অঙ্গদান: ভারতের নীতিমালার আলোকে আইন সংশোধনের নির্দেশনা

কিডনিসহ মানব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনে স্বেচ্ছাশুভাকাঙ্ক্ষি (ইমোশনাল ডোনার) দাতার ক্ষেত্রে আইনি জটিলতা নিরসনে ভারতের ‘মানব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন বিধি, ২০১৪’র নীতিমালার আলোকে বাংলাদেশের বিদ্যমান আইন ও বিধি সংশোধন করতে বলেছে হাই কোর্ট।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Jan 2020, 02:32 PM
Updated : 27 Jan 2020, 02:32 PM

অবৈধ কিডনি ব্যবসা রোধ এবং স্বেচ্ছাশুভাকাঙ্ক্ষি (ইমোশনাল ডোনার) দাতার ক্ষেত্রে ভারসাম্য নিশ্চিত করতে উচ্চ আদালতের রায়ে এ নির্দেশনা এসেছে।

এ রায়ের ফলে বর্তমানে নির্ধারিত ‘নিকট আত্মীয়’র সংজ্ঞার বাইরে বিশেষ পরিস্থিতিতে পরিচিত কোনো ব্যক্তি যাচাই–বাছাই সাপেক্ষে ইমোশানাল ডোনার (স্বেচ্ছাশুভাকাঙ্ক্ষি দাতা) হিসেবে কাউকে কিডনি দিতে পারবেন, এমন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশে মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন ১৯৯৯ প্রণয়নের পর ২০১৮ সালে সংশোধন করা হয়।

সংশোধিত আইনটির এ সংক্রান্ত ধারা, বিধি রায়ের অনুলিপি পাওয়ার ছয় মাসের মধ্যে সংশোধনে পদক্ষেপ নিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে; যেখানে বলা হয়েছে, দাতাকে অবশ্যই আইনি নিয়ন্ত্রণে থেকেই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান করতে হবে।

বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি খন্দকার দিলিরুজ্জামানের হাই কোর্ট বেঞ্চ গত ৫ ডিসেম্বর এই রায় দেয়। গত বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশ করা হয়।

একবার কিডনি প্রতিস্থাপনের পর দ্বিতীয় দফায় সন্তানের কিডনি প্রতিস্থাপন নিয়ে আইনি জটিলতায় পড়লে ঢাকার বাসিন্দা ফাতেমা জোহরা ১৯৯৯ সালের আইনের তিনটি ধারার বৈধতা নিয়ে ২০১৭ সালে রিট আবেদন করেন।

ওই আবেদনের প্রাথমিক শুনানির পর আইনটি সংশোধনে ওই বছরেরই ২৪ আগস্ট আদালত রুল জারি করে। পরে ১৯৯৯ সালের আইন ২০১৮ সালে সংশোধন করা হয়।

পরে আবার জটিলতার সৃষ্টি হলে তিনি আদালতে সম্পূরক আবেদন করেন।

ওই আবেদনের শুনানি করেও আদালত রুল জারি করে। মানবদেহে অঙ্গ-প্রতঙ্গ সংযোজন ও প্রতিস্থাপন সংক্রান্ত বিদ্যমান ‘মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন-১৯৯৯’ এর তিনটি ধারা (২গ, ৩ ও ৬) এবং আইনে বিধি প্রনয়ণের বিধান থাকার পরও তা না করায় বিবাদীদের ব্যর্থতা কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না, জানতে চাওয়া হয় রুলে।

এ রুলটি নিষ্পত্তি গত ৫ বছরের ৫ ডিসেম্বর রায় দেয় আদালত।

বিদ্যমান সংশোধিত আইনটির সংশ্লিষ্ট ধারা ও বিধির সংশোধন করার ক্ষেত্রে রায়ে বলা হয়েছে, “এক্ষেত্রে আমরা ভারতের মানব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন বিধি, ২০১৪ এর কথা উল্লেখ করতে পারি।

“ওই নীতিমালা অনুযায়ীই অনুমোদনকারী একটি কমিটি স্বেচ্ছাশুভাকাঙ্ক্ষিদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অনুদানের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আমরা বাংলাদেশে এসব নীতিমালা গ্রহণ করতে পারি।”

ভারতের ৯ দফা নীতিমালা

(ক)  গ্রহীতা ও দাতার মধ্যে কোনো বাণিজ্যিক বা লেনদেনের সম্পর্ক আছে কিনা, তা মূল্যায়ন করে দেখতে হবে। এটাও দেখতে হবে,অনুদানের বিনিময়ে দাতাকে কোনো অর্থ দেওয়া হয়নি অথবা ভবিষ্যতে অর্থ বা অন্য কোনো কিছু  দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়নি।

(খ) দাতা এবং গ্রহীতার মধ্যে সম্পর্কের একটি গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা থাকতে হবে এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দানের একটি পরিস্থিতিও থাকতে হবে। 

(গ) দাতা কেন দিতে চাচ্ছে, তা খতিয়ে দেখতে হবে।

(ঘ) দাতা-গ্রহীতার মধ্যে সম্পর্কের দালিলিক প্রমাণ খতিয়ে দেখতে হবে।
(ঙ) দাতা এবং গ্রহীতার একসাথে তোলা পুরনো কোনো ছবি খতিয়ে দেখতে হবে।

(চ) দাতা-গ্রহীতার মধ্যে কোনো মধ্যস্বত্বভোগী অথবা কোনো দালাল আছে কি না, তা দেখতে হবে।

(ছ) বিগত তিন বছরের দালিলিক প্রমাণ সাপেক্ষে দাতা এবং গ্রহীতার অর্থনৈতিক অবস্থা মূল্যায়ন করে দেখতে হবে। দালিলিক প্রমাণে বড় ধরনের কোনো অসামঞ্জস্য আছে কি না, তাও খতিয়ে দেখতে হবে। 

(জ) নিশ্চিত করতে হবে যে দাতা মাদকাসক্ত নন।

(ঝ) দাতা যদি নিকটাত্মীয় না হন, তবে রক্ত বা বৈবাহিকভাবে সম্পর্কিত যে কোনো প্রাপ্তবয়স্ক দাতাকে অবশ্যই জিজ্ঞেস করতে হবে কেন সে অঙ্গ বা প্রত্যঙ্গ দান করতে চান। আবার কেউ যদি দিতে না চান তাহলে না দিতে চাওয়ার কারণও নথিভুক্ত করতে হবে। 

এসব নীতিমালা তুলে ধরার পর আদালত রায়ে বলেছে, “আমরা মনে করি, এর বাইরেও দাতার মানসিক স্বাস্থ্যের একটি মূল্যায়ন থাকা উচিত। তাছাড়া  অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষকে কিডনি অনুদানের সম্ভাব্য প্রতিকূল প্রভাবগুলোর বিষয়ে দাতাকে অবশ্যই জানাতে হবে।”

রায়ে আদালত বলেছে, স্বেচ্ছাশুভাকাঙ্ক্ষি দাতার ক্ষেত্রে নীতিমালাগুলো অনুসরণ করা হলে এবং অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ যদি নির্দেশনাগুলো কঠোরভাবে নেন তাহলে অবৈধ কিডনি ব্যবসা কমে আসবে।

রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, “বিশ্বের কিছু দেশে যেমন যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও ফ্রান্সে স্বেচ্ছাশুভাকাঙ্ক্ষি অনুদান প্রচলন থাকলেও আমাদের আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক বাস্তবতায় এখনও সামঞ্জস্যপূর্ণ না। ইরানে কিডনিসহ বিভিন্ন মানব অঙ্গ বিক্রির নিয়ন্ত্রিত বাজার রয়েছে। সে দেশে কিডনি দাতাদের সরকার ক্ষতিপূরণ দেয়।”

ইরান ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করে রায়ে এ বিষয়ে অভিমত দিয়েছে উচ্চ আদালত।

সেখানে বলা হয়েছে, প্রথমত, বাংলাদেশে এই মুহুর্তে প্রতিটি কিডনিদাতাকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সামর্থ্য নেই। দ্বিতীয়ত, হাই কোর্ট মনে করে ইরানের মতো কিডনিসহ বিভিন্ন মানব অঙ্গ বিক্রির নিয়ন্ত্রিত বাজার বাংলাদেশের মানুষ ভালোভাবে নেবে না। বরং অবৈধ অঙ্গ ব্যবসায়ের প্রসার ঘটবে।

তবে, দেশের ক্রমবর্ধমান কিডনি রোগী বিশেষ করে মুমূর্ষু রোগীদের জন্য কিডনি বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সরবরাহ করতে এ ধরনের প্রক্রিয়া শুরু করা দরকার বলে মত দিয়েছে হাই কোর্ট।

বর্তমানে দেশে বছরে ৫০০০ কিডনি প্রতিস্থিাপনের চাহিদা থাকলেও প্রতিস্থাপন হচ্ছে মাত্র ১২০ থেকে ১৩০টি কিডনি। ফলে বিদেশ গিয়ে কিডনি প্রতিস্থাপন করে আসতে হচ্ছে রোগীদের।

৩৬ পৃষ্ঠার রায়টি লিখেছেন বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক মইনুল ইসলাম চৌধুরী; যিনি গত ৮ জানুয়ারি অবসরে গেছেন। তার লেখা এ রায়ের সাথে একমত প্রকাশ করেছেন বিচারক খোন্দকার দিলিরুজ্জামান।