে তারা তা এনসিটিবিতে পাঠাতে পারেননি।

 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রীমঙ্গল উপজেলার সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাদ্রি নামে যে একটা ভাষা আছে, সেটাই তো জানি না। এ ভাষার বই আছে নাকি? এ ধরনের কোনো বই আমরা পাইনি।”

শ্রীমঙ্গল উপজেলা সদরের ভুরভুরিয়া চা বাগানে পাঁচশ’র মতো পরিবারের সদস্যদের মুখে মুখে এখনও সাদ্রি ভাষাটি টিকে রয়েছে বলে জানান সেখানকার বাসিন্দা পরিমল সিং বাড়াইক।

সাদ্রি ভাষার গবেষক ও কবি পরিমল জানান, মৌলভীবাজার ছাড়াও এই অঞ্চলের সিলেট ও হবিগঞ্জের বিভিন্ন চা বাগানে বসবাসরত বাড়াইক, ওরাও, মুন্ডা, রাতিয়া, খাড়িয়া, রিকিসন,কুর্মি, খাসি, লহড়া জনগোষ্ঠীর সদস্যরাও কথা বলেন সাদ্রি ভাষায়।

তার ভাষ্য মতে, ষোল-সতের শতকে পূর্ব ভারতের ঝাড়খণ্ডের নাগপুরি ভাষা থেকে উপজাত হয়ে ৩৭টি জনগোষ্ঠীর মুখে মুখে যে ভাষাটি স্বাতন্ত্র্য পেয়েছিল, সেটাই সাদ্রি ভাষা।

জীবিকার তাগিদে ঝাড়খণ্ড থেকে ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা সেই ৩৭টি জনগোষ্ঠী ক্রমেই চলে আসতে থাকে উত্তর-পূর্ব ভারতের দিকে। ব্রিটিশ শাসনামলে তারা চলে আসে বাংলায়। তাদের একটি অংশ থেকে যায় বাংলার পশ্চিমাঞ্চলে, আরেকটি অংশ আসাম ঘুরে চলে আসে সিলেটের চা বাগান এলাকায়।

পরিমল সিংহ বলেন, “ঝাড়খণ্ড অঞ্চলের নাগপুরি ভাষা থেকে উপজাত সাদ্রি ভাষাটি সে অঞ্চলে কখনও সাদানি, সাদানা, সদরি, নাগপুরিয়া, গাওয়ারি ভাষা নামেও কথিত রয়েছে।”

সিলেট অঞ্চল ছাড়াও পাবনা, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, যশোর, রংপুরের বিভিন্ন গ্রামে সাদ্রি ভাষীরা ছড়িয়ে রয়েছেন বলে জানান পরিমল সিংহ।

“সারা দেশে ২০ থেকে ২৫ হাজার মানুষ এখন সাদ্রি ভাষায় কথা বলে,” বলেন তিনি।

ঝাড়খণ্ডে নাগরি লিপিতে সাদ্রি ভাষা লেখা হলেও বাংলাদেশে বসবাসরত এই ভাষিক গোষ্ঠী বাংলা হরফেই তাদের মাতৃভাষা চর্চা করছেন বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা বিজ্ঞানের অধ্যাপক-গবেষক সৌরভ শিকদার।

ষাটোর্ধ্ব পরিমল জানান, তাদের পূর্বপুরুষরা নাগরি লিপিতে লেখাপড়া করলেও সে বর্ণমালার কোনো বই তাদের প্রজন্ম দেখেননি। সাদ্রি ভাষায় কথা বলা ও চিঠিপত্র চালাচালিও ক্রমশ কমে আসছে।

“পেশাগত প্রয়োজনে আমাদের সবাইকে এখন বাংলা ভাষায় কথা বলতে হয়, লিখতেও হয়। সাদ্রি ভাষাভাষীদের মধ্যে যারা নতুন প্রজন্ম, তারা নিজের মাতৃভাষাটি মোটেও চর্চা করছে না। এভাবে চলতে থাকলে একদিন হারিয়ে যাবে সাদ্রি ভাষা।”

সাদ্রি ভাষীরা যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলেন, তখনও নানা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের মুখে পড়তে হয়ে বলে জানান তিনি।

নিজেদের ভাষা চর্চা সম্পর্কে জানতে চাইলে তরুণ হৃদয় বাড়াইক বলেন, “এখন তো সব কাজের জন্য আমরা বাংলা ব্যবহার করি। এমনকি পরিবারেও আমরা প্রচলিত বাংলাতেই কথা বলি। সাদ্রি ভাষাতে অনেক বাড়িতেই এখন আর কথা বলে না। আমরা অনেক শব্দ জানলেও সাদ্রি ভাষাটি ঠিকমতো বলতে পারি না।

“সাদ্রি ভাষা বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আমরাই যখন পারছি না, আমাদের যে পরের বংশধর ওরা তো আরও পারবে না এই ভাষা।”

পরিমল সিং বাড়াইক বলেন, “আমরা অনেক দিন ধরেই আদিবাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে লড়াই করছি। সরকারের কাছে বিভিন্ন সময় আমাদের চাহিদার কথাও জানিয়েছি। ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর সংস্কৃতির অধিকার রক্ষায় আমরা শ্রীমঙ্গলে আলাদা একটি কালচারাল ইনস্টিটিউট তৈরির দাবি জানিয়েছি। ”

 

নানা প্রতিশ্রুতি এলেও ‘কিছু পাননি’ তেলেগু ভাষীরা

বাংলাদেশের সিলেট ও মৌলভীবাজারের বিভিন্ন চা বাগানে বসবাসরত অলমিক, রাজভর, গোয়ালা, নাইডু, রেলি নৃগোষ্ঠীর ভাষা তেলেগু রক্ষায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও সেগুলোর বাস্তবায়ন ঘটেনি বলে অভিযোগ করেছেন এই ভাষা গোষ্ঠীর সদস্যরা।

শ্রীমঙ্গল উপজেলার সাতগাঁও ইউনিয়নের মাকড়িছড়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সীতারাম অলমিক জানান, মাকড়িছড়া চা বাগানে ২০০টি অলমিক পরিবার রয়েছে, তারা এখন মৌখিকভাবে তেলেগু ভাষাটি টিকিয়ে রেখেছেন। এছাড়া কমলগঞ্জ উপজেলার পাত্রখোলা ইউনিয়নে আড়াইশ পরিবার রয়েছে, তারাও কথা বলছেন দক্ষিণ ভারতের এ ভাষাটিতে।

তিনি জানান, ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্য থেকে চার প্রজন্ম আগে অলমিকরা সিলেট অঞ্চলে আসে। তারা ছাড়াও রাজভর, গোয়ালা, নাইডু ও রেলি নৃগোষ্ঠীর সদস্যরা তেলেগু ভাষায় কথা বলছেন।

পাত্রখোলা ইউনিয়নের বাসিন্দা ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান গরানা অলমিক জানান, ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ ও তেলাঙ্গানার সরকারি ভাষার লিখিত হরফের চর্চা হলেও বাংলাদেশে বসবাসরত তেলেগুভাষীদের ভাষা চর্চা ক্রমশ কমছে। 

পাত্রখোলাতে তেলেগু ভাষার একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান শুরু হলেও এখন তা নিয়মিত হচ্ছে না।

ভাষা চর্চার হাল জানাতে গিয়ে গরানা অলমিক বলেন, “সকালে উঠে আমাদের কয়েকটা ভাষা বলতে হয়। কখনও দেশোয়ালি, কখনও সিলেটি ভাষা বলতে হয়। ঘরের মধ্যেই তো এখন তেলেগু ভাষাটি বলতে পারছি না। ”

এঙ্কানা অলমিক নামে ওই পল্লীর আরেক বাসিন্দা জানান, স্কুল প্রতিষ্ঠার পর নানা সীমাবদ্ধতার কারণে ক্রমেই শিক্ষার্থী সংখ্যা কমছে।

তিনি অভিযোগের সুরে বলেন, “স্কুলটি নিয়ে সরকারের কাছে কতবার আবেদন করলাম। মাকড়িছড়ায় আমাদের চৌরাসি সম্মেলনে এসে মন্ত্রী, এমপিরা আমাদের কত প্রতিশ্রুতি দিলেন। বেশ কয়েকটা মিশনারি দল আসল। তারা এসে বলল, আমাদের ভাষার বইটই তারা দেবে। কিন্তু পরে তারা আমাদের শর্ত দিল যে, আমাদের ধর্ম পরিবর্তন করতে হবে। আমরা রাজি হলাম না।”

মাকড়িছড়ার বাসিন্দা দুর্গা অলমিক ও সুমন অলমিক জানান, লৌকিক আচার অনুষ্ঠানগুলোতে এখনও তারা তেলেগু ভাষায় লেখেন।

পাত্রখোলার স্কুলটির বিষয়ে অবগত আছেন জানিয়ে কমলগঞ্জ উপজেলার শিক্ষা কর্মকর্তা সাঈফুল ইসলাম তালুকদার বলেন, “তারা আবেদন নিয়ে এসেছেন স্কুলের বিষয়ে। আমরা তা বিবেচনা করছি।”

নানা ভাষার মিশেলে হারাচ্ছে আদি ওড়িয়া

বাংলা, হিন্দি ও আঞ্চলিকতার মিশ্রণে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্রমাগত হারিয়ে যাচ্ছে ওড়িয়া ভাষা। নিজস্ব বর্ণমালা থাকা সত্ত্বেও ব্যবহারিক প্রয়োগ ক্রমেই কমে আসায় ওড়িয়াদের ভাষাটি এ দেশ থেকে বিলুপ্ত হতে বসেছে বলে আশঙ্কা করছেন এই ভাষীরা।

ব্রিটিশ শাসনামলে ভাগ্যান্বেষণে ভারতের উড়িষ্যা রাজ্য থেকে এ দেশে আসেন ওড়িয়া ভাষাভাষীরা। ব্রিটিশরা যখন সিলেট অঞ্চলে চা চাষ করতে চাইছিলেন, তখন দিন বদলের আশায় এ দেশে চলে আসেন ওড়িয়ারা। সে থেকেই রয়ে গেছেন এ অঞ্চলে।

সিলেট ও মৌলভীবাজারের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ছাড়াও পশ্চিমের জেলাগুলোতে রয়েছে তাদের বাস। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন চা বাগানে আছেন ৫০ হাজারের বেশি ওড়িয়া ভাষী।

শ্রীমঙ্গলের কালিঘাট ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান রাধাকান্ত তাঁতি জানান, তাদের জীবনে ওড়িয়া ভাষার ব্যবহার ক্রমশ কমে আসছে। ওড়িয়ারা নিজেদের মধ্যে বাংলা, হিন্দি, খাড়িয়া ও দেশোয়ালি ভাষার সংমিশ্রণে কথা বলায় প্রকৃত ওড়িয়া ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে।

“এখন ওড়িয়া ভাষার চর্চা একেবারে নেই। আগে অনেক লোকজন ছিল, আমাদের বইপুস্তক ছিল। আমরা স্কুলে গিয়ে বাংলায় লেখাপড়া করতাম, তবুও আমরা সন্ধ্যাবেলাতেই বাড়ির উঠানে দাদু দিদাদের কাছে নিজ ভাষায় পড়তে বসতাম। সেখানে বর্ণমালা চেনা, বর্ণমালায় লেখা, আর গল্প শোনা হত। ওড়িয়াতে লেখা হিন্দু পুরাণ তো সেই উঠান বৈঠকে শুনে শেষ করেছি। এখন সেসব আসর বন্ধই হয়ে গেছে।”

এ দেশে প্রজন্মান্তরে ওড়িয়া ভাষাটি টিকিয়ে রাখতে রাধাকান্ত তাঁতিরা নিজেদের বাড়ির উঠানে একটি স্কুল শুরু করেন ২০০৮ সালে।  ৬০ থেকে ৭০টি শিশুকে এক বছর পাঠদানের পরে আর্থিক সঙ্কটে তাও বন্ধ হয়ে যায়।

এই স্কুলে পড়া বর্ষা তাঁতি বলেন, “আমরা এখানে ওড়িয়া শিখতাম। একজন শিক্ষকও নিয়োগ করা হয়েছিল। ‍কিন্তু এখন আমাদের স্কুলটি আর বসে না। ”

শ্রীমঙ্গলের একটি কলেজে স্নাতক পড়ছেন কালিঘাটের রাজেন তাঁতি। মাতৃভাষার স্কুল ছাড়া ভাষা চর্চা হারিয়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি।

ওড়িয়া ভাষার ‘উৎকল’ ধারায় তারা কথা বলেন জানিয়ে অশোক বুলার্জী নামে একজন বলেন, রাজঘাট ইউনিয়নের ৩৪ হাজার ভোটারের মধ্যে ৭৫ শতাংশই এই ধারায় কথা বলেন।

এখানকার বাসিন্দারাও বাড়ির উঠানে পারিবারিক স্কুলে ওড়িয়ার উৎকল ধারায় পাঠচর্চা চালু করেছেন।

অশোক বুলার্জী বলেন, “আমদের যদি একটা স্কুল থাকত তাহলে আমাদের বর্ণমালাও চর্চা করতে পারতাম। তবে আমরা যারা এখনও কিছু শুদ্ধভাষী রয়েছি, তারা চেষ্টা করছি, উৎকল ধারাটি নিজেদের মধ্যে চালু রাখতে।”

ঘরোয়া ভাষা শিক্ষা স্কুলগুলো চালু করার পরে কেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, সে প্রশ্নের জবাবে রাধাকান্ত তাঁতি বলেন, “স্কুলগুলো একেবারে খোলা স্থানে। রোদ, বৃষ্টিতে শিশুদের কষ্ট হয়। তাছাড়া যারা পড়াচ্ছেন এই স্কুলগুলোতে, তারাও পারিশ্রমিকের ইস্যুতে নিয়মিত পড়াতে চাইছেন না।”

স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য উপজেলা প্রশাসনে যোগাযোগ করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের নিজস্ব বই রয়েছে, সেগুলো আমরা ফটোকপি করে শিশুদের মধ্যে দিচ্ছি। এখন সরকার যদি নজর দেয় তাহলে শিশুরা নিজ মাতৃভাষায় প্রথম বর্ণপরিচয়টা অন্তত করতে পারবে।”

শ্রীমঙ্গলের সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ আলী জানান, ওড়িয়া ভাষীদের বিষয়টি তারা অবগত রয়েছেন। চা বাগানে বসবাসরত বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর ভাষার স্কুল প্রতিষ্ঠার বিষয়ে তারা ভাবছেন।

‘অর্থাভাবে’ বন্ধ হয়ে গেছে মণিপুরী ভাষার স্কুল 

 

২৭টি বর্ণমালার মণিপুরী ভাষাটিও যে ক্রমশ বিলুপ্তির পথে এগোচ্ছে, তা জানিয়েছেন এই ভাষিক গোষ্ঠীর সদস্য ও গবেষক হাম্মাম সনাতন।

তিনি বলেন, “আমাদের মধ্যে যারা বিভিন্ন অঞ্চলে রয়েছেন, তারাই তো নিজেদের সন্তানদের সঙ্গে মণিপুরী ভাষায় কথা বলতে শেখান না। বাংলার সাথে ক্রমেই মিশে যাওয়ার কারণে আমাদের মণিপুরী ভাষার মানও ক্রমশ বিলুপ্তির পথে।”

মণিপুরী ভাষা শিক্ষার লক্ষ্যে শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলায় ১২টি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হলেও তা অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানান তিনি।

কমলগঞ্জ উপজেলার পূর্ব কোণাগাও গ্রামের এই বাসিন্দা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মণিপুরী ভাষা চর্চার জন্য কমলগঞ্জ উপজেলায় ৭টি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে প্রতি শুক্রবার শিশুদের পাঠদান করা হত। পরে পাশের উপজেলা শ্রীমঙ্গলেও আরও ৫টি ভাষার স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন মনিপুরীরা। 

“অর্থাভাবে খুব বেশি দিন চালানো যায়নি স্কুলগুলো।”

সরকারি অর্থায়নে এগুলো পরিচালনার দাবি জানিয়ে হাম্মাম সনাতন বলেন, “সরকারি সহযোগিতা ছাড়া এই স্কুলগুলো পরিচালনা করা সম্ভব নয়। স্কুল না থাকলে আমাদের ভাষাটিকে টিকিয়ে রাখা যাবে না।”

ভাষার দুর্গতির জন্য মণিপুরী কালচারাল একাডেমিকে দুষছেন মৈতে মণিপুরীদের প্রতিনিধি প্রদীপ কুমার সিংহ। তিনি অভিযোগ করেন, সংস্কৃতির গবেষণা ও প্রচার কাজে যতটা মনযোগ রয়েছে, ভাষাটিকে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে সে ধরনের মনযোগ নেই এই প্রতিষ্ঠানের।

হাম্মাম সনাতন বলেন, ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ মণিপুরী সাহিত্য সংসদ প্রতিষ্ঠা হয়। এই সাহিত্য সংসদই এখন মণিপুরীদের বর্ণমালা টিকিয়ে রাখতে কাজ করছে।

এদিকে মণিপুরী সম্প্রদায়ের ভাষার স্বীকৃতি নিয়ে তাদের দুই সম্প্রদায়ের মধ্যকার বিরোধের কথা বলছেন কমলগঞ্জ উপজেলার শিক্ষা কর্মকর্তা সাঈফুল ইসলাম তালুকদার।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মূলত মেইতে ও বিষ্ণুপ্রিয়া সম্প্রদায় নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে ভাষার প্রশ্নে। তারা উভয় পক্ষ দাবি করছে, তাদের ভাষাটি মূল ভাষা। তারা ঐক্যমতে না আসলে এই ভাষার সম্প্রসারণ ও তাদের মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রকাশও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।”

বিপন্নপ্রায় ভাষা রক্ষায় করণীয়

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর ভাষা নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৌরভ শিকদার।

নৃগোষ্ঠীগুলোর নিজেদের ভাষা চর্চার পাশাপাশি এসব ভাষা যথাযথ সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া দরকার বলে মনে করেন তিনি।

সৌরভ শিকদার বলেন, “যেসব ভাষা একেবারেই বিলুপ্তির পথে, সে ভাষাগুলোকে টিকিয়ে রাখতে তাদের ব্যবহারিক জীবনে এই ভাষাটির চর্চা বাড়াতে হবে। এই ভাষার পুনর্গবেষণা করাও জরুরি। এখনই এ ভাষার জন্য পাঠ্যপুস্তক রচনা না করলেও ভাষাটিকে যথাযথ সংরক্ষণ করতে হবে, ব্যাকরণ প্রণয়ন করতে হবে। এছাড়া রেডিওতে তাদের ভাষার গানও যদি প্রচার করা হয় তাহলেও এ ভাষা নিয়ে সচেতনতা তৈরি হতে পারে।”

ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর ভাষা শিক্ষার জন্য প্রশিক্ষিত শিক্ষক তৈরি করা প্রয়োজন বলে মনে করেন অধ্যাপক সৌরভ।

তিনি বলেন, “স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ দিলে আদতে কোনো লাভ হবে না। কমপক্ষে ছয় মাসের প্রশিক্ষণ দিতে হবে তাদের।  যারা এখনও এ ভাষাটি টিকিয়ে রেখেছেন, ভাষার শিক্ষাক্রম প্রণয়নে তাদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যারা এ ভাষায় দক্ষ তাদের আদিবাসীদের স্কুলে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।”

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য বই ছাপাতে সরকার যে পদ্ধতিতে অনুসরণ করছে, তাতে সন্তুষ্ট নন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকার এখন আদিবাসীদের কাউকে এনে বলছেন, আপনারা কেউ আমাদের হরফে আপনাদের ভাষার কবিতা লিখেন, কেউ গল্প লিখে দেন। এটা তো সঠিক উপায় নয়। যে বইগুলো হচ্ছে, সেই বইগুলোর মানও কি সঠিকভাবে পরীক্ষা করা হচ্ছে? আদিবাসীদের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ণের জন্য প্রয়োজন সমন্বিত একটি প্রক্রিয়া, যেটা অনুসরণ করা হচ্ছে না।”

তিনি বলেন, এই ভাষাটিকে সংরক্ষণ করতে হলে এখন থেকেই এ ভাষাভাষীদের মানুষদের কথ্যভাষাটি সংরক্ষণ করতে হবে।

যারা এই ভাষার ইতিহাসটি জানেন, তাদেরও এই ভাষার শিক্ষাদান পদ্ধতির সঙ্গে যুক্ত করার পরামর্শ দেন এই শিক্ষক।

নৃবিজ্ঞানী জোবাইদা নাসরীন বলেন, “এ ভাষায় এখনও যারা কথা বলছেন, তাদের মুখ থেকে গল্প, গানগুলো রেকর্ড করে সেগুলো যথাযথ সংরক্ষণ করতে হবে।”

যা করছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট

ক্ষুদ্র ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর ভাষা সমীক্ষা ও গবেষণার মূল কাজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের।

ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক জীনাত ইমতিয়াজ আলী বলেন, “যেসব ভাষায় ২০, ৩০ হাজারের নিচে মানুষ কথা বলে, সেসব ভাষা টিকিয়ে রাখা কষ্টকর। ভাষার উৎস খুঁজে পাওয়া তখন বড় মুশকিল হয়ে যায়। আমরা তখন খুঁজে পাই না, সেসব ভাষার মৌখিক রূপটি কেমন ছিল।

“তবে আমরা বিলুপ্তপ্রায় ভাষাগুলো উদ্ধারে ব্যাকরণ বা অভিধান প্রণয়ণের জন্য কমিটি গঠন করেছি। আমরা কাজ শুরু করেছি।”

নৃগোষ্ঠীর ভাষাগুলো যেন হারিয়ে না যায়, সেজন্য ভাষা সমীক্ষা কমিটি কাজ শুরু করবে বলে জানান তিনি। 

“তবে এই কাজটি হবে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার। নানা যাচাই-বাছাই করতে হবে, প্রকৃত উৎসও খুঁজে বের করতে হবে আমাদের।”