রাজউকে দুই কোটি টাকা পর্যন্ত ঘুষের অভিযোগ, মন্ত্রীর অস্বীকার

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-রাজউকে ভবনের ছাড়পত্র ও নকশা অনুমোদনে দুর্নীতির অভিযোগ করে টিআইবির এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই অবৈধ অর্থ লেনদেন দুই কোটি টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Jan 2020, 01:00 PM
Updated : 29 Jan 2020, 01:23 PM

তাদের এই অভিযোগ অস্বীকার করে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেছেন, রাজউক নিয়ে টিআইবির এই প্রতিবেদন ‘ভিত্তিহীন, অসত্য ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’। একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে হয়ত কারো দেওয়া ‘ভুল তথ্যের’ ভিত্তিতে হেয় প্রতিপন্ন করে তারা একটা বাহবা নেওয়ার চেষ্টা করছে।

বুধবার ‘রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক): সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

এতে বলা হয়, রাজউকের ছাড়পত্র ও নকশা অনুমোদনে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি রয়েছে। যেমন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজউক কর্মকর্তা, দালাল ও সেবাগ্রহীতার মধ্যে ত্রিপক্ষীয় আঁতাতের মাধ্যমে চুক্তি করে সুনির্দিষ্ট হারে ‘নিয়ম বহির্ভূত’ অর্থ নেওয়া হয়।

২০১৮ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই গবেষণাটি পরিচালিত হয় জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, এই সময়ও ‘চুক্তিভিত্তিক নিয়ম বহির্ভূত অর্থ আদায়ের’ অভিযোগ রয়েছে।

“ব্যক্তি ও রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার পর্যায়ে এর পরিমাণ দুই হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত। ছাড়পত্র অনুমোদনে ব্যক্তি পর্যায়ে ১৫ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত এবং রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার পর্যায়ে এক লক্ষ থেকে দশ লক্ষ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়।”

সেবাগ্রহীতারা ইমারত নকশা অনুমোদনের সেবা গ্রহণেও নির্ধারিত ফির ’অতিরিক্ত অর্থ দিতে বাধ্য হন’ উল্লেখ করে সেখানে বলা হয়, “ব্যক্তি পর্যায়ে দশ তলা পর্যন্ত ইমারতের নকশা অনুমোদনে ফির অতিরিক্ত ৫০ হাজার থেকে চার লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত এবং রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার পর্যায়ে দুই লাখ থেকে দশ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়।

”আবার দশ তলার ঊর্ধ্বের ইমারতের নকশা অনুমোদনে রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার পর্যায়ে ফি-এর অতিরিক্ত ১৫ লাখ থেকে ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়।”

অন্যদিকে বৃহদায়তন বা বিশেষ প্রকল্পের ক্ষেত্রে রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার পর্যায়ে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের পরিমাণ ১৫ লাখ থেকে দুই কোটি টাকা পর্যন্ত বলে দাবি করা হয় প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে জানানো হয়, গবেষণায় রাজউকের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা, ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র, নকশা অনুমোদন ও নিয়ন্ত্রণ, উন্নয়নমূলক কার্যক্রম বা প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন পর্যায়, পরিকল্পনা প্রণয়ন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে আইন ও নীতি পর্যালোচনা করা হয়।

প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “এখন এমন একটা ধারণা করা হয় যে, রাজউক আর দুর্নীতি সমার্থক। রাজউক এতদিনেও জনবান্ধব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারেনি।”

নিয়ন্ত্রণমূলক কাজের বাইরে এসে রাজউক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

ইফতেখার বলেন, “রাজউক যেহেতু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান হিসাবে দাঁড়িয়ে গেছে, এই সংস্কৃতি থেকে রাজউককে সরিয়ে আনা কঠিন হবে বলে আমি মনে করি।

“সে যদি ব্যবসা করতে চায়, মুনাফা অর্জন করতে চায় সরকারি সম্পদ ব্যবহার করে তাহলে সরকারি নীতিমালার মাধ্যমে তা করবে। এবং নিয়ন্ত্রণের কাজটি অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে অর্পণ করা উচিত বলে আমি মনে করি।”

এমনকি রাজউক নারী ও প্রতিবন্ধীবান্ধব প্রতিষ্ঠান নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, “রাজউকের ওপর নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার যে দায়িত্ব অর্পিত, তারা তা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। তারা ড্যাপ ও ডিএমডিপি রক্ষায়ও ব্যর্থ হয়েছে। অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মাধ্যমে রাজউক এখন তার মূল ভূমিকা থেকেই সরে গেছে।”

রাজউকের দুর্নীতির বিষয়গুলো গুরুত্ব সহকারে নেওয়ার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) পরামর্শ দেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক।

সংবাদ সম্মেলনে গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ফারহানা রহমান এবং ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ফাতেমা আফরোজ।

এ সময় অন্যদের মধ্যে টিআইবির উপদেষ্টা অধ্যাপক সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান ও সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার আবু সাঈদ মো. জুয়েল মিয়া উপস্থিত ছিলেন।

টিআইবির প্রতিবেদন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত: গৃহায়নমন্ত্রী

রাজউক নিয়ে টিআইবির প্রতিবেদন প্রকাশের দুপুরে সচিবালয়ে এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানান গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম।

তিনি বলেন,“সংবাদপত্রে টিআইবির প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে যে সংবাদ এসেছে সেখান থেকে আমি অবহিত হয়েছি, রাজউকে সেবা নিতে ২ কোটি টাকা পর্যন্ত ঘুষ লাগে। এই বক্তব্যটি কোনোভাবে সত্য নয়, এর কোনো ভিত্তি নেই। এটা সম্পূর্ণরূপে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, জনবান্ধব একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে হয়ত কারো দেওয়া ভুল তথ্যের ভিত্তিতে হেয় প্রতিপন্ন করে আলাদা একটা বাহবা নেয়ার চেষ্টা করেছে তারা।”

এই অভিযোগের কী ভিত্তি, সেই ভিত্তি কোথাও তারা সুস্পষ্টভাবে বলেননি জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, “একটি অভিযোগে তারা বলেছেন, বিশেষ প্রকল্পের ক্ষেত্রে রিয়েল স্টেট ডেভেলপারকে ১৫ লাখ থেকে ২ কোটি টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। আমি মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার পর এ জাতীয় কোনো প্রকল্পের অনুমোদনই হয়নি।

“আমি এক বছরের বেশি সময় আগে মন্ত্রী হয়েছি। বিশেষ প্রকল্পে ১৫ লাখ থেকে ২ কোটি টাকা ঘুষ দিতে হয় এই তথ্য তারা কোথায় পেলেন, এই জাতীয় কোনো প্রকল্পই তো পাস করা হয়নি।”

নিয়োগে রাজনৈতিক প্রভাবের অভিযোগ খারিজ করে গণপূর্তমন্ত্রী বলেন, “আমি মন্ত্রী হওয়ার পর আজ পর্যন্ত কোনো নিয়োগই হয়নি। নিয়োগ না হলে রাজনৈতিক প্রভাবের অবকাশ আসল কোথা থেকে? নিয়োগের জন্য আবেদন করা হয়েছে, আমরা এখন পর্যন্ত অ্যাডমিট কার্ডও ইস্যু করিনি। এর ভেতরে তারা বললেন রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করা, এটাতে তারা দুর্নীতির একটি অভিযোগ হিসেবে উত্থাপন করেছেন।”

মন্ত্রী বলেন, “চাবি প্রদানের ক্ষেত্রে টাকা দিতে হয় বলেছেন- একবারই মাত্র উত্তরা থার্ড ফেইজে ফ্ল্যাট বরাদ্দ করা হয়েছে। রাজউকে সংবাদমাধ্যম কর্মীদের উপস্থিতিতে লটারি করে চাবি দেওয়া হয়েছে। কেউ যদি অ্যাবসেন্ট থেকে থাকেন তারা পরবর্তী সময়ে চাবি নিয়েছেন। এক্ষেত্রে টাকা নিয়ে দেওয়ার কথাটি যথার্থ নয়।”

ভূমির ছাড়পত্র, আমমোক্তার নামা গ্রহণ ইত্যাদি সেবার ক্ষেত্রে অবৈধভাবে অর্থ আদায়ের যে অভিযোগ টিআইবি করেছে সে বিষয়ে রেজাউল করিম বলেন, “আমি মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর রাজউকে আইন করে দেওয়া হয়েছে, যে কোনো সেবা নিতে গেলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দিতে হবে।

“অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা অটোমেশন পদ্ধতি চালু করেছি। এখন ঘরে বসেও একটি প্ল্যান স্ক্যান করে ল্যাপটপের মাধ্যমে নির্ধারিত অনলাইন পদ্ধতিতে আবেদন করা যায়। সরকারি যে ফি দিতে হয় তা জমা দিয়ে রিসিট ও নম্বর দিলে সেই সেবাটা তারা গ্রহণ করতে পারেন। ফলে এক্ষেত্রে আলাদা ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ আসার কোনো যৌক্তিকতা নেই।”

রাজউকে দালালের বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, “বেশ কিছু দালালকে গ্রেপ্তার এবং তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা হয়েছে, এরমধ্যে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও রয়েছেন। যারা রাজউকের পরিত্যক্ত কক্ষের মধ্যে আলাদা অফিস করে সেখানে কমিশনারের প্যাড সিল ব্যবহার করে বিভিন্ন রকমের কর্মকাণ্ড করতেন। দৃশ্যমানভাবে বলা যেতে পারে রাজউকে এখন দালালের উপস্থিতি নেই।

“তারপরও যদি সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগদাতার কথা আমাদের বলতেন, আমরা তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারতাম।”

কোনো তথ্য প্রকাশের আগে টিআইবি যেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানায়, তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়- সেই প্রত্যাশা করেন মন্ত্রী রেজাউল করিম।

তিনি বলেন,“আমি আশা করব, টিআইবি এ জাতীয় কোনো অভিযোগ আনার আগে আমাদেরকেও জানাবেন, কী অভিযোগ পেয়েছেন, কাদের কাছ থেকে। টিআইবি কখনও রাজউক ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য কোনো অভিযোগের বিষয়ে জানাননি। যদি জানাতেন তবে নিশ্চয়ই তাদেরকে আমরা সাহায্য করতে পারতাম।”

আনুষ্ঠানিকভাবে টিআইবিকে প্রতিবাদ জানানো হবে কি না প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, “টিআইবি এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নয় যে, তাদেরকে আনুষ্ঠানিকভাবে...তারাই তো আমাকে কোনো অভিযোগ জানায়নি। তারা অনুমানভিত্তিক করেছে, আমরা গণমাধ্যম থেকে জেনেছি। সেজন্য গণমাধ্যমের মাধ্যমেই জানালাম তাদের অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই, অসত্য ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।”

মানহানির মামলা বা অভিযোগ করা হবে কি না জানতে চাইলে রেজাউল করিম বলেন, “আমি বিষয়টি আজকেই জেনেছি কিছুক্ষণ আগে। আমরা বিষয়গুলো আরও গভীরভাবে পর্যালোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করব।”