কেন্দ্রগুলোর বাইরে জটলা, তবে পক্ষ তাদের একটিই

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাতটি কেন্দ্র ঘুরে ভোটারদের উপস্থিতি খুব একটা দেখা না গেলেও প্রতিটি কেন্দ্রের বাইরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের সরব উপস্থিতি দেখা গেছে।

ফয়সাল আতিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Feb 2020, 08:22 PM
Updated : 1 Feb 2020, 08:23 PM

এসব কেন্দ্রের অন্তত ৩৪টি বুথ পরিদর্শন করে সবকটিতে নৌকার সমর্থকদের পোলিং এজেন্ট দেখা গেলেও ধানের শীর্ষের পোলিং এজেন্ট ছিলেন মাত্র ছয়জন। তবে যেসব ভোটারের সঙ্গে কথা হয়েছে তাদের অধিকাংশই নির্বিঘ্নে ভোট দেওয়ার কথা জানিয়েছেন।

শনিবার সকাল ৮টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত কেন্দ্রগুলো ঘুরে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।

সকাল ৯টার দিকে ছোট ভাই ইশফাক হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে পুরান ঢাকার গোপীবাগের শহীদ শাহজাহান প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দেন ধানের শীষের প্রার্থী। এ সময় সাংবাদিক ও ধানের শীষের সমর্থকদের হুড়োহুড়িতে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে ইভিএম বিকল হয়ে যায়। পরে অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যেই নির্বাচন কর্মীরা তা মেরামত করতে সক্ষম হন।

এই কেন্দ্রে ধানের শীষের পোলিং এজেন্ট দেখা গেছে; ভোটকেন্দ্রের বাইরেও আওয়ামী লীগের পাশাপাশি বিএনপির কর্মীরাও ছিলেন।

যে ইভিএম মেশিনে ইশরাক ভোট দিয়েছেন, সেখানে এক ঘণ্টায় ভোট পড়েছে মাত্র চারটি।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে শনিবার সকালে ছোট ভাই ইশফাক হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে গোপীবাগের শহীদ শাহজাহান প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী ইশরাক হোসেন।

সকাল পৌনে ১০টার দিকে গোপীবাগ সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজ কেন্দ্রে নিজ দলের পোলিং এজেন্টদের বের করে দেওয়ার খবরে সেখানে হাজির হন ইশরাক হোসেন। কেন্দ্রে ঢুকে বিষয়টি নিয়ে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করে বেরিয়ে আসেন তিনি।

তবে এই কেন্দ্রের ভেতরে মাঠে ও বাইরের সড়কে নৌকার ব্যাজ ঝোলানো শতাধিক মানুষের উপস্থিতি দেখা গেছে। বিএনপি বা অন্য কোনো প্রার্থীর কর্মীদের সেখানে দেখা যায়নি।

সকাল পৌনে ১০টা পর্যন্ত এই কেন্দ্রের দুটি বুথের একটিতে ২৩টি এবং অন্যটিতে ৩৫টি ভোট পড়ে। প্রতিটি বুথেই ৩৬০টি করে ভোট রয়েছে। এই দুটি বুথেই ধানের শীষের এজেন্টদের উপস্থিতি দেখা গেছে।

সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে আর কে মিশন রোডে ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবের ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী ইশরাক হোসেনের মা ইসমত আরা। তবে ভোটের পরিবেশ নিয়ে কোনো মন্তব্য না করেই চলে যান তিনি।

ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবের মহিলা ভোটারদের জন্য দুটি কেন্দ্র খোলা হয়, যেখানে ১০টি বুথে প্রায় ৩৩০০ ভোটার ছিলেন। তবে ১০টি বুথে ধানের শীষের কোনো পোলিং এজেন্ট দেখা যায়নি।

একটি বুথ থেকে বিমর্ষ অবস্থায় ধানের শীষের পোলিং এজেন্টকে বেরিয়ে যেতে দেখা যায়। কোথায় যাচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ওরা চলে যাওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে, তাই চলে যাচ্ছি।”

তবে কারা চাপ দিচ্ছে তা বলতে রাজি হননি তিনি।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে শনিবার সকালে গোপীবাগের শহীদ শাহজাহান প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দেওয়ার পর জয়ের আশা প্রকাশ করেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী ইশরাক হোসেন।

এই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তার আওতাধীন পাঁচটি বুথে কোনো ধরনের অনিয়ম হয়নি। সকাল থেকেই শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণ হচ্ছে। কেন্দ্রের ১৬০০ ভোটের মধ্যে সকাল ১০টা ২০ মিনিট পর্যন্ত ১০৭টি ভোট পড়েছে।

একজন এজেন্ট চলে যাওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “তিনি প্রাকৃতিক প্রয়োজন সারতে বাইরে গেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবেন।”

কারও হুমকি পেয়ে চলে গেছেন বলে অভিযোগের কথা বললে তিনি বলেন, এ ধরনের কোনো অভিযোগের কথা তাকে বলা হয়নি।

ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবের মাঠে কয়েকশ নারী-পুরুষের জটলা দেখা যায়। তাদের অনেকের গলায় নৌকার স্টিকার ঝোলানো ছিল। কেন্দ্রের বাইরেও ছিলেন ৬০ থেকে ৭০ জন মানুষ।

মহিলা কেন্দ্রের ভেতরে ও বাইরে ভোটার ছাড়াও অন্যান্য মানুষের উপস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা জালাল উদ্দিন বলেন, মানুষের জটলা থাকলেও তারা কোনো হট্টগোল করছেন না। তবুও মাঝে মধ্যে এসব মানুষকে চলে যেতে বলছেন তারা।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে শনিবার খিলগাঁও মডেল কলেজ কেন্দ্রের সামনে বিজিবি সদস্যদের অবস্থান। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

দুপুর ১টার দিকে পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট এলাকায় পরিবার পরিকল্পনা সমিতি মিলনায়তনের ভোট কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, কেন্দ্রের প্রবেশ মুখেই সামিয়ানা টাঙিয়ে বসে আসেন নৌকার প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপসের সমর্থকরা। এই কেন্দ্রেও ভোটারের উপস্থিতি ছিল খুবই কম। তবে যারা ভোট দিতে এসেছিলেন তারা কোনো ধরনের বাধা-বিঘ্ন ছাড়াই ভোট দিতে পেরেছেন বলে অন্তত চারজন ভোটার জানিয়েছেন।

এই মহিলা কেন্দ্রে ২ হাজার ৬৩১ জন ভোটারের জন্য ৭টি বুথ খোলা হয়। দুপুর ১২টা পর্যন্ত সেখানে ভোট পড়ে ১৬২টি। এখানে ধানের শীর্ষের দুজন পোলিং এজেন্ট দেখা যায়।

ধানের শীর্ষের একজন পোলিং এজেন্ট অভিযোগ করেন, তাদের অন্যান্য পোলিং এজেন্টরা আসলেও পরে ভয়ভীতির কারণে চলে গেছেন।

“আমাকেও যুবলীগের কিছু লোক চলে যাওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিল। পরে নৌকার পোলিং এজেন্টের দায়িত্ব পাওয়া কয়েকজন এসে আমার পক্ষ নিয়েছে। তারা আমাকে বসার ব্যবস্থা করে দিয়েছে,” বলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই এজেন্ট।

এই কেন্দ্রে অন্তত চারজন ভোটারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোনো ধরনের চাপ ও ভয়ভীতি ছাড়াই তারা নিজের ভোট নিজে দিয়ে কেন্দ্র থেকে বের হতে পেরেছেন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে শনিবার খিলগাঁও মডেল কলেজ কেন্দ্রে ভোটার না থাকায় অলস সময় পার করছেন প্রার্থীদের এজেন্টরা। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

অন্যান্য কেন্দ্রে ইভিএম মেশিন নিয়ে কোনো অভিযোগ পাওয়া না গেলেও এই কেন্দ্রে দুটি ইভিএম মেশিন বিকল হতে দেখা গেছে। এর মধ্যে একটি মেশিন বিকল হয়ে পড়ায় তা স্থানান্তর করে আরেকটি মেশিন বসিয়ে ভোট নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এছাড়া আরেকটি মেশিনে কয়েকজন ভোটারের আঙুলের ছাপ মিলছিল না।

এই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা তৌফিক আলী বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ ও চাপমুক্তভাবে’ তিনি ভোট নিতে পারছেন। কয়েকটি মেশিনে সমস্যা দেখা দিলেও তা পরিবর্তনের ব্যবস্থা রয়েছে। তারা সঙ্গে সঙ্গে তা পরিবর্তন করে দিয়েছেন।

কেন্দ্রের বাইরে নৌকার সমর্থকদের সবচেয়ে বড় জটলা দেখা গেছে সেগুনবাগিচা হাই স্কুল (৩৭৬), আইডিয়াল মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (৩৭৭), বেগম রহিমা আদর্শ বালিকা বিদ্যালয় (৩৭৮) ও আজিমপুর কলোনিতে অবস্থিত অগ্রণী স্কুল কেন্দ্রে।

এর মধ্যে সেগুনবাগিচার একটি স্কুল কম্পাউন্ডকে ঘিরেই রয়েছে ৩৭৬, ৩৭৭ ও ৩৭৮ নম্বর ভোট কেন্দ্র। এই তিন কেন্দ্রেই রয়েছে প্রায় আট হাজার ৫০০ ভোটার। দুপুরে এই তিন কেন্দ্রের মূল ফটকের বাইরে নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের সমর্থকদের বড় ধরনের জটলা দেখা যায়। তারা প্লাস্টিকের চেয়ার নিয়ে এসে সেখানে বসে ছিলেন। ভেতরে ১৬টি বুথ ঘুরে সেখানে ধানের শীষের কোনো পোলিং এজেন্ট দেখা যায়নি।

নৌকা প্রতীকের একজন পোলিং এজেন্ট বলেন, “সকালে ধানের শীষের পোলিং এজেন্টের কেউ কেউ আসলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা চলে গেছেন। কী কারণে তারা চলে গেছেন তা বলতে পারছি না।”

মির্জা আব্বাস মহিলা ডিগ্রি কলেজ কেন্দ্রে পুলিশের নিরাপত্তা। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

বেগম রহিমা আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা আতিকুর রহমান খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সকালে ধানের শীষসহ বিভিন্ন প্রার্থীর এজেন্টই ভোটকেন্দ্রে এসেছিলেন। তবে কেন্দ্রের ভেতরে কোনো ধরনের উত্তেজনা ছাড়াই তারা ‘নিজেদের মতো করে’ চলে গেছেন।

এই কেন্দ্রে ৩৩০০ ভোটারের মধ্যে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ভোট দিয়েছিলেন ৩৫০ জন। অর্থাৎ ভোট পড়ে ১১ শতাংশের কাছাকাছি।

বেলা ৩টার দিকে আজিমপুরে লিটল এঞ্জেল ভোট কেন্দ্রের ৫টি বুথে ১৭০৩ ভোটের মধ্যে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৩২১টি ভোট পড়েছিল। বেলা দেড়টার দিকে ভোট পড়েছিল ৪৭৩টি। এই কেন্দ্রের ৫টি বুথে ধানের শীষের একজন পোলিং এজেন্ট দেখা গেছে।

এই পোলিং এজেন্ট বলেন, তিনি চাপমুক্তভাবেই দায়িত্ব পালন করতে পারছেন। তবে বাইরে লম্বা সময় ধরে হৈ-হুল্লুড় হয়েছে। এরপর থেকেই ভোটার উপস্থিতি কমে গেছে।