‘মধুর যন্ত্রণা’ ভোটের গীত

ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের পক্ষে মাইকে প্রচার চালিয়ে ভোট চাওয়া হচ্ছে নগরজুড়ে। জনপ্রিয় সুর নকল করে চলছে প্রার্থীর গুণকীর্তন আর মার্কার জয়গান।

সাইমুম সাদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Jan 2020, 05:25 AM
Updated : 25 Jan 2020, 04:21 PM

ভোটের মাঠের এসব প্যারোডি গানে ঢাকার অলি-গলি সরগরম। তাতে ভোটের আমেজ আসছে, তবে লাগাতার মাইকের উচ্চ শব্দ বিরক্তিও তৈরি করছে ভোটারদের।

‘আইলো গেল কত ভাই, উন্নয়নের বালাই নাই’/ ‘অমুক ভাই, তমুক ভাই, চলেন সবাই ভুইলা যাই’/ ‘--- আপা/ভাইয়ের সালাম নিন, … মার্কায় ভোট দিন ‘/ ‘… নম্বর ওয়ার্ডের উন্নয়ন, … আপা/ভাইয়ের দুই নয়ন’।

কিংবা

‘… নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে আপার কিছু কথা আছে’/ ‘প্রভাবশালীর প্রভাবে জনগণের মনের ব্যথা’/ ‘সন্ত্রাসবাদের আনাগোনা’/ ‘মাদকের আখড়া’/ ‘দখলের কবলে এলাকা’/ ‘নাই নাগরিক সুবিধা/ ‘সোডিয়ামের আলো নাই’/ ‘নিরাপত্তার বালাই নাই/ ‘জনগণের অধিকার পূর্ণ করার কী কেউ নাই’?

মমতাজ, সুবীর নন্দী, আইয়ুব বাচ্চু বা বেবী নাজনীনের মত জনপ্রিয় শিল্পীদের গাওয়া নানা গানের সুর ধার করে তাতে এরকম নানা কথামালা বসিয়ে তৈরি করা গান দিন-রাত অলি-গলিতে বেজেই চলেছে। আবার কোনো কোনো গানে বেশ অভিনবত্বও আছে।  

নির্বাচনী ক্যাম্প থেকে মাঠে ময়দানে রিকশা-অটোরিকশায় বা মিনি ট্রাকে করে তারস্বরে অডিও বাজছে, ভোটের সংগীত ছড়িয়ে পড়েছে সোশাল মিডিয়াতেও। র‌্যাপ স্টাইলে গানের সঙ্গে নাচও আমোদিত করছে নেটিজেনদের।

কিন্তু কোথায় ‘নির্মাণ’ হচ্ছে এসব সংগীত? তাতে নিয়ম মানা হচ্ছে? ভোটাররাই বা কীভাবে নিচ্ছেন?

ভোটের গীতের কারখানা

রাজধানীর মগবাজার, বিজয়নগর, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম মার্কেট এলাকার বেশ কয়েকটি রেকর্ডিং হাউজে এবার রেকর্ড করা হয়েছে অনেক প্রার্থীর নির্বাচনী গান।

স্টেডিয়াম সুপার মার্কেটের সাউন্ড মিউজিক রেকর্ডিং হাউজে ‘খাইরুন লো’, ‘আম্মাজান’ ‘মরার কোকিলে’সহ বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় গানের সুরের ওপর প্রার্থীর পছন্দের কথা বসিয়ে ১৩টির নির্বাচনী গান তৈরি করেছে। 

প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার জাহাঙ্গীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা সিনেমার গানের ওপর ট্র্যাক বসিয়ে গানগুলো করেছি। প্রথমে প্রার্থীদের মেইলে গানের কথা পাঠাই, তারা পছন্দ করলে সে অনুযায়ী গান বানাই।”

এবার পাঁচটি নির্বাচনী গান রেকর্ড করেছেন বলে জানালেন বিজয়নগরের স্টুডিও ‘মিডিয়া ও প্রচার সেন্টারের’ মালিক ফারুক হোসেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, এর মধ্যে ‘আম্মাজান’ ‘আমি তো ভালা না’, ‘মরার কোকিলে’ গানের সুরও তিনি ব্যবহার করেছেন।

“মরার কোকিলে’র সুর দিয়ে তৈরি এলাকায় এলো রে সিটি নির্বাচন’ গানটি সব প্রার্থীর প্রচারেই কাজে লাগছে; বাকিগুলো নির্দিষ্ট প্রার্থীর নাম আর প্রতীক ধরে করেছি।”

আইনে লেখা শাস্তির কথা

গণতন্ত্রের স্বাস্থ্যের জন্য এই উৎসবের আমেজ খুবই জরুরি, কিন্তু সুর নকল করে তৈরি এসব নির্বাচনী গানে যে মেধাস্বত্ত্বের বালাই থাকছে না, সে কথাও বললেন বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসের রেজিস্ট্রার জাফর রাজা চৌধুরী।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, কোনো গানের সুর বিকৃতি ও কথা পরিবর্তন করে মন মতো গান প্রচার করলে তা কপিরাইট আইনের লঙ্ঘন। এর শাস্তি হিসেবে ৬ মাস থেকে ৪ বছরে কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে।

সময়জ্ঞান

কেউ যদি আদালতে গিয়ে মামলা না করেন, তাতে গানের কপিরাইট নিয়ে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তবে নাগরিকদের কান ঝালাপালা হচ্ছে ঠিকই।

অলি-গলিতে মাইকে উচ্চস্বরে এসব গানের আওয়াজে এসএসসি পরীক্ষার্থী, প্রবীণ ও শিশুদের ভোগান্তির কথা বললেন বিভিন্ন এলাকার ভোটাররা। কেউ বিরক্তি প্রকাশ করলেন তীব্র ভাষায়, কেউ আবার বললেন ‘মধুর যন্ত্রণা’।

ঢাকা দক্ষিণ সিটির পল্টন এলাকার বাসিন্দা নওরিন জাহান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাসায় তিন মাসের বাচ্চা; দিন-রাত মাইকের যন্ত্রণায় দরজা-জানালা বন্ধ করে থাকতে হচ্ছে।”

হাসপাতালের আশেপাশেও উচ্চস্বরে মাইক বাজানোর অভিযোগ তুলে খিলক্ষেতের বাসিন্দা জসিম উদ্দিন বলেন, “ভোটকে কেন্দ্র করে যে ধরনের শব্দ দূষণ হচ্ছে সেটা দেখার কেউ কি নেই?”

ভোটের প্রচারে গান বেঁধে বাজানোর রীতি পুরনো হলেও নির্বাচনী আচরণবিধিতে মাইক ব্যবহারের সময়সীমা রয়েছে। বেলা ২টার আগে ও রাত ৮টার পর মাইক বাজানো নিষিদ্ধ।

উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা গণেশ সাহা জানালেন, তার এলাকায় রাত ১১টা পর্যন্ত মাইকে ভোটের প্রচার চলছিল।

“সামনে বাচ্চাদের এসএসসি পরীক্ষা; এত শব্দের মধ্যে পড়ালেখায় ক্ষতি হচ্ছে। আমাদের অনুরোধে প্রার্থীদের কয়েকজন রাতে মাইক বাজানো বন্ধ করেছেন।”

মহাখালী এলাকার বাসিন্দা এক শিক্ষক বললেন, আইন জানার ও মানার পাশাপাশি সময়জ্ঞানও জরুরি।

“স্কুলের সময়, বাচ্চাদের লেখাপড়ার সময়- কখন বাজে না মাইক? এটা আসলে বোধের বিষয়; সচেতনতার বিষয়। সবকিছু তো আইন দিয়ে শাস্তি দিয়ে বাস্তবায়ন করা যায় না। কার অসুবিধা হচ্ছে- তা আমাদেরকেই ভাবতে হবে।”

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের আগারগাঁওয়ে একজন কাউন্সিলর প্রার্থীর পক্ষে প্রচারের জন্য পিকআপে সাউন্ড বক্স তোলা হচ্ছে।

বরাবরের মতই ‘তৎপর’’ ইসি

ভোটের বাজারে ‘শব্দদূষণ’ ঠেকাতে নির্বাচন কমিশন কী করছে তা জানতে চাইলেন কয়েকজন ভোটার। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম সেই প্রশ্ন পৌঁছে দিয়েছিল নির্বাচনী কর্মকর্তাদের কাছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সহকারী রিটার্নিং অফিসার নজরুল ইসলাম বললেন, বিভিন্ন এলাকা থেকে তারাও ‘নিয়মবহির্ভূত’ মাইকিংয়ের অভিযোগ পেয়েছেন। নির্বাহী হাকিমদের বলা হয়েছে যেন তারা নিজ নিজ এলাকায় এ ধরনের ঘটনায় তাৎক্ষণিক জরিমানা করেন।

আর দক্ষিণের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান আলমাস বললেন, “বেলা ২টার আগে ও রাত ৮টার পর মাইকিং করার দুয়েকটা অভিযোগ পেয়েছি আমরা। বিষয়গুলো নির্বাহী হাকিমদের জানানো হয়েছে।”

মাঠে থাকা নির্বাহী হাকিমরা বিষয়টি কীভাবে সামলাচ্ছেন? ঢাকা উত্তরের ৪, ১৫, ও ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইয়াসমিন মনিরা বললেন, আনুষ্ঠানিক অভিযোগ না পেলেও আচরণবিধি প্রতিপালনে ‘তৎপর’ রয়েছেন তারা।

“আমরা অভিযান চালাচ্ছি। প্রার্থীদের বলা হয়েছে তাদের প্রচারের মাইক যেন উচ্চস্বরে বাজানো না হয়। যেখানে দেখছি মানুষের অসুবিধা হচ্ছে, সেখানে শব্দদূষণ না করার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি।”

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটিতে ১ ফেব্রুয়ারি ভোট হবে। এবার মেয়র, সাধারণ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর মিলিয়ে সাতশর বেশি প্রার্থী রয়েছে। ১০ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া প্রচারণা চলবে ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত।