নাগরিক সাংবাদিকদের চোখে ভোট ও নগর ভাবনা

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে নির্বাচন হয়ে গেল, আসছে নতুন নেতৃত্ব; এই প্রেক্ষাপটে ভোটের মূলায়নের পাশাপাশি নতুন নেতৃত্বের কাছে জনগণের বিভিন্ন প্রত্যাশার দিকগুলো তুলে ধরেছেন নাগরিক সাংবাদিকরা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Feb 2020, 05:33 PM
Updated : 16 Feb 2020, 03:12 PM

মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম কার্যালয়ে ‘কেমন নগর চাই’ শীর্ষক এক আলোচনায় যুক্ত হন ব্লগ ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম’র নাগরিক সাংবাদিকরা।

২০১১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের নাগরিক সাংবাদিকতার প্রথম প্ল্যাটফর্ম হিসাবে যাত্রা শুরু করে ব্লগ ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। প্রতিষ্ঠার নবম বছর উদযাপন উপলক্ষে এই আলোচনার আয়োজন করা হয়।

ব্লগের সমন্বয়ক আইরিন সুলতানার সঞ্চালনায় ১০ জন নাগরিক সাংবাদিক আলোচনায় অংশ নিয়ে তাদের মতামত তুলে ধরেন।

এই নির্বাচনেই সবচেয়ে বড় পরিসরে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএমে ভোটগ্রহণ হয়। স্বাভাবিকভাবেই তা এসেছিল নাগরিক সাংবাদিকদের আলোচনায়।

নাগরিক সাংবাদিক বোরহান বিশ্বাস বলেন, ভোটারদের মাঝে ইভিএম নিয়ে আগ্রহ থাকলেও আঙুলের ছাপ মেলাতে বয়স্কদের বেশ বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে। ইভিএম নিয়ে কমিশনের প্রচারও খুব কম ছিল।

শাদনান মাহমুদ নির্ঝর বলেন, ইভিএম একটি আধুনিক প্রযুক্তি হলেও এর কিছু সীমাবদ্ধতা দেখা গেছে। সিল মেরে ভোটের সময় ভোট পুনঃগণনার সুযোগ থাকলেও ইভিএমে সেটা নেই। কে কাকে ভোট দিল সেটা পরে আর যাচাই করার সুযোগ নেই।

এবারের নির্বাচনে ইভিএমে এক ভোটারের ভোট অন্যের জোর করে দেওয়ার অভিজ্ঞতাও আসে ব্লগারদের কথায়।

ভোটের প্রচারে কারণে জনগণের দুর্ভোগের চিত্রও তুলে ধরেন কয়েকজন নাগরিক সাংবাদিক।

রোদেলা নীলা বলেন, “সিটি নির্বাচনের প্রচারণায় চরম বিরক্তিকর শব্দ দূষণ হয়েছে। ঢাকা এমনিতেই শব্দ দূষণ কবলিত শহর। এধরনের প্রচারণা জনপ্রতিনিধিদের আন্তরিকতার বিষয়ে একটা ধারণা দেয়।

“নির্বাচনী আচরণবিধিতে অনেক কিছুই ছিল। কিন্তু প্রার্থীরা এগুলো একেবারেই মান্য করেননি। রাত ১২টা পর্যন্ত উচ্চ আওয়াজে মাইক বাজিয়ে প্রচারণা চালিয়েছেন।”

মোনেম অপু বলেন, এবারের নির্বাচনে এসএমএসের মাধ্যমেও প্রচারণা হয়েছে। এটি প্রচারণার একটি বিশেষ ইতিবাচক দিক। নির্বাচন উপলক্ষে যেসব পোস্টার ঝোলানো হয়েছিল, তাও অপসারণ করা হয়েছে।

নুরুন্নাহার শিরীন বলেন, “অন্যান্য সময়ের মতো এবারের নির্বাচনেও ছোট্ট ছোট্ট শিশুদের ভোটের প্রচারে যুক্ত করা হয়েছে। এটা সম্পূর্ণ অন্যায়। শিশুদেরকে নির্বাচনী কার্যক্রম থেকে দূরে রাখতে বিধিমালা চাই। কেবল নাগরিক সাংবাদিকরা নয়; মূল ধারার গণমাধ্যমকে এনিয়ে সোচ্চার হতে হবে।”

পাশাপাশি নগরে যে দুচারটি খেলার মাঠ রয়েছে সেখানেও শিশুদের নিরাপত্তার অভাব রয়েছে বলে উল্লেখ করে নুরুন্নাহার বলেন, শিশুরা নিরাপদে খেলার মাঠে গিয়ে খেলাধুলা করতে পারবে, মেয়র কাউন্সিলরদের কাছে সেই নিশ্চয়তা চাই।

আমিনুর রহমান হৃদয় বলেন, এই নগরে অনেক সমস্যা রয়েছে যার সমাধান এখনও হয়নি। যানজট, ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট এবং জলাবদ্ধতা এই শহরের নিত্যদিনের সমস্যা যার সমাধান এখনও হয়নি।

নিজের এলাকা ধানমন্ডির একটি সড়কের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “গত ছয় মাস ধরে একটি রাস্তা খনন করা হয়েছে; যা এখনও ঠিক করা হয়নি। সামান্য বৃষ্টিতে অনেক সড়কে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। আমরা অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে মেয়র, কাউন্সিলরদের কাছে এসব সমস্যার সমাধান চাই।”

নাহিদ দীপা বলেন, শিশু থেকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত প্রতিটি নাগরিকের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা নগর কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। এই ক্ষেত্রে নারীদের কিছু সমস্যার সমাধান এই নগরে এখনও আসেনি। মেয়েদের জন্য পাবলিক টয়লেটের ব্যবস্থা নেই।

“ফলে একজন নারী বাসার বাইরে বের হলেই তার মনের মধ্যে প্রতিনিয়ত পাবলিক টয়লেটের অভাবের শঙ্কাটি উঁকি দেয়। বর্জ ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা নেই।”

“মেয়র কাউন্সিলররা বড় বড় বিলবোর্ডে নিজের পরিচিতির জানান না দিয়ে কেবল সুপেয় পানি বিতরণ ও পাবলিক টয়লেট সমস্যার কিছুটা সমাধান করলেও জনগণের মন জয় করতে পারেন,” বলেন নাহিদ।

 

আর এন তমা বলেন, টেকসই উন্নয়ন ও নগর সরকার চালু হলেই কেবল আধুনিক নগর ব্যবস্থা নিশ্চিত হবে। নাগরিক সেবার বিষয়ে সিটি করপোরেশনকে সমন্বয়কের দায়িত্ব নিতে হবে।

শফিক মিতুল বলেন, “শহরের বাসিন্দাদের সেবা দেওয়ার জন্য ২৮টি সরকারি সংস্থা রয়েছে। এর সব কটির ওপরে সিটি করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণ নেই। বড় কোনো সঙ্কট দেখা দিলে মেয়র অসহায় হয়ে পড়েন। অনেক কর্তৃপক্ষ নিজের ক্ষমতা মেয়রের হাতে তুলে দিতে চাননা। সেকারণে নগর সরকারও আসেনা, সেবামূলক কাজেও সমন্বয় হয় না।”

মোনেম অপু বলেন, নগর সরকার অনেক জটিল বিষয়। ভেবে চিন্তে এই পথে আগাতে হবে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে নগর সরকার পদ্ধতির দিকে যাওয়ার কাজটি এখনই একটু একটু করে শুরু করতে হবে।

শাহিন রেজা বলেন, পরিবেশবান্ধব নগরের প্রতিশ্রুতি সব মেয়রের কাছেই শোনা যায়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে প্রয়াত আনিসুল হক ছাড়া অন্যরা এই পথে হাঁটতে পারেননি।

“এবারের নির্বাচনের প্রচারণা দেখে প্রার্থীদের পরিবেশ রক্ষায় উদাসীনতার বিষয়টি বেশি স্পষ্ট হয়েছে। তারা যদি সচেতন না হন তা হলে পরিবেশ বান্ধব নগর কিভাবে নিশ্চিত হবে?”

তথ্যের যথার্থতা ‘রাখতে হবে’

আলোচনার পর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম’র প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদীর সঙ্গে দেখা করেন নাগরিক সাংবাদিকরা।

এসময় তৌফিক খালিদী বলেন, সমাজে এত অন্যায় ঘটে, মূল ধারার গণমাধ্যমে সব সবসময় উঠে আসে না। এক্ষেত্রে নাগরিক সাংবাদিকরা ভূমিকা রাখতে পারে।

“যদিও মূল ধারার সাংবাদিকতার সঙ্গে এর একটা পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু এরপরও লেখার ক্ষেত্রে দায়বদ্ধতা ও তথ্যের যথার্থতা রক্ষা করতেই হবে।”

তথ্যের যথার্থতা রক্ষার উপর জোর দিয়ে সম্পাদক তৌফিক খালিদী বলেন, “কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার আগে বার বার তা যাচাই করে নিশ্চিত হতে হবে। ভুল তথ্য দেওয়া যাবে না। একটা ভুল প্রতিবেদনে একজনের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। সেটা করা যাবে না। যা লেখা হচ্ছে তার প্রতিটি অংশ নিয়ে খুব খুব সচেতন থাকতে হবে।

“প্রচলিত সংবাদ কয়েকধাপে ক্রস চেকের পর প্রকাশিত হয়। ব্লগে যেহেতু সবগুলো ধাপ নেই, তাই এখানে আরও বেশি সতর্ক থাকতে হবে। যথার্থতা রক্ষার দায়িত্বটি লেখককে নিতে হবে।”