নির্বাচনী পোস্টারে পড়ুয়াদের খাতা

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের ভোটে নির্বাচনী প্রচারে ব্যবহৃত পোস্টার সামগ্রীকে সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের জন্য কাজে লাগাতে মাঠে নেমেছে স্বেচ্ছাসেবী একটি সংগঠন।

মামুনুর রশীদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Feb 2020, 06:32 PM
Updated : 6 Feb 2020, 07:07 PM

বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন নামের এ সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবী ও কর্মীরা সেসব পোস্টার সংগ্রহ করে বানাবেন খাতা। তাতে শিশুদের জন্য কেবল যে লেখার ব্যবস্থা হবে তাই নয়, পেস্টারের আবর্জনা থেকে কিছুটা হলেও মুক্ত হবে ঢাকা। 

গত ১ ফেব্রুয়ারি ভোট শেষে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের এই উদ্যোগের ঘোষণা এলে ফেইসবুকে তা আলোচনার জন্ম দেয়। তাদের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন বিজয়ী প্রার্থীরাও।  

ফাউন্ডেশনের কর্মী হাবিবুর রহমান সম্রাট বলেন, “বিদ্যানন্দের শিক্ষার্থীদের সারা বছরের সকল বই-খাতা সরবরাহ করি আমরাই। ফলে প্রচুর খাতা দরকার হয় আমাদের। এমনও শিক্ষার্থী আছে, যারা ক্যালেন্ডারের পেছনে লেখে, পেন্সিলে লেখা খাতা রাবার দিয়ে মুছে আবার ব্যবহার করে। এই খাতার চাহিদা মেটানোর উপায় দেখতে পাই আমরা নির্বাচনী পোস্টারে।”

তার ধারাবাহিকতায়২ ফেব্রুয়ারি মিরপুর এলাকা থেকে  সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবী ও কর্মীদের পোস্টার সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়।

এবার ঢাকার ভোটে উত্তর ও দক্ষিণে ১৩ মেয়র প্রার্থীসহ কাউন্সিলর মিলিয়ে সাড়ে সাতশ প্রার্থী ছিলেন। মেয়র প্রার্থীদের প্রত্যেকে গড়ে ৪ লাখের বেশি পোস্টার ছাপিয়েছেন। কাউন্সিলররাও ছেপেছেন ৫-১০ হাজার করে। শীতের কুয়াশা থেকে বাঁচাতে অধিকাংশ প্রার্থীর পোস্টার ঝোলানো হয়েছে প্লাস্টিকে মুড়ে বা লেমিনেটিং করে। 

কাগজে-কলমে পোস্টারের এই হিসাব প্রার্থীরা দিলেও সঠিক সংখ্যা আরও অনেক বেশি বলে অনেকের ধারণা। একটি বেসরকারি সংস্থা সংবাদ সম্মেলন করে এ নিয়ে উদ্বেগও প্রকাশ করে। তাদের দাবি, পোস্টারের সংখ্যা হবে কয়েক কোটি, তাতে আড়াই হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হবে।

আর তখনই ‘আপনার কাছে যা বর্জ্য, অন্যের জন্য তা সম্পদ’ এই স্লোগান নিয়ে সামনে আসে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। কেবল খাতা নয়, ভোটের পোস্টার সংগ্রহ করে তারা তৈরি করছেন ঠোঙ্গা, শপিং ব্যাগসহ নানা সামগ্রী।

 

বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের কর্মী হাবিবুর রহমান সম্রাট বলেন, পরিত্যক্ত প্লাস্টিক, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, কাগজ, মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়া ওষুধ- এসব আবর্জনা পরিবেশের ওপর গুরুতর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে প্রতিনিয়ত। এই আবর্জনাগুলোর পুনর্ব্যবহারের উপায় বের করার চিন্তা চলছিল বহুদিন ধরে।

“আমরা এমন উপায় বের করতে চেয়েছিলাম যা আমাদের কাজে লাগবে, অন্যরাও তা সহজেই অনুসরণ করতে পারবে। আবর্জনার পুনর্ব্যবহারের উপায় ছড়িয়ে যাবে পাড়ায় পাড়ায়।”

সম্রাট বলেন, এবার তিন ধরনের পোস্টার ব্যবহার হয়েছে। একপাশে ছাপানো পোস্টারগুলো ব্যবহার হচ্ছে খাতা তৈরিতে।

“আমাদের লক্ষ্য ৪০ হাজার খাতা তৈরি করা। দুই পাশে ছাপানো পোস্টারগুলো দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে ঠোঙ্গা, যা ব্যবহার হবে রোজার মাসে ইফতার বিতরণের কাজে। লেমেনেটিং করা পোস্টার দিয়ে তৈরি করছি শপিং ব্যাগ, পোস্টার ঝোলানোতে ব্যবহৃত দড়ি ব্যবহার হচ্ছে হাতল হিসেবে।”

এছাড়া লিফলেটগুলোর পেছনের সাদা পৃষ্ঠা ফাউন্ডেশনের ১ টাকায় চিকিৎসা প্রকল্পে চিকিৎসকের পরামর্শপত্র বা ‘প্রেশক্রিপশন’ লেখার কাজে ব্যবহারের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন কাজেও ব্যবহার করা হচ্ছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত মেয়র আতিকুল ইসলাম জানান, পোস্টার এবং অব্যবহৃত বিলবোর্ডগুলো দিয়ে কী করবেন, তা নিয়ে যখন ভাবছিলেন, সে সময় একজন আত্মীয় তাকে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগের কথা বলেন।

“আমি তো আইডিয়াটা শুনে খুবই খুশি হলাম। এটা দিয়ে একটা সামাজিক কাজ হোক এটাই আমি চাই। খাতা বানানো ছাড়াও তাদের অন্যান্য কাজে অনেক কাগজ লাগে।”

শুধু পোস্টার নয়, অব্যবহৃত কাগজও ফেলে না দিয়ে বা নষ্ট না করে এ ধরনের স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

সম্রাট জানান, প্রতিটি এলাকায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে তারা নিজেরাই পোস্টার সংগ্রহ করছেন। এছাড়া বিভিন্ন এলাকার মানুষ পোস্টার সংগ্রহ করে ফাউন্ডেশনে জানাচ্ছেন।

 

“আমরা নিজ উদ্যোগে তা সংগ্রহ করে আনছি। সাড়া পাচ্ছি নির্বাচিত-অনির্বাচিত প্রার্থীদের কাছ থেকেও। প্রচারের জন্য ছাপানো বাড়তি পোস্টার, লিফলেট, ব্যানার তাদের অফিস থেকে সংগ্রহ করা জন্য তারা ডেকে পাঠাচ্ছেন আমাদের।”

বিদ্যানন্দের কর্মীদের মতে, অব্যবহৃত পোস্টার আনতে সমস্যা হচ্ছে না ঠিক, তবে সংগ্রহ করে আনা অনেক পোস্টার ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গেছে। তাই যারা নিজেরা সংগ্রহ করে বিদ্যানন্দে পাঠাতে চান, তারা যেন পোস্টারগুলো ভালোভাবে সংরক্ষণ করেন সেই অনুরোধ রেখেছেন কর্মীরা। ০১৮৭৮১১৬২৩৪ নম্বরে ফোন করে জানালে স্বেচ্ছ্বাসেবীরা গিয়ে সেসব পোস্টার নিয়ে আসবে।

মিরপুরে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের কার্যালয়ে এখন চলছে খাতা বানানোর কাজ। সেই কাজে ব্যস্ত স্বেচ্ছ্বাসেবী দিপ্তী চৌধুরী বলেন, “২০১৫ সালে চাকরি করতাম, এখন গৃহিনী। সেসময় সহকর্মীদের মাধ্যমে পরিচয় হয় বিদ্যানন্দের সঙ্গে, কাজ শুরু করি তাদের বিদ্যালয়ে শিক্ষিকা হিসেবে। তারপর চাকরি ছেড়ে দিলেও বিদ্যানন্দ ছাড়তে পারিনি।”

অর্থ নয়, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে পারার তৃপ্তির লোভেই কাজ করে যাচ্ছেন বলে জানান দিপ্তী।

ফাউন্ডেশনের ভবিষ্যত পরিকল্পনা জানিয়ে সম্রাট বলেন, “খাতার প্রয়োজন আমাদের বরাবরই থাকবে, তাই সর্বস্তরের মানুষের প্রতি অনুরোধ থাকবে কাগজ দিয়ে সাহায্য করার। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেও যোগাযোগ করছি আমরা। শিক্ষার্থীদের জমা দেওয়া অ্যাসাইনমেন্টের কাগজগুলোর একপৃষ্ঠা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অব্যবহৃত থাকে এবং একবার তা শিক্ষকদের দেখা হয়ে গেলে আর কাজে আসে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এই কাগজগুলো আমাদের হাতে তুলে দিলে তা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের খাতা হিসেবে ব্যবহার হতে পারে সহজেই।”

বিদ্যানন্দের প্রতিষ্ঠাতা নিজেই এসেছেন সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণি থেকে। নিজের উদ্যোগে আর অর্থায়নে শুরু করলেও এখন এটি শত মানুষের সহযোগিতায় চলছে।

বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন সরকারের নিবন্ধিত একটি শিক্ষা সহায়ক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। ৪০ জন কর্মকর্তা, কয়েকশ স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে আটটি শাখায় এ ফাউন্ডেশনের কাজ চলছে। নিজস্ব ক্যাম্পাসে নবনির্মিত অনাথাশ্রম আর পরিপূর্ণ স্কুলের স্বপ্ন দেখছে বিদ্যানন্দ।

ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে বলা হয়, “আমরা সবাই সাধারণ মানুষ, ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে চলছি, চেষ্টা করছি কিছু মানুষকে স্বপ্ন দেখাতে। জানি এতে বিশ্বের কোনো পরিবর্তন হবে না, তবুও চেষ্টাটা করতে চাচ্ছি।”

১ টাকায় আহার, ১ টাকায় চিকিৎসা, ১ টাকায় আইনি সেবা, ইফতার বিতরণ, শীতবস্ত্র বিতরণ- বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের আরও কয়েকটি আলোচিত উদ্যোগ।