একবছর আগে পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টা মোড়ের ভয়াবহ আগুন দুই বান্ধবী ফাতেমাতুজ জোহরা বৃষ্টি ও রেহনুমা তারান্নুম দোলাকে কেড়ে নিয়ে মুছে দিয়েছে দুই পরিবারের আনন্দ। স্বজনরা দু’জনের স্মৃতিমাখা জিনিসগুলো হাতড়ে তাদের ছোঁয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু বারবারই সেসব হয়ে ওঠে কষ্টের কারণ।
বৃষ্টি-দোলা ছাড়াও রানা-মাসুদ, আনোয়ারের মতো সেদিন হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর স্বজনরা কেমন আছেন- তার উত্তর খুঁজতে গিয়ে মেলে কিছু বুকচাপা কষ্টের কথা।
গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের চাইল্ড কেয়ার বিভাগের শিক্ষার্থী বৃষ্টির বাসা হাজি রহিম বক্স লেনে আর ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের আইনে পড়ুয়া দোলার বাসা শেখ সাহেব বাজার রোডে। চুড়িহাট্টার কাছেই দু’জনের বাসা।
গতবছরের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে শিল্পকলা একাডেমিতে একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে রিকশায় করে চুড়িহাট্টা মোড় দিয়ে বাসায় ফিরছিল বৃষ্টি আর দোলা। শৈশবে অগ্রণী স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ার সময় দুইজনের যে বন্ধুত্ব, আগুনে তার সমাপ্তি ঘটেই সেখানেই।
শুরুতে দুই পরিবার নিশ্চিত ছিল না, তাদের মেয়েরা মারা গেছে নাকি নিখোঁজ হয়েছে। দোলার বাবা দলিলুর রহমান দুলাল প্রথমে লালবাগ থানায় নিখোঁজ হওয়ার সাধারণ ডায়েরিও করেছিলেন। পরে ৭ মার্চ সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে বৃষ্টির এবং ১২ মার্চ দোলার মরদেহ শনাক্ত করে।
সাংবাদিক পরিচয় শুনে ওয়েস্ট অ্যান্ড স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র শুভ দরজা খুলে দেয়।
‘আপুর কক্ষটি কি ওইভাবে রেখেছ’ জানতে চাইলে শুভর জবাব, “আপুর খাটে এখন আমি আর সানি ভাইয়া ঘুমাই।”
বোনের বই আর প্রসাধনগুলো দেখিয়ে ছোট শুভ বলে, “এই বইগুলো এখন আমাদের কাছে আপুর স্মৃতি। মাঝে মধ্যে মা এসে বইগুলো দেখেন কিন্তু বাবা আসেন না।”
মায়ের সাথে মাঝেমাঝে দোলাদের বাসায় যাওয়া হয় বলে জানায় শুভ।
বৃষ্টি ও দোলা বেঁচে থাকতে যে সম্পর্ক ছিল দুই পরিবারের মধ্যে এখনও তা টিকে বলে পরে ফোনে জানান বৃষ্টির মা শামসুন্নাহার।
“দুই পরিবার তো একই ধরনের ভুক্তভোগী। আর এই বেদনা কি ভোলা যায়? যতদিন বেঁচে থাকব বয়ে বেড়াতে হবে এই বেদনা।”
তবে বৃষ্টির বাবা জসিম উদ্দিন মেয়ে হারানোর কষ্টকে চাপা দিয়ে বলেন, “বেদনা বাড়বে, তাই মনে করতে চাই না। যখন মেয়ে নিখোঁজ ছিল তখন মনে নানা প্রশ্ন ছিল যে, মেয়েকে কোনো চক্র ধরে নিয়ে গেছে কিনা। যখন ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হলাম যে আমাদের মেয়ে দুর্ভাগ্যের শিকার, তখনই কষ্ট চলে গেছে। তাদেরকে কবর দিয়ে দিয়েছি। এখন আর মনে করতেও চাই না সেই স্মৃতি।”
কিন্তু দোলার মা সুফিয়া রহমান ছোট মেয়ে মালিয়া মেহবীন নুসাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করলেও হারিয়ে যাওয়া মেয়ের কথা কিছুতেই ভুলতে পারছেন না।
“সময় আর ফুরাচ্ছে না, যতদিন যাচ্ছে কষ্টও বয়ে যাচ্ছে। এই যন্ত্রণা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বহন করতে হবে।
“দোলার বাবা এখন আর দলিল লেখার কাজ করে না। মেয়েকে হারিয়ে উদাসীন হয়ে গেছেন। সারাদিন বাসায় কম্পিউটারে মেয়ের পুরনো স্মৃতি দেখেন আর বাসার ছাদে উঠে গাছে পানি দেন। কোথাও তেমন একটা বের হন না।”
এত কষ্ট ঘোচাবে কে?
মৃত্যুর ২৬ দিন আগে বিয়ে করেছিলেন রাজু। তিন মাস আগে তার স্ত্রী এক ছেলে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন।
রানা-মাসুদের বৃদ্ধ বাবা বাসিন্দা সাহেব উল্লাহ মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অনেক কষ্ট করে তাদের এত বড় করেছি, আর এভাবে চলে গেল। কীভাবে কী করব বুঝতে পারছি না। রাজুর ছোট ছেলে আর তার স্ত্রীরই বা কি ভবিষ্যৎ?
মাসুদ ও রানার চাচা এম এ রহিম জানান, তারও একটি দোকান ছিল ওয়াহেদ ম্যানশনের নিচতলায়। সেই রাতে ঘটনার আট মিনিট আগে বাসায় (বালু রোড) কোনো এক দরকারে চলে যান।
“রানা ও মাসুদের বাবা-মাও সেই রাতে ঘটনাস্থলে এসেছিল। কিন্তু এক মিনিট আগে দোকান থেকে বাসায় চলে যাওয়ায় বেঁচে যান।”
একটি চাকরি খুবই দরকার মজিব হাওলাদারের ছেলের
সেই রাতে মৃত্যুর মিছিলে নাম লেখানো আরেক পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার মাধবখালী ইউনিয়নের সন্তোষপুর গ্রামের মো. মজিবুর রহমান হাওলাদার (৪৮)। চুড়িহাট্টা এলাকায় ভাড়ায় ভ্যানগাড়িতে করে মালামাল পরিবহন করতেন তিনি।
একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটিকে হারিয়ে অথৈ সাগরে পড়েছেন হাওলাদারের পরিবার।
মঙ্গলবার কথা হয় মজিবুর রহমানের ছেলে সুমন হাওলাদারের সঙ্গে।
“বাবাই ছিল আমাদের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। আমি পড়াশুনা করতাম, এখনও করি। তবে ছোট একটি চাকরি করতে হয়।”
ডিগ্রি পাস কোর্সে পড়ছেন জানিয়ে তিনি বলেন, তার ছোট ভাই মামুনের বয়স ১৪, আরেক বোন মাসুদা আক্তার ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে আর সবার ছোট ভাই সাকিবের বয়স ছয়। বড় বোনে বিয়ে হলেও অন্যদের চলতে হচ্ছে কষ্ট করে।
“স্বজন ও মামারা সহযোগিতা করছে। কিন্তু এভাবে কতদিন,” দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন সুমন।
“বাবার মৃত্যুর পর মৃতদেহ আনার জন্য বিশ হাজার টাকা দিয়েছিল সরকার, এরপর আর কোনো সহযোগিতা পাইনি। তবে চুড়িহাট্টা সমিতি থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়েছিল। তাই সরকারের কাছে অনুরোধ একটি চাকরি দিলে ভালো হয়। আমাদের একটি স্থায়ী সমাধান হয়।”
মাত্র তিন হাজার টাকায় চলে আনোয়ারের সংসার
চুড়িহাট্টার আগুনে দগ্ধ হয়ে পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান রাজবাড়ির রিকশাচালক আনোয়ার হোসেন (৫৫)।
আনোয়ারের মৃত্যুর পর ইসলামবাগের বাসা ছেড়ে ছোট ছোট তিন ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে কামরাঙ্গীরচরে ঠাঁই নিয়েছেন স্ত্রী হাজেরা বেগম।
স্বামীকে হারানোর পর একটি খেলনার কারখানায় কাজ নিয়েছেন হাজেরা। বেতন পান পাঁচ হাজার টাকা। তা থেকে দুই হাজার টাকা বাসা ভাড়া দিয়ে মাত্র তিন হাজার টাকায় চলতে হয় পুরো। চরম অর্থকষ্টে হাঁপিয়ে উঠেছেন হাজেরা।
“সে জীবিত থাকতে পুরো সংসারের দায়িত্ব পালন করত। এখন আর পারি না। সরকার থেকে চিকিৎসার সময় পঞ্চাশ হাজার টাকা আর মারা যাওয়ার পর বিশ হাজার টাকা দিয়েছে, আর কোনো টাকা দেওয়া হয়নি,” বলেন তিনি।
শ্রম মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, চুড়িহাট্টায় নিহত ৭১ জনের মধ্যে ২৭ জন শ্রমিক। সেই তালিকায় আনোয়ার হোসেন, মজিবুর রহমান হাওলাদারের নামও রয়েছে। তাদের পরিবারকে শিগগির সরকারি অনুদান দেওয়া হবে।