শনিবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত দুই সিটির প্রায় আড়াই হাজার কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) এই ভোট হবে। ঢাকার ৫৪ লাখ ভোটার স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সাড়ে সাতশ প্রার্থীর মধ্যে থেকে দুই সিটির জন্য তাদের নতুন জনপ্রতিনিধি বেছে নেবেন।
তবে একজন নির্বাচন পর্যবেক্ষক এ ভোটকে বড় পরিসরে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) গ্রহণযোগ্যতা, আওয়ামী লীগের টানা তৃতীয় মেয়াদের সরকারের প্রথম বছরের জনপ্রিয়তা এবং সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন কমিশনের জন্য পরীক্ষা হিসেবেও দেখছেন।
জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদ-জানিনপ চেয়ারম্যান অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলছেন, “জাতীয় নির্বাচনের এক বছরের মাথায় ঢাকা মহানগরের এই ভোট অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে। কাজেই এ ভোটের ফলাফল একটা বার্তা হয়ত দিতে পারে।”
নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে ভোটের সব প্রস্ততি শেষ করেছে। শুক্রবারই ইভিএমসহ সব সরঞ্জাম পৌঁছে দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রে কেন্দ্রে। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটের আশ্বাস দিয়ে ভোটারদের কেন্দ্রে গিয়ে নিজেদের অধিকার প্রয়োগ করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা।
# ভোটার: ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ভোটার ৩০ লাখ ১০ হাজার ২৭৩, দক্ষিণ সিটিতে ভোটার ২৪ লাখ ৫৩ হাজার ১৯৪।
# প্রার্থী: ঢাকা উত্তরে একটি মেয়র পদে ছয়জন, সাধারণ কাউন্সিলরের ৫৪টি পদে ২৫১ জন এবং সংরক্ষিত কাউন্সিলর ১৮টি পদে ৭৭ জন লড়ছেন।
ঢাকা দক্ষিণে একটি মেয়র পদে সাতজন, সাধারণ কাউন্সিলরের ৭৫টি পদে ৩২৬ জন এবং সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলরের ২৫টি পদে ৮২ জন প্রার্থী।
# ভোট কোথায়: ঢাকা উত্তরে ১ হাজার ৩১৮টি কেন্দ্রের ৭ হাজার ৮৪৬টি ভোট কক্ষে এবং দক্ষিণে ১ হাজার ১৫০টি কেন্দ্রের ৬ হাজার ৫৮৮টি ভোটকক্ষে ভোটগ্রহণ হবে
# নিরাপত্তা: ভোটের নিরাপত্তায় আগের দিন থেকেই মাঠে নেমেছেন আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর প্রায় ৫০ হাজার সদস্য।
বরাবরের মতই এ নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল- ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং ১৩ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির প্রার্থীদের মধ্যে।
ঢাকা উত্তরে গত নয় মাস মেয়র পদে দায়িত্ব পালন করে আসা আতিকুল ইসলাম আবারও আওয়ামী লীগের নৌকার টিকেটে লড়ছেন। দক্ষিণে সিটিতে ক্ষমতাসীন দল বর্তমান মেয়র সাঈদ খোকনকে বদলে প্রার্থী করেছে ঢাকা-১০ আসনের সংসদ সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করে আসা শেখ ফজলে নূর তাপসকে, যিনি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শেখ ফজলুল হক মণির ছেলে।
অন্যদিকে উত্তরে বিএনপির প্রার্থী তাবিথ আউয়াল ২০১৫ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আওয়ামী লীগের আনিসুল হকের কাছে হেরেছিলেন। এবারও বিএনপি নেতা ব্যবসায়ী আবদুল আউয়াল মিন্টুর ছেলেকে ধানের শীষ প্রতীক দিয়েছে বিএনপি। দক্ষিণ সিটিতে ধানের শীষ প্রতীকে বিএনপির প্রার্থী ইশরাক হোসেন রাজনীতিতে নবীন; তিনি অবিভক্ত ঢাকা সিটির সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার বড় ছেলে।
মেয়র পদে তাপস-ইশরাকের সঙ্গে দক্ষিণ সিটিতে আরও পাঁচজন এবং আতিক-তাবিথের সঙ্গে উত্তর সিটিতে আরও চারজন প্রার্থী রয়েছেন।
মেয়র পদে যারা
ঢাকা উত্তর সিটি |
|
|
| ঢাকা দক্ষিণ সিটি |
|
|
প্রার্থী | দল | প্রতীক |
| প্রার্থী | দল | প্রতীক |
আতিকুল ইসলাম | আওয়ামী লীগ | নৌকা |
| শেখ ফজলে নূর তাপস | আওয়ামী লীগ | নৌকা |
তাবিথ আউয়াল | বিএনপি | ধানের শীষ |
| ইশরাক হোসেন | বিএনপি | ধানের শীষ |
আহম্মেদ সাজেদুল হক রুবেল | সিপিবি | কাস্তে |
| সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন | জাতীয় পার্টি | লাঙ্গল |
শেখ ফজলে বারী মাসউদ | ইসলামী আন্দোলন | হাতপাখা |
| আব্দুর রহমান | ইসলামী আন্দোলন | হাতপাখা |
আনিসুর রহমান দেওয়ান | এনপিপি | আম |
| বাহারানে সুলতান বাহার | এনপিপি | আম |
শাহীন খান | পিডিপি | বাঘ |
| আব্দুস সামাদ সুজন | গণফ্রন্ট | মাছ |
|
|
|
| আকতারুজ্জামান ওরফে আয়াতুল্লাহ | বাংলাদেশ কংগ্রেস | ডাব |
সর্বশেষ ঢাকার দুই ভাগে ভোট হয়েছিল ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল। ২০১১ সালের ৩০ নভেম্বর ঢাকাকে উত্তর ও দক্ষিণে ভাগের পর এটাই দ্বিতীয় নির্বাচন। এর আগে একক সিটি করপোরেশন হিসেবে ঢাকা মহানগরে নির্বাচন হয়েছিল ২০০২ সালে।
চার পরীক্ষা
দুই যুগের বেশি সময় ধরে ভোট পর্যবেক্ষণ করা জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদ-জানিনপের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এ ভোটকে মোটা দাগে চারটি বিষয়ের পরীক্ষা হিসেবে দেখছেন তিনি।
তার মতে, প্রথমবারের মত এত বড় পরিসরে ইভিএমে ভোট, একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অভাবনীয় জয়ের এক বছর পর স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে রাজধানীর অর্ধকোটি ভোটারের ভোট, নির্বাচনের দিনে ভোটের পরিবেশ নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা এবং শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সরকারের মুন্সিয়ানা- এ চারটি বিষয়েরও পরীক্ষা হয়ে যাবে এ নির্বাচনে।
“ইভিএম যান্ত্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। বর্তমান ইভিএমে একাধিক সিটি করপোরেশনে ভোট হয়েছে; মানুষের কাছে পরিচিতি পেয়েছে। এখন ঢাকায় ভোটার উপস্থিতি কতটা হবে সেটা একটা দেখার বিষয়। এটা প্রার্থীদের উপরও নির্ভর করে। তারা জেতার মানসিকতা নিয়ে ভোটার টানবে।”
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে একাদশ সংসদ নির্বাচনের অভিজ্ঞতার পর এবারের ঢাকা সিটির ভোট ‘অংশগ্রহণমূলক’ হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এখানেও নৌকা ও ধানের শীষের প্রতিদ্বন্দ্বিতার একটি পরীক্ষা হবে।
“পুরোদেশের চিত্র মেলে জাতীয় নির্বাচনে। এখন রাজধানীর চিত্রকে জাতীয় ভোটের জনপ্রিয়তার মাপকাটি ধরা ঠিক হবে না। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের এক বছর পর স্থানীয় ভোটের ফলাফল থেকে দলগুলোর প্রতি ভোটারের বার্তা মূল্যায়ন করতে হবে।”
ভোটের দিনের পরিবেশ ভালো রাখার বিষয়ে কমিশন আশ্বস্ত করছে। কিন্তু প্রচারের মাঠের শান্তির স্বস্তি ভোটের দিনও রাখা যাবে কি না- সে পরীক্ষা নির্বাচন কমিশনকেই দিতে হবে বলে মনে করেন কলিমুল্লাহ ।
তিনি বলেন, “সবার নজর এখন ঢাকার দিকে। কমিশন একাই সব নয়। ভোটার টার্ন আউটও কমিশনের বিষয় নয়। পরিবেশ ভালো রাখতে ইসির ঘোষণার বাস্তবায়নও থাকতে হবে।”
তাছাড়া আইন-শৃঙ্খলা শান্তিপূর্ণ রাখার ক্ষেত্রে কমিশনকে সরকারের তরফ থেকে সার্বিক সহায়তা করার বিষয় থাকে।
“এখন শাসক দল কীভাবে তা করছে দেখার বিষয়। বিষয়টি ক্ষমতাসীন দলের মুন্সিয়ানার বিষয়।”
এবার ভোটের প্রচার হয়েছে জমজমাট, সংঘাত-সহিংতা আর অভিযোগ ছিল তুলনামূলকভাবে কম। তারপরও ইভিএম এবং সুষ্ঠু ভোট নিয়ে শঙ্কার কথা বলে আসছে বিএনপি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সেসব নাকচ করে ‘নিশ্চিত জয়ের’ আভাস পাওয়ার কথা বলছে। ভোটের দিন মাঠে সতর্ক থাকার পাল্টাপাল্টি ঘোষণাও এসেছে।
জানিপপ চেয়ারম্যানের ভাষায়, রাজনৈতিক দলের এই পারস্পরিক দোষারোপ আসলে ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতির’ বিষয়।
“ভোটের রাজনীতিতে এটা দেখা যায়। কিন্তু সার্বিকভাবে এবার ভোটের আগের দিন পর্যন্ত পরিবেশ ছিল ভালো। বেশ সন্তোষজনক।”
শুরু থেকেই ইভিএম নিয়ে চ্যালেঞ্জে ছিল নির্বাচন কমিশন। প্রথম মেয়াদে সফলতা পেয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে থমকে যায়। এবার নতুন যাত্রা। তর্ক-বিতর্কের চেয়ে নতুন প্রযুক্তিকে সঙ্গী করে ভোটারদের সাড়া পাওয়াটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ কমিশনের কাছে।
যে কমিশনের অধীনে ২০১০ সালে ইভিএমের প্রচলন শুরু হয়, সেই কমিশনের সদস্য মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন বলেন, “ইভিএম অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। তবে এটার জন্য বেশ ভোটারদের কাছে পরিচিতির ব্যাপক প্রচারণা থাকা দরকার। অভ্যস্ত হয়ে গেলে সহজেই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে।”
আর ২০১২ থেকে ২০১৭ সালে যে কমিশনের সময় ইভিএম গতি হারিয়েছিল, সেই কমিশনের সদস্য মো. আবু হাফিজ বলেন, “সবাইকে আধুনিক প্রযুক্তির দিকেই যেতে হবে। এখন ইভিএমে হয়তা সাড়া কম; একটা সময় আসবে তা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে।”
শুরু থেকেই ইভিএমের বিরোধিতা করে আসা বিএনপি বলে আসছে, কারচুপির সুযোগ তৈরি করতেই ‘সরকারের ইচ্ছায়’ নির্বাচন কমিশন এ যন্ত্র ভোটারদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে।
অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলছে, সুষ্ঠু ভোট নিশ্চিত করতেই তারা ইভিএম চায়, কারণ তাদের ভাষায় ‘জবর দখল ও জাল ভোটের সুযোগ ইভিএমএ নেই’।
তিনি বলেন, “প্রযুক্তির দুর্ঘটনা থাকতে পারে। চাঁদের অভিযানও শেষ মুহুর্তে দুর্ঘটনায় পড়ে। ইভিএম সঠিকভাবেই কাজ করছে। এ নিয়ে কোনো জটিলতা দেখছি না আমরা। তবে কোনো কোনো কেন্দ্রে যদি জটিলতা বা ত্রুটি দেখা দেয়-তা সারাতে বিকল্প প্রস্তুতিও কেন্দ্রে থাকবে।”
তবে এ কমিশনেরই আরেক সদস্য মাহবুব তালুকদার বিভিন্ন সময়ে ইভিএম নিয়ে আপত্তি তুলেছেন। গত ২২ জানুয়ারি ইসির আইন-শৃঙ্খলা সভায় ইভিএমের এ ভোটে উপস্থিতির বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, “বর্তমান সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার কমিশনের জন্য এক অগ্নিপরীক্ষা। নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি বৃদ্ধিও একান্ত অপরিহার্য। এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা একান্তভাবে কাম্য।”
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা ভোটের আগের দিন ঢাকার দুই সিটির ভোটারদের আশ্বস্ত করে বলেছেন, ভোট নিরাপদেই হবে।
“প্রস্তুতি শেষ। ...আপনাদের মাধ্যমে ভোটারদের আহ্বান জানাই, যেন প্রত্যেকেই ভোটকেন্দ্র যান। ইভিএমে ভোট দিতে যে কোনো ধরনের সাহায্য সহযোগিতা করবে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা। ইভিএমে ভোট দিয়ে নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগ করুন, এই আহ্বান আমি ভোটারদের প্রতি জানাই।”
ভোটের পরিবেশ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “মেয়র ও কাউন্সিলর পদের প্রার্থীরা তাদের ‘ইচ্ছা ও সুবিধামত, নির্বিঘ্নে, বিনা বাধায়’ প্রচার চালাতে পেরেছেন। ভোটারদের মধ্যে একটা উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে এবং তাদের আস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে আমি মনে করি।”
শনিবারের নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলকভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে, অবাধ হবে, সুষ্ঠু হবে, নিরপেক্ষ হবে- এটাই কে এম নূরুল হুদার প্রত্যাশা।
আওয়ামী লীগে সন্তোষ, শঙ্কা বিএনপিতে
ভোট শান্তিপূর্ণ করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাই নেবে মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেছেন, “নির্বাচন ভয়ভীতিমুক্ত পরিবেশে হোক। বিএনপির যারা তাদের সন্ত্রাসী দিয়ে নাশকতামুলক কর্মকাণ্ড করে এই নির্বাচনকে বিতর্কিত করতে চায়, এই ধরনের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর পদক্ষেপ নেবে।"
সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখন পর্যন্ত ‘অত্যন্ত সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর’ পরিবেশ বজায় রয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমরা আশা করছি কাল ভোটাররা নির্ভয়ে নির্বিঘ্নে উৎসবমুখর পরিবেশে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে। ভোটার সর্বাচ্চ পরিমাণে ভোট প্রয়োগ করবে বলেই আমাদের প্রত্যাশা।”
২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন বয়কট করার মধ্য দিয়ে বিএনপি ‘নির্বাচন বিরোধী রাজনীতির’ সূচনা করেছিল মন্তব্য করে এই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, “বিভিন্ন সময়ে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সাধারণ ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছিল। যার ফলে দেখা গেছে যে, টার্ন আউটটা প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়নি। তবে এবারের পরিবেশ ভিন্ন।”
অন্যদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভোটের আগের দিন বলেন, “সরকার চেষ্টা করছে পুরো নির্বাচনটাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেওয়ার। সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক মন্ত্রী মহোদয় বলেছেন, প্রত্যেকটি কেন্দ্র তারা পাহারা দেবেন এবং তারা নিয়ন্ত্রণ করবেন।
“তারপরেও আমরা যেটা বিশ্বাস করি, বিশ্বাস করে এসেছি যে, ঢাকা শহরের মানুষ যদি ভোট দেওয়ার ন্যূনতম সুযোগ পান তাহলে তারা অবশ্যই ধানের শীষকে জয়যুক্ত করবেন।”
ঢাকা উত্তরের রিটার্নিং কর্মকর্তা আবুল কাসেম জানিয়েছেন, তার এলাকার এক হাজার ৩১৮টি কেন্দ্রের মধ্যে ৮৭৬টি কেন্দ্র গুরুত্বপূর্ণ, যা গণমাধ্যমের ভাষায় ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত।
আর দক্ষিণের রিটার্নিং অফিসার আবদুল বাতেন বলেছেন, তার এলাকার এক হাজার ১৫০টি কেন্দ্রের মধ্যে ৭২১টি কেন্দ্র ‘গুরুত্বপূর্ণ’। এসব কেন্দ্রের নিরাপত্তায় থাকবে বাড়তি মনোযোগ।
সাধারণ কেন্দ্রগুলোতে ১৬ জন করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হলেও গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে থাকবে ১৮ জন করে।
“ভোটারদের জন্য ঢাকা শহরকে আমরা একটা নিরাপত্তার চাদরের ব্যবস্থা করেছি। আমার মনে হয়, আগামীকাল আমাদের ভোটাররা উৎসাহমুখর পরিবেশে ভোট দেবেন, কোনো রকম অসুবিধা হবে না। আমি আপনাদের মাধ্যমে বলতে চাই, সবাই যেন ভোট দিতে আসেন।”
প্রচার নেই, তবু ব্যস্ততা
শুক্রবার প্রচার-প্রচারণা বন্ধ থাকলেও ভোটের আগের দিন পোলিং এজেন্ট চূড়ান্ত আর ভোটের দিনের কর্মকৌশল ঠিক করতে ব্যস্ত সময় পার করেছেন প্রার্থীরা।
শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বনানীতে আওয়ামী লীগ ঢাকা উত্তরের নির্বাচন সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালনকারী তোফায়েল আহমেদের বাসায় যান আতিকুল ইসলাম। বনানী জামে মসজিদে জুমার নামাজ পড়ে বনানী কবরস্থানে পূর্বসুরী আনিসুল হকের কবর জিয়ারত করেন নৌকার প্রার্থী।
বনানী থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে দেখে আসেন আতিক। সন্ধ্যায় গণভবনের গিয়ে দেখা করে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে।
জুমার নামাজের পর আতিক সাংবাদিকদের বলেন, “প্রচারে পুরো সময়টাই দলের নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা রাস্তায় ছিল। আমরা সবাই ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়েছি। গণসংযোগে মানুষের জোয়ার দেখে আমরা বুঝতে পেরেছি নৌকা প্রতীকের অবস্থান খুবই ভালো। জনগণ বুঝে গেছে কাকে ভোট দিলে নগরের উন্নয়ন হবে।”
আতিকের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির মেয়রপ্রার্থী তাবিথ আউয়াল সকালে বাংলা মোটরের হক টাওয়ারে নির্বাচনী কার্যালয়ে গিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করেন। প্রতিটি ওয়ার্ডের খোঁজ খবর নেন, ভোট কেন্দ্রগুলোতে দলের দায়িত্বরতদের প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় তাবিথ বলেন, “আমি আমার ৫৪টি কাউন্সিলরের সাথে ইতোমধ্যে কথা বলে ফেলেছি। আমাদের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। এখন ইলেকশন কমিশনের উপর সমস্ত দায়িত্ব, ভোটাররা যেন শান্তিপূর্ণভাবে ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারে, ভোট গণণা যেন ভোটের রায় অনুযায়ী হয়।… আগামীকাল যদি ভোটাররা ভোট দিতে পারেন, অবশ্যই ধানের শীষ মার্কাকে জয়যুক্ত করবেন।“
দক্ষিণ সিটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস গেণ্ডারিয়ার ফরিদাবাদ জামে মসজিদে জুমার নামাজ পড়ে বনানী কবরস্থানে যান বাবা-মা এবং ১৫ অগাস্ট নিহতদের কবর জিয়ারত করতে।
সন্ধ্যায় হাসপাতালে গিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে দেখে এসে গ্রীন রোডে নিজের রাজনৈতিক কার্যালয়ে ভোটের দিনের কর্মকৌশল ঠিক করেন নৌকার প্রার্থী।
তাপসের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দক্ষিণ সিটিতে বিএনপির প্রার্থী ইশরাক হোসেন গোপীবাগের বাসায় ব্যস্ত সময় কাটান নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আলোচনা, পোলিং এজেন্টসহ বিভিন্ন কেন্দ্রের বিষয়ে দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে।
এরমধ্যে দুপুরে যুক্তরাষ্ট্রের পলিটিক্যাল কাউন্সিলরের সঙ্গে বৈঠকের জন্য তিনি গুলশানে যান। সেখান থেকে গোপীবাগের মসজিদে এসে জুমার নামাজ পড়ে ছোট ভাই ইশফাক হোসেনকে নিয়ে যান জুরাইন পুরনো কবরস্থানে, বাবা সাদেক হোসেন খোকা এবং দাদা-দাদীর কবর জিয়ারত করতে।
দুপুরের পর তার গোপীবাগের বাসায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গেলে তার কাছে নির্বাচন প্রস্তুতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন ইশরাক। পরে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সঙ্গে তার বৈঠক হয়।
বিতর্কে পযবেক্ষক
ভোটের আগে দুই দিন বিদেশি কূটনৈতিক মিশনের আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দলে বাংলাদেশি কর্মীদের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে উত্তাপ ছড়িয়েছে। দেশি কর্মীদের বাদ দিতে বৃহস্পতিবার দূতাবাসগুলোকে চিঠিও দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
ওই চিঠিতে বলা হয়, ২০১৮ সালের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ নীতিমালা অনুযায়ী, দূতাবাসের কোনো বাংলাদেশি কর্মী আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক হিসাবে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে পারবে না।
“ফলশ্রুতিতে ঢাকায় কূটনৈতিক মিশনগুলো আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বাংলাদেশি নাগরিকদের তাদের পর্যবেক্ষক দলে অন্তর্ভুক্ত না করার বিষয়টি খুবই প্রশংসনীয় হবে।”
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ভোট পর্যবেক্ষণে ১০টি পশ্চিমা দেশের দূতাবাস থেকে নিয়োগ করা ৭৪ জনকে অনুমতি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এদের মধ্যে ২৮ জন বাংলাদেশি, যারা বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি করেন।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণ নীতিমালা অনুযায়ী আন্তর্জাতিক সংস্থা/কূটনৈতিক মিশনের বিদেশি কর্মকর্তা/কর্মচারীকে বিদেশি পর্যবেক্ষক ও স্থানীয়দের স্থানীয় পর্যবেক্ষক হিসেবে গণ্য করা হবে। সেজন্য দেশি ও বিদেশিদের জন্য আলাদা নীতিমালা অনুযায়ী আবেদন করতে হবে।
কিন্তু ঢাকা সিটির ভোটের ক্ষেত্রে এবার দেশি কর্মীদের বিদেশি পর্যবেক্ষক হিসেবে আবেদন করে দূতাবাসগুলো। নির্বাচন কমিশন সেভাবেই তাদের জন্য পরিচয়পত্র ইস্যু করে। বিষয়টি ঠিক হয়নি বলে মন্তব্য করেন সাবেক একজন নির্বাচন কমিশনার। আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, এই ভুলের দায়ভার দূতাবাসগুলোর।
“আনফরচুনেটলি বিভিন্ন মিশন তাদের কর্মচারী যারা বাংলাদেশের নাগরিক তাদেরকেও আন্তর্জাতিক ‘অবজার্ভার’ নিয়োগ করেছে- এটা সম্পূর্ণ ‘ভায়োলেশন অব দ্য ল’। এজন্য আমরা বলেছি, মিশনগুলো ‘শুড ফলো দেওয়ার কোড অব কন্ডাক্ট’।
বিদেশি দূতাবাসে বা মিশনে বাংলাদেশি কর্মীরা বিদেশি পর্যবেক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে কি-না, এমন প্রশ্নে শুক্রবার সিইসি কে এম নূরুল হুদা সাংবাদিকদের বলেন, “তারা পারবে না।”
যাদেরকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, তাদের বিষয়ে পদক্ষেপের বিষয়ে ইসি সচিব মো. আলমগীর বলেন, “আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করে, তিনি যদি বাংলাদেশি হন, তাহলে তিনি স্থানীয় পর্যবেক্ষক হিসেবে গণ্য হবেন। তাদেরকে সেই চিঠিও দেয়া হয়েছে।”