দেশিদের বিদেশি পর্যবেক্ষক কার্ড দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন

বিদেশি দূতাবাসে চাকরি করলেও তারা বাংলাদেশি, অথচ আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচন পর্যবেক্ষণে তাদের বিদেশি পর্যবেক্ষক হিসেবে কার্ড দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Jan 2020, 06:38 PM
Updated : 30 Jan 2020, 06:38 PM

নিয়ম ভেঙে ইসির এ পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন ওঠার প্রেক্ষাপটে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন বলেছেন, এটা ঠিক হয়নি।

অভিযোগের মুখে সিইসি কে এম নূরুল হুদা বলেছেন, বিদেশি সংস্থার যেসব বাংলাদেশি নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবেন, তাদের কাজে নজর রাখবেন তারা।

আগামী ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি নির্বাচন নিয়ে ঢাকায় কর্মরত পশ্চিমা কূটনীতিকরা বেশ তৎপর। ইসি থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রার্থীর সঙ্গেও দেখা করে তারা বলছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশা থেকে তাদের এই পদক্ষেপ।

এই নির্বাচন পর্যবেক্ষণে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলোর দূতাবাসগুলো ইসির কাছে থেকে পর্যবেক্ষক কার্ডও নিয়েছে।

ইসির কাছ থেকে পাওয়া তালিকা বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১০টি দেশের মিশনের মোট ৭৪ জন পর্যবেক্ষক কার্ড পেয়েছেন, তবে এর মধ্যে ২৮ জন রয়েছেন বাংলাদেশি, যারা বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি করেন।

বাকি ৪৬ জন বিদেশি পর্যবেক্ষক হিসেবে কার্ড পেলেও বাংলাদেশি ২৮ জনের বিদেশি পর্যবেক্ষক হিসেবে কার্ড দেওয়াটা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ নীতিমালার স্পষ্ট লঙ্ঘন।

নির্বাচন পর্যবেক্ষণ নীতিমালায় (ধারা ১২: বাংলাদেশে কর্মরত আন্তর্জাতিক সংস্থার নির্বাচন পর্যবেক্ষণ) বলা হয়েছে- নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য বাংলাদেশে কর্মরত আন্তর্জাতিক সংস্থা/কূটনৈতিক মিশনের নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত হওয়ার বিধান নেই।

আন্তর্জাতিক সংস্থা/কূটনৈতিক মিশনের বিদেশি কর্মকর্তা/কর্মচারী বিদেশি পর্যবেক্ষক এবং স্থানীয় কর্মকর্তারা স্থানীয় পর্যবেক্ষক হিসেবে গণ্য হবে। বিদেশিদের বিদেশি পর্যবেক্ষক নীতিমালা অনুযায়ী এবং স্থানীয়দের স্থানীয় পর্যবেক্ষক নীতিমালা অনুযায়ী আবেদন করতে হবে।

স্থানীয় ১১টি পর্যবেক্ষণ সংস্থার ১ হাজার ১৩ জন বাংলাদেশি দেশি পর্যবেক্ষক হিসেবে ইসির তালিকাভুক্ত হলেও চাকরির সুবাদে দূতাবাসের ওই ২৮ বাংলাদেশি বিদেশি পর্যবেক্ষকের কার্ড করিয়ে নিয়েছেন।

ভোটের দিন বিদেশি পর্যবেক্ষকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি পাঠিয়েছে ইসি; ফলে বাংলাদেশি হয়েও ২৮ জন পাচ্ছেন বিশেষ সুবিধা, অথচ হাজারের বেশি দেশি পর্যবেক্ষকের জন্য সেই বন্দোবস্তু নেই।

দূতাবাসের নাম

বিদেশি নাগরিক

বাংলাদেশি নাগরিক

মোট

যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস

১৮

২৭

ব্রিটিশ হাইকমিশন

১২

ইউরোপীয় ইউনিয়ন

নেদারল্যান্ড দূতাবাস

সুইজারল্যান্ড দূতাবাস

জাপান দূতাবাস

ডেনমার্ক দূতাবাস

নরওয়ে দূতাবাস

অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশন

কানাডিয়ান হাইকমিশন

 

৪৬

২৮

৭৪

দেশিদের বিদেশি পর্যবেক্ষক কার্ড দেওয়ার বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিদেশি পর্যবেক্ষণ সংস্থার পক্ষ থেকে বিদেশি পর্যবেক্ষক থাকাটাই শ্রেয়। দূতাবাসে কর্মরত বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের বিদেশি পর্যবেক্ষক করা ঠিক হয়নি।

“এসব কর্মকর্তাদের বিদেশি পর্যবেক্ষক পরিচয়কার্ড করা ঠিক না।”

বিদেশি দূতাবাসের কর্মীদের ভোট পর্যবেক্ষণের সামর্থ্য নিয়েও প্রশ্ন তোলেন সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার। 

“ভোট দেখতে পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলোর লোকজন নানা পরিকল্পনা নিয়ে আসেন, তাদের ট্রেনিংও রয়েছে। কিন্তু দূতাবাসের লোকজন যারা দেশীয়, তারা ভোট দেখতে যাবেন কেন? তাদের পর্যবেক্ষণে ঘাটতি থাকতে পারে।”

এ বিষয়ে সিইসি নূরুল হুদা সাংবাদিকদের বলেছেন, “বিদেশি পর্যবেক্ষকদের জন্য বিধিতে আছে তারা যেতে পারবে, তাদের নিবন্ধন প্রয়োজন হবে না। স্থানীয় পর্যবেক্ষকরা তো বাইরে থেকে আসেনি, তারা এখানকার। বিভিন্ন দূতাবাসে যারা আছেন, তারা এখানকার। তারা তালিকা দিলে আমরা পরীক্ষা করে তাদের অনুমতি দিতে পারি।

“সে অনুমতি আছে, গাজীপুরসহ বিভিন্ন সিটি নির্বাচনেও তারা পর্যবেক্ষণ করেছে। তাদের উপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই থাকবে। তারা যেন বিধির বাইরে কোনো রকম আচরণ করতে না পারে, সে ব্যাপারে আমাদের সতর্কতা থাকবে।”

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নীতি অনুযায়ী শুধু আন্তঃরাষ্ট্রীয় কোনো সংগঠন ও আন্তর্জাতিক কোনো বেসরকারি সংস্থা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে পারে। অথচ বাংলাদেশে দূতাবাস বা বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা ভোট পর্যবেক্ষণ করছেন, যার নজির বিশ্বে বিরল।

 

‘নাক গলাচ্ছে’ বিদেশিরা

ঢাকার সিটি নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমা কূটনীতিকদের তৎপরতাকে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ‘নাক গলানো’ বলে মনে করছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।

এনিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি কড়া ভাষায় বলেছেন, “বেশ কিছু বিদেশি কূটনীতিক ব্রিটিশ হাইকমিশনে মিলিত হয়েছিলেন। তারা নিজেদের কাজ বাদ দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে নাক গলাচ্ছেন, যা একবারেই উচিৎ নয়।

“কূটনীতিকরা এসব বিষয়ে কোড অব কন্ডাক্ট মেনে কাজ না করলে তাদের দেশ থেকে চলে যেতে অনুরোধ জানানো হবে।”

কূটনীতিক ও বিদেশি পর্যবেক্ষকদের তৎপরতা নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল বৃহস্পতিবার ইসিতে গিয়ে অভিযোগও জানিয়ে আসে।

গত সংসদ নির্বাচনে একটি দেশের রাষ্ট্রদূত ক্যামেরা নিয়ে বুথের মধ্যে ঢুকে পড়েছিলেন জানিয়ে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, সে দিকে সতর্ক থাকতে ইসিকে অনুরোধ করেছে আওয়ামী লীগ।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রচারের শেষ দিন বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান এইচটি ইমাম। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

ইসির সঙ্গে বৈঠকের পর আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো চেয়ারম্যান এইচ টি ইমাম বলেন, “মান্যবর রাষ্ট্রদূতদের যথেষ্ট সম্মান করি। বাংলাদেশের মতো এত আদর-যত্ন কেউ করে না। সেটা তো অব্যাহত থাকবে। কিন্তু আতিথেয়তা মানে এই নয় যে কেউ সেটির সুযোগ নিয়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করবে।”

এই ‘বিদেশি পর্যবেক্ষকরা’ যেন বিধি-বিধান মেনে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেন সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের জোরাল পদক্ষেপ চেয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিরা।

এইচটি ইমাম বলেন, “তারা যেন পর্যবেক্ষণের আন্তর্জাতিক বিধি-বিধান মেনে চলেন। কোনো বিশেষ দেশের কেউ যেন বেশি মাতব্বরি না করেন। এটি আপনাদেরকেও বলে রাখলাম।”

তবে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের নিয়ে আওয়ামী লীগের অভিযোগের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি বলেছে, ভোট কারচুপির উদ্দেশ্য আছে বলে বিদেশিদের পর্যবেক্ষণ নিয়ে প্রশ্ন তুলছে ক্ষমতাসীনরা।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বৃহস্পতিবার ইসির সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের বলেন, “উনাদের কনসার্নটা আমরা বুঝি। উনারা যেসব পর্যবেক্ষকের তালিকা করেছেন সেটা তাদের দলীয় পর্যবেক্ষক। সারাদিন বসে থাকার পর বিকালে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলা ছাড়া তাদের কোনো কাজ নেই।

“নিজেদের মতো করে একটা নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন করে তাদের ফলাফল তারা পেতে চাচ্ছে। অবজার্ভারসহ সেইভাবে করা হয়েছে। এর মধ্যে যদি বিদেশি মুক্ত চিন্তার মানুষ পর্যবেক্ষণে চলে আসে, সেটা অবশ্যই তাদের চিন্তার বিষয়।”

এদিকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের মধ্যে পশ্চিমা নয়টি দেশের দূতাবাসের এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “আমরা আশা করছি যে বাংলাদেশের সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং সকল সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দল শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে জনগণের ভোট দেওয়ার অধিকারকে সম্মান জানাবেন এবং স্বচ্ছতা ও সততার সাথে ভোট গণনা করবেন।”