সাগরের মা বললেন, আসামিদের ‘ছেড়ে দেওয়া ‍উচিত’

ছেলে ও পুত্রবধূ হত্যা মামলার তদন্তের শেষ দেখতে আট বছর অপেক্ষা করে হতাশ হয়ে পড়েছেন সাংবাদিক সাগর সরওয়ারের মা সালেহা মনির।

প্রকাশ বিশ্বাসপ্রকাশ বিশ্বাসও কামাল তালুকদারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Feb 2020, 12:07 PM
Updated : 11 Feb 2020, 03:26 AM

এখনও তদন্তের কোনো সুরাহা না হওয়ায় এই হত্যা মামলায় যারা আটক হয়ে কারাগারে আছেন, তাদের ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেছেন তিনি।

সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমার সময় ৭১ বারের মত পিছয়ে যাওয়ায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের এভাবেই হতাশার কথা জানিয়েছেন সালেহা মনির।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাবের সিনিয়র সরকারী পরিচালক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার শফিকুল আলম সোমবার প্রতিবেদন না দেওয়ায় ঢাকার মহানগর হাকিম দেবব্রত বিশ্বাস আগামী ২৩ মার্চ নতুন তারিখ ঠিক করে দেন।

সাগর-রুনির মৃত্যুবার্ষিকীর আগেরদিন আদালতের এই আদেশের পর সালেহা মনিরের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “আগামীকাল (১১ ফেব্রুয়ারি) সাগর-রুনি হত্যার আট বছর। অথচ সাংবাদিক হত্যার একটা মামলায় আট বছরেও তদন্তে কোনো আশানুরূপ ফল নেই।

“এক বছরের বেশি সময় ধরে আমার সঙ্গে তদন্ত কর্তৃপক্ষের কেউ যোগাযোগ করেনি। এখন তদন্ত কর্মকর্তা কে, সেটাও আমি জানি না। ডা. নিতাই হত্যা মামলার কতগুলো আসামি, কিছু চোর-ডাকাতকে সাগর-রুনি হত্যা মামলায় আসামি করে ধরে রাখা হয়েছে। আমার কাছে দৃঢ়ভাবে মনে হচ্ছে এরা সাগর-রুনি হত্যা মামলায় জড়িত নয়। এদের ছেড়ে দেওয়া উচিত।”

তদন্ত নিয়ে ‘নাটক করা হচ্ছে’ বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

“কিন্তু আমি বিচার চাইতেই থাকব, উপরে আল্লাহ আছেন তো। তিরিশ বছর পর সগীরা মোরশেদ হত্যা মামলার তদন্ত চালু হল, সঠিক আসামি ধরা হল। কয়েকজন সাংবাদিক হত্যার বিচারও শেষ হল। আমরা কেন বিচার পাব না।”

পুত্র ও পুত্রবধূ হত্যাকাণ্ডের বিচার আট বছরেও না পেয়ে এখন হতাশ সাগর সরওয়ারের মা সালেহা মনির (ফাইল ছবি)

এর আগে হাই কোর্ট দ্রুত মামলাটির তদন্ত নিষ্পত্তি করতে বলেছিল জানিয়ে তিনি প্রশ্ন রাখেন, “কোর্ট তদন্ত শেষ করার জন্য সময় বেঁধে দিতে পারে না? আইনে কি এর বিধান নেই?”

সাগর-রুনির একমাত্র সন্তান মেঘের কথা জানতে চাইলে সালেহা জানান, “নওশেরের (মেহেরুন রুনির ভাই) কাছে মেঘ ভালোই আছে আশা করি।”

২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় খুন হন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার এবং এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি। দুজনকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। ওই রাতে তারা ছাড়া ঘরে ছিল তাদের একমাত্র শিশুসন্তান।

হত্যাকাণ্ডের পরপরই কারণ অনুসন্ধান করে খুনিদের শাস্তি দিতে সে সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন সময় নিয়েছিলেন ৪৮ ঘণ্টা। কিন্তু আট বছরে কয়েকদফা তদন্ত কর্মকর্তা বদলেও কোনো আলোর দেখা মেলেনি।

হত্যাকাণ্ডের পর রুনির ভাই মো. নওশের আলম রোমানের করা মামলাটি প্রথমে তদন্ত করেন শেরেবাংলা নগর থানার এসআই জহুরুল ইসলাম। তার কাছ থেকে তদন্তের দায়িত্ব গিয়েছিল ডিবির পরিদর্শক রবিউল আলমের কাছে।

৬২ দিন পর ডিবি আদালতের কাছে ব্যর্থতা স্বীকার করলে ২০১২ সালের এপ্রিলে তদন্তের দায়িত্বে আসে র‌্যাব। এরপর র‌্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তার হাত ঘুরে তদন্তভার আসে খন্দকার শফিকুল আলমের হাতে। তিনিও তদন্ত প্রতিবেদন দিতে দফায় দফায় সময় নিয়েছেন।

গত ১১ নভেম্বর এই মামলার তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে হাই কোর্ট।

সেদিন তদন্ত কর্মকর্তা আদালতকে জানান, তদন্তে কোনো ক্লু (সূত্র) পাওয়া যায়নি। চারটি ডিএনএ প্রতিবেদনের মধ্যে দুটি মিলেছে। এ দুটিতে আসামিদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি বলে সেগুলো ফের যুক্তরাষ্ট্রে এফবিআইর ল্যাবে পাঠানো হয়েছে।

তদন্তের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে আগামী ৪ মার্চের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে র‌্যাবকে।

সোমবার ফের প্রতিবেদন জমার নতুন তারিখ পড়ার পর মামলার অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তদন্ত কর্মকর্তা শফিকুল আলম বলেন, “খুব দ্রুত অভিযোগপত্র জমা দেওয়া যাবে।”

মামলাটিতে গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে রয়েছেন ওই বাড়ির নিরাপত্তা রক্ষী এনাম আহমেদ ওরফে হুমায়ুন কবির, রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মিন্টু ওরফে বারগিরা মিন্টু ওরফে মাসুম মিন্টু, কামরুল হাসান অরুণ ও আবু সাঈদ।

রুনির কথিত বন্ধু তানভীর রহমানকে ২০১২ সালের ১ অক্টোবর গ্রেপ্তারের পর দুই বছর কারাগারে থাকার পর ২০১৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর জামিন পান।

যে বাড়িটিতে সাগর-রুনি খুন হন সেই বাড়ির দারোয়ান পলাশ রুদ্র পালও জামিনে বাইরে রয়েছেন।

এই মামলায় ছয় আসামি আটক হয়ে কারাগারে থাকলেও পুলিশ আরও দুজনকে খুঁজছে বলে তদন্ত কর্মকর্তা খন্দকার শফিকুল আলম জানিয়েছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,  “এফবিআই চার ব্যক্তির ডিএনএ শনাক্ত করেছে। তার মধ্যে দুইটি ডিএনএ সাগর-রুনির। বাকি দুটি ডিএনএর সঙ্গে গ্রেপ্তার আসামিদের ডিএনএ ম্যাচ করেনি।

“বাকি দুজনের ডিএনএ যে ব্যক্তির তাদেরকে গ্রেপ্তার করতে পারলে মামলার তদন্ত অনেকাংশে এগিয়ে যাবে।”

‘ওই দুজনকে’ গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে জানান তিনি।

বাদীও হতাশ

আট বছরেও বিচার শুরু না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন মামলার বাদী রুনির ভাই নওশের আলম রোমান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ”মামলার তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই। কোনো কূলকিনারা দেখছি না। ছোট্ট মেঘ এখন পড়ছে সপ্তম শ্রেণিতে।

“কীভাবে বিচারের তদন্ত শেষ হবে এবং কোনদিন বিচার পাব কিছু বুঝতে পারছি না। হতাশার গহ্বরে আছি। আশার কোটাও শূন্য।”

তদন্তের কার্যক্রম নিয়ে রোমান বলেন, ”উচ্চ আদালতও তদন্তের অগ্রগতি জানতে চেয়েছে। মার্চ মাসে তারিখ আছে। বর্তমানে যারা তদন্ত করছে, তারা ব্যর্থ হলে বলবে। এটা রাষ্ট্রের বিষয়, আমি কিছু বলব না।”