ভোটের মাঠে উত্তাপ ছড়াচ্ছেন কাউন্সিলর প্রার্থীরা

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অনেকগুলো ওয়ার্ডে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির একাধিক প্রার্থী রয়েছে, যা ভোটের সমীকরণ জটিল করার পাশাপাশি প্রচারে এনেছে বাড়তি উত্তেজনা।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Jan 2020, 03:58 PM
Updated : 24 Jan 2020, 04:05 PM

অনেক এলাকার ভোটাররা বলছেন, তারা এখনও মেয়র প্রার্থীদের দেখা না পেলেও কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বীদের তৎপরতায় জমজমাট নির্বাচনী পরিবেশ টের পাচ্ছেন। দিনে কয়েকবার এসব প্রার্থী ও তাদের কর্মী-সমর্থকরা আসছেন, প্রায় সারা দিনই মাইকে বাজছে ভোট চেয়ে গান।   

ভোটের এক সপ্তাহ আগে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ওয়ার্ডগুলো প্রার্থীদের প্রচারণায় সরগরম দেখা গেছে।

এবার ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সাধারণ ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর মিলিয়ে ১৬৯টি পদের জন্য লড়ছেন ৭৪৫ জন, যাদের মধ্যে দুই দলের বিদ্রোহী ছাড়াও অন্যান্য দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা রয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অন্তত ২২টি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ এবং ১৭টি ওয়ার্ডে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছে। আর ঢাকা দক্ষিণে ৩৫টি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের এবং ১৩টি ওয়ার্ডে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছে।

উত্তরের ৬ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুটি দলেরই বিদ্রোহী প্রার্থী আছেন। এখানে আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়েছেন রূপনগর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সালাহউদ্দিন রবিন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আছেন ঢাকা মহানগর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তাইজুল ইসলাম চৌধুরী বাপ্পী।

বিএনপির সমর্থন পেয়েছেন মাহাফুজ হোসেন খান সুমন, সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন দলটির আরেক নেতা আমজাদ হোসেন মোল্লাহ।

সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রচারে ব্যানারে সয়লাব ঢাকার কল্যাণপুর। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

রূপনগর এলাকার চা দোকানি সেকান্দার আলীর মতে, দুই দলের একাধিক প্রার্থী থাকায় নির্বাচনের পরিবেশ ‘গরম’।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কাউন্সিলররা তো মাঠ গরম কইরা রাখছে। প্রতিদিনই কেউ না কেউ ভোট চাইতে আসে। সারা দিন এলাকায় মাইক বাজে।”

ঢাকা উত্তরের ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে বর্তমান কাউন্সিলর সালেক মোল্লাকে সমর্থন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। দলের সমর্থন না পেয়ে সেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন তানভীর আহমেদ হায়দার।

বিএনপির লিয়াকত আলীসহ কাউন্সিলর পদে আটজন এখানে লড়াইয়ে থাকায় নির্বাচন জমজমাট হবে বলে আশা এ ওয়ার্ডের বাগানবাড়ি এলাকার বাসিন্দা জাফর রনির।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নির্বাচনে কে জয়ী হয় তা বলা যাচ্ছে না।

“মনে হচ্ছে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। কারণ এখানে অনেক প্রার্থী। দুই দলের বিদ্রোহীর পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও দেখি ভালোমতোই প্রচারণায় আছেন। কে যে জিতবে বলা মুশকিল।”

মাটিকাটা এলাকার ফল বিক্রেতা খলিলুর রহমান জানান, মেয়র প্রার্থীদের ‘দেখা পাওয়া কঠিন’। অনেক কাউন্সিলর থাকায় নির্বাচনের মাঠ গরম।

“নির্বাচন মনে অয় ভালোই হবে। প্রতিদিনই মিছিল মিটিং হইতাছে, সবার প্রচার-প্রচারণা চলতেছে।”

২০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. জাহিদুর রহমানকে প্রথমে সমর্থন দিয়েছিল ক্ষমতাসীন দল। পরে বর্তমান কাউন্সিলর মো. নাছিরের ওপরই ভরসা রাখে তারা। জাহিদুর রহমানও নির্বাচনের মাঠ ছাড়েননি। ভোটের লড়াইয়ে আছেন বিএনপি সমর্থিত মিজানুর রহমান বাচ্চু।

এখানে ত্রিমুখী লড়াই হবে বলে মনে করছেন কড়াইল এলাকার দোকানি আলমগীর হোসেন।

“ফাইট হবে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের প্রার্থীর মধ্যে। জাহিদুর ভাই হয়ত কিছু ভোট কাটবে। এইখানে তুমুল প্রচারণা চলতেছে,” বলেন তিনি।

ঢাকা উত্তরের ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডে হরিরামপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও বর্তমান কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর হোসেন যুবরাজ আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়েছেন। হরিরামপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সোহেল শেখ, তুরাগ থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. জাহিদুল হাসান স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রচারে ব্যানারে সয়লাব ঢাকার কল্যাণপুর। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

একই দলের তিনজন মাঠে থাকায় এই ওয়ার্ডের নির্বাচন ‘জমেছে’ বলে মন্তব্য করেন রানাভোলা এলাকার বাসিন্দা হায়দার আলী।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জাহাঙ্গীর বর্তমান কাউন্সিলর। বাকি দুজনের এলাকায় মোটামুটি প্রভাব আছে। ফলে ভালো লড়াই হবে।”

বাড্ডা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম ৪২ নম্বর ওয়ার্ডে দলের সমর্থন পেয়েছেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছেন বেরাইদ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব আনছার মিন্টু। সেখানে বিএনপি সমর্থিত মো. তুহিনুর ইসলামকে নিয়ে তিনজন প্রার্থী।

নির্বাচন খুবই প্রতিদ্বন্দ্বিপূর্ণ হবে বলে মনে করছেন বেরাইদের বাসিন্দা এমদাদ হোসেন।

“ইতোমধ্যে দুই প্রার্থী নির্বাচনের প্রচারণা শুরু করেছেন। কিছু ঝামেলাও শুরু হয়েছে,” বলেন তিনি।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়েছেন বর্তমান কাউন্সিলর মোকাদ্দেস হোসেন। এখানে বঙ্গবন্ধু পরিষদের লালবাগ থানার সাবেক সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। দুজনের কারণে বিএনপির প্রার্থী মোশাররফ হোসেন খোকন কিছুটা সুবিধা পেতে পারেন বলে মনে করছেন আমলীগোলা এলাকার বাসিন্দা আবু তাহের।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আওয়ামী লীগের হেরে তো অনেকবার সতর্ক করা হইছে, কিন্তু হেয় তো বয় না। দুইজনের ঠেলাঠেলির কারণে ওই দিকে খোকন আবার পাশ করে যায় কি না কে জানে!”

২৭ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়েছেন বর্তমান কাউন্সিলর ওমর-বিন-আব্দাল আজিজ। সেখানে স্বতন্ত্র হিসেবে আছেন আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় উপকমিটির সহ-সম্পাদক সাগর আহমেদ শাহীন।

আওয়ামী লীগের দুজন প্রার্থীই শক্তিশালী জানিয়ে হোসনি দালান এলাকার বাসিন্দা হারুনুর রশিদ বলেন, এই ওয়ার্ডে নির্বাচনের দিন ‘খেলা হবে’।

“আমাদের দুইজনই হেভিওয়েট প্রার্থী। দুজনেই প্রচারণা চালাচ্ছেন সমানতালে। দেইখেন এই ওয়ার্ডে ১ তারিখে কী খেলা জমে!”

৬৬ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপির সমর্থন পেয়েছেন দলের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সহ-সাধারণ সম্পাদক আকবর হোসেন নান্টু। মনোনয়ন চেয়ে না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন এই ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর মো. নূর উদ্দিন মিয়া।

এখানে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা বেশ জাঁকজমকপূর্ণ হচ্ছে বলে জানান বামৈল বাজারের ব্যবসায়ী ফারুক হোসেন। তার মতে, কাউন্সিলর প্রার্থীরাই এলাকার নির্বাচনের পরিবেশ জমিয়ে রেখেছেন।

“মেয়র প্রার্থীরা তো আসে নাই এখন পর্যন্ত। আওয়ামী লীগের লোকজন কিছু মিটিং করে, বিএনপির কেউ মাঠেই নামে না। তবে কাউন্সিলর প্রার্থীরাই নির্বাচন জমাইয়া রাখছে। লাস্ট পর্যন্ত নির্বাচনটা ভালোমতো শেষ হইলেই হয়!”

৬৮ নম্বর ওয়ার্ডে বর্তমান কাউন্সিলর মাহমুদুল হাসানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সারুলিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. সহিদুল ইসলাম এবং আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুস সবুর খান।

ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিনই মিছিল-মিটিং করছেন প্রার্থীর কর্মী- সমর্থকরা। দল সমর্থিত প্রার্থীকেই ভোট দেবেন বলে জানান হাজীনগর এলাকার বাসিন্দা মো. দেলোয়ার হোসেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আব্দুস সবুর খান পারিবারিকভাবে আওয়ামী লীগার। তারা তিনজনই মনোনয়ন চাইছিল। দল একজনকে মনোনয়ন দিলেও বাকি দুজন মনোনয়ন প্রত্যাহার করেননি। আমরা আওয়ামী পরিবারের সন্তান হিসেবে দলের প্রার্থীকেই ভোট দেব। তাদের দুজনের কিছু ভোট আছে, নির্বাচনে বিএনপিও আছে। এ কারণে খুবই জমে উঠেছে।”

ভোটাররা তাদের প্রতিনিধি হিসেবে কাকে বেছে নেবেন, তা দেখার জন্য ১ ফেব্রুয়ারি ভোটের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে।