সারা দেশে সব ধরনের জুয়াই নিষিদ্ধ: হাই কোর্ট

ঢাকার অভিজাত ১৩ ক্লাবসহ সারা দেশে সব ধরনের জুয়া খেলাই নিষিদ্ধ বলে রায় দিয়েছে হাই কোর্ট।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Feb 2020, 07:46 AM
Updated : 10 Feb 2020, 12:02 PM

পাশাপাশি দেশের কোথাও ‘জুয়ার উপকরণ’ পাওয়া গেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তা জব্দের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

‘জনস্বার্থে’ সুপ্রিম কোর্টের দুই আইনজীবীর করা এক রিট আবেদনে চার বছর আগে হাই কোর্টের জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করে বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি মো. মাহমুদ হাসান তালুকদারের হাই কোর্ট বেঞ্চ সেমবার এই রায় দেয়।

আদালতে ঢাকা ক্লাবের পক্ষে রুল শুনানি করেন আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার। আর রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী রেদওয়ান আহমেদ রানজিব।

রায়ে বলা হয়, যেসব খেলার ফলাফল দক্ষতার বদলে ‘চান্স’ বা ভাগ্য দিয়ে নির্ধারিত হয়, সেগুলোই জুয়া খেলা।

আদালত বলেছে, হাউজি, ডাইস, ওয়ান টেন, চরচরির মতো খেলাগুলো দক্ষতার পরিবর্তে ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে। আইনে এসব খেলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

এ ধরনের খেলার অনুমতি, খেলার আয়োজক ও অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশের পাশাপাশি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এসব খেলার সরঞ্জাম জব্দের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে রায়ে।

ঢাকা মহানগর ও মহানগরের বাইরে থ্রি কার্ড, ফ্লাস, হাউজি- ইত্যাদি খেলার আয়োজন করাও ‘অপরাধ’ জানিয়ে আদালত বলেছে, যারা এ ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত, তারা আইনের দৃষ্টিতে অপরাধী।

আদালত পর্যক্ষণে বলেছে, ১৮৬৭ সালের জুয়া আইনে ঢাকা মহানগরীর বাইরে জুয়া খেলার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এই আইনে সাজার পরিমাণ খুবই নগন্য, মাত্র ২০০ টাকা জরিমানা ও ৩ মাসের কারাদণ্ড। আবার মহানগরের ভেতরে জুয়া খেললে ওই আইন ও পুলিশ অধ্যাদেশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই।

“আমরা মনে করি, সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জুয়া আইন বৈষম্যমূলক। কারণ সংবিধানেই বলা হয়েছে আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান। অপরাধ,অপরাধই। এখানে ধনী ও গরিবের বৈষম্য করার সুযোগ নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও এ বিষয়টি মনে রাখতে হবে।”

জুয়া ও ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানকে সাধুবাদ জানিয়ে আদালত পর্যবেক্ষণে বলেছে, “সরকার ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান পরিচালনা করছে। আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয় যে এই অভিযানের মুখ্য উদ্দেশ্যে হচ্ছে ক্যাসিনো ও জুয়া খেলাকে নিরুৎসাহিত করা। কিন্তু অভিযানের পাশাপাশি জুয়া ও ক্যাসিনো বন্ধে আইনে সাজা বাড়ানোও উচিত।”

রায়ের পর ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার সাংবাদিকদের বলেন, “যে খেলাগুলো ভাগ্যের উপর নির্ভরশীল সে খেলাগুলো জুয়া হিসেবে ঘোষণা করে অবৈধ করা হয়েছে। যে ক্লাবগুলোকে প্রাইভেট প্লেস বলা হচ্ছিল, সেগুলোকে পাবলিক প্লেস বলা হয়েছে, কারণ সদস্যদের সাথে বহিরাগতরাও এসব ক্লাবে যেতে পারেন।

“ফলে যে নামেই অবিহিত করা হোক না কেন, নিপুন খেলা, চরচরি, ডাইস এক থেকে দশ, হাউজি, থ্রি কার্ড ইত্যাদি যে খেলাগুলো ভাগ্যের উপর নির্ভরশীল, দক্ষতার উপর নয়, সেগুলোকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে।

“আর রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যেখানেই তারা এগুলো পাবে দমন করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করবে। এ রায়টি সারা দেশের জন্যই প্রযোজ্য।”

সরকারের এ আইন কর্মকর্তা বলেন, জুয়া আইনে জুয়ার সংজ্ঞায় ‘পাবলিক প্লেসের’ কথা কবরা হয়েছে। অর্থাৎ, পাবলিক প্লেসে হলে সে খেলাটা জুয়া হবে। ক্লাবগুলো দাবি করে আসছিল ক্লাব হচ্ছে প্রাইভেট প্লেস।

“কিন্তু আদালত রায়ে ক্লাবগুলোও পাবলিক প্লেস হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। ফলে এতদিন ক্লাবগুলোতে বিভিন্ন খেলা চলে আসলেও অর্থের বিনিময়ে বা ভাগ্যের উপর নির্ভরশীল কোনো খেলা এখন থেকে আর কেউ খেলতে পারবে না।”

আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, “এ মামলায় বাংলাদেশের অন্যতম সামাজিক ক্লাব ঢাকা ক্লাবের পক্ষে আমরা প্রতিনিধিত্ব করেছিলাম। আমরা আদালতকে বলেছিলাম যে, স্বাভাবিকভাবে জুয়ার যে বিষয়গুলো সেটি সামাজিক এসব ক্লাবগুলোতে হয় না। পরিবার এবং ক্লাবের সদস্যদের বিনোদন, মনোরঞ্জনের জন্য কিছু আভ্যন্তরীণ খেলা হয়।

“ওয়ানটেন, ডাইস, এগুলো কিন্তু সেখানে হয় না। দুইটা খেলার কথা বলেছি, যেগুলো ক্লাবগুলোতে হয়, একটা হলো হাউজি, যেটি পাবলিকলি হয়ে থাকে। যেমন জাতীয় প্রেসক্লাবে হয়ে থাকে। সেটিও পরিবারের সদস্যদের মধ্যে। দ্বিতীয়ত ক্লাবের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে কার্ড খেলেন। অর্থাৎ, জুয়া যে অর্থে বলা হচ্ছে সামাজিক ক্লাবগুলোতে সেগুলো হয় না।”

এ আইনজীবী জানান, ঢাকা ক্লাব কর্তৃপক্ষ পূর্ণাঙ্গ রায় দেখার পর সিদ্ধান্ত নেবে এর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ তারা নেবে কি না।

ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অভিযাত ক্লাবে ইনডোর গেইমের নামে ডাইস ও হাউজি খেলার ‘বেআইনি ব্যবসার আয়োজন’ চ্যালেঞ্জ করে মোহাম্মদ সামিউল হক ও রুকন উদ্দিন মো. ফারুক নামে দুই আইনজীবী ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে হাই কোর্টে এই রিট আবেদন করেন।

সেই আবেদনে বলা হয়, ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশ এবং পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট অনুযায়ী টাকার বিনিময়ে ‘ইনডোর গেইম’ খেলা অবৈধ এবং সংবিধানের ১৮ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন হলেও ক্লাবগুলো ওই কাজ করে আসছে।

সংবিধানের ১৮ (২) অনুচ্ছেদে নৈতিকতা রক্ষায় রাষ্ট্রের দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে, “গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন৷”

আর ১৮৬৭ সাল থেকে চালু 'প্রকাশ্য জুয়া আইন’ বলছে, কেউ টাকার বিনিময়ে বাজি বা জুয়ার আসর বসালে এবং কেউ তাতে অংশ নিলে তা হবে দণ্ডনীয় অপরাধ।  

ওই আবেদনের ওপর প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ৪ ডিসেম্বর ১৩টি ক্লাবে ‘আইন বহির্ভূতভাবে ও টাকার বিনিময়ে’ হাউজি, ডাইস, তাস ও যে কোনো ধরনের জুয়া খেলা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয় বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী ও শেখ হাসান আরিফের হাই কোর্ট বেঞ্চ।

পাশাপাশি এসব ক্লাবে বেআইনিভাবে হাউজি, কার্ড ও ডাইস খেলার ব্যবসার আয়োজন করায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কেন যথাযথ পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেওয়া হবে না- তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে আদালত।

১৩ ক্লাব হলো- ঢাকা ক্লাব, উত্তরা ক্লাব, গুলশান ক্লাব, ধানমন্ডি ক্লাব, বনানী ক্লাব, অফিসার্স ক্লাব ঢাকা, ঢাকা লেডিস ক্লাব, ক্যাডেট কলেজ ক্লাব, চিটাগাং ক্লাব, চিটাগাংসিনিয়রস ক্লাব, নারায়ণগঞ্জ ক্লাব, সিলেট ক্লাব ও খুলনা ক্লাব।

স্বরাষ্ট্রসচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, ঢাকা মহানগর, চট্টগ্রাম মহানগর, খুলনা মহানগর, সিলেট মহানগরের পুলিশ কমিশনার, র্যাবের মহাপরিচালক, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসকদের আদালতের এ আদেশ পালন করতে নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট।

কিন্তু ঢাকা ক্লাব কর্তৃপক্ষের লিভ টু আপিলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাই কোর্টের ওই নিষেধাজ্ঞা স্থগিত করে হাই কোর্টে রুল নিষ্পত্তির আদেশ দেয়।

বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি মো. মাহমুদ হাসান তালুকদারের হাই কোর্ট বেঞ্চে গত ২৩ জানুয়ারি রুল শুনানি শেষে বিষয়টি ২৮ জানুয়ারি রায়ের জন্য রাখা হলেও তা পিছিয়ে যায়। সোমবার সেই রায়ে রুলটি যথাযথ ঘোষণা করা হলে ক্লাবগুলোতে টাকার বিনিময়ে খেলার আয়োজনের সুযোগ বন্ধ হয়ে গেল।