দুই কারণে এখন ইভিএমের পক্ষে মাহবুব তালুকদার

ইভিএমসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নির্বাচন কমিশনের একাধিক সভা বর্জন করে আলোচিত নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এই যন্ত্রে ভোটগ্রহণের পক্ষে অবস্থান জানিয়েছেন।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Jan 2020, 03:23 PM
Updated : 22 Jan 2020, 07:23 PM

ভোটের নয় দিন আগে বুধবার বিকালে নির্বাচন নিয়ে আইনশৃঙ্খলা সভায় মাহবুব তালুকদার বলেছেন, ‘আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরার’ সংস্কৃতি ও শতভাগ ভোট পড়ার অবসান ঘটাতে ইভিএমের পক্ষে রয়েছেন তিনি।

আগামী ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণে আপত্তি জানিয়ে আসছে বিএনপি ও দলটির মেয়র প্রার্থীরা। এই যন্ত্র বাদ দিয়ে প্রয়োজনে নির্বাচন পিছিয়ে ব্যালটে ভোটের ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়েছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

মাহবুব তালুকদার বলেন, “ইভিএম নিয়ে পূর্বে আমি ক্রিটিকাল থাকলেও দুটি কারণে এখন ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে। একটি হচ্ছে, এতে ভোটের আগের রাতে ব্যালট পেপারে বাক্স ভর্তি করার সংস্কৃতির অবসান ঘটতে পারে।

“দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, নির্বাচনে কোনো কোনো কেন্দ্রে শতকরা একশত ভাগ ভোট পড়ার যে অভিজ্ঞতা আমরা অর্জন করেছি, ইভিএম ব্যবহারে তারও অবসান হবে।”

নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার (ফাইল ছবি)

ইভিএমের বিরোধিতাকারীদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, “আমার পরামর্শ হচ্ছে, ইভিএম-এর জানাজা না পড়ে বরং এর জন্ম উৎসব পালনের কথা বিরোধীরা ভাবতে পারেন।”

এই অবস্থানের কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “যারা ইভিএম ব্যবহারের বিরোধিতা করছেন, তাদের বক্তব্য অনেক সময় তাদের সমর্থক ভোটারদের মনেও বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছে। এমতাবস্থায় তাদের সমর্থক ভোটাররা যাতে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ইভিএমে ভোট দিতে আগ্রহী হন, এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ আবশ্যক।”

গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়ার তথ্য তুলে ধরে এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, “পৃথিবীতে কোনো নির্বাচনেই এ ধরনের ভোটার উপস্থিতির নজির নেই। রাতে ব্যালট পেপারে বাক্স ভর্তি ও কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়ার অপবাদ থেকে আমরা মুক্ত হতে চাই।

“যা হোক, ইভিএম-এর বিরুদ্ধবাদীদের বলতে চাই, বর্তমানের রূঢ় বাস্তবতা হচ্ছে, যে কোনো অবস্থাতেই আসন্ন দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সবগুলো কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহৃত হবে। এর কোনো অন্যথা হবে না। ”

আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক সভায় উপস্থিত কর্মকর্তাদের একাংশ

এই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার নির্বাচন কমিশনের জন্য ‘এক অগ্নিপরীক্ষা’ মন্তব্য করে মাহবুব তালুকদার বলেন, “নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি বৃদ্ধিও একান্ত অপরিহার্য। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা একান্তভাবে কাম্য। ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সাফল্যের ওপর নির্ভর করছে এই যন্ত্রটির ভবিষ্যৎ।”

এই নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার প্রশ্নবিদ্ধ হলে শুধু নির্বাচন নয়, ইভিএমের ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে বলে সতর্ক করেন তিনি।

লিখিত বক্তব্যে মাহবুব তালুকদার বলেন, “আমার মতে যে কোনো নির্বাচনে শতকরা ৫০ ভাগ ভোট না পড়লে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। এজন্য বিশ্বের অনেক দেশে ৫০ শতাংশের কম ভোট পড়লে পুনরায় ভোটগ্রহণ করা হয়। ইভিএম সম্পর্কে আমার বক্তব্যের বটম লাইন হল, ইভিএমে যদি ৫০ শতাংশ ভোট না পড়ে, তাহলে ব্যালট পেপারে পুনরায় ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত।”

তিনি জানান, চট্টগ্রাম-৮ আসনের উপনির্বাচনে সবগুলো কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার করা হয়। এতে ২২ দশমিক ৯৪ শতাংশ ভোট পড়েছে। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম বিহীন ব্যালট পেপারে যে ২৯৪টি আসনে ভোট হয়েছে, ভোটের হার যেখানে ছিল শতকরা ৮০ ভাগ, সেখানে ইভিএম ব্যবহারে ২৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ কম ভোট পড়েছে।

“এর কারণ ভোটারদের মনে আছে ইভিএম ভীতি।”

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও অন্যান্য নির্বাচন কর্মকর্তাদের সম্মিলিতভাবে ভোটকেন্দ্রের গোপন কক্ষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আবশ্যক বলে উল্লেখ করেন তিনি।

ইভিএমে জালিয়াতির সুযোগ নেই: ব্রিগেডিয়ার সাইদুল

ইভিএমে ভোট জালিয়াতির কোনো সুযোগ নেই বলে দাবি করেছেন নির্বাচন কমিশন থেকে ইভিএম পরিচালনায় সার্বিক দেখভালের দায়িত্বে থাকা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম।

ইসির জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের (এনআইডি উইং) মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম (ফাইল ছবি)

আইন শৃঙ্খলা সভায় সংশ্লিষ্টদের উপস্থিতি ইভিএম নিয়ে বিশেষ উপস্থাপনা তুলে ধরেন নির্বাচন কমিশনের এনআইডি উইং মহাপরিচালক সাইদুল ইসলাম।

আট বছর ধরে ইভিএম যাত্রার নানা তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, রংপুরে ২০১৭ সালে প্রথমবার ইভিএম ব্যবহার হয়। পরে বিভিন্ন নির্বাচনে এর ব্যবহার করা হয়েছে।

এ প্রযুক্তিতে ভোটগ্রহণের স্বচ্ছতা নিয়ে ব্রিগেডিয়ার সাইদুল বলেন, “নির্ধারিত সময়ের আগে মেশিনটি খোলা সম্ভব নয়। কারণ এটি পাসওয়ার্ড প্রোটেকটেড। আর ভোটের দিন সকাল ৭টার আগে খোলা যাবে না। অনুমোদিত কর্মকর্তা ছাড়া এটি খোলা সম্ভব নয়।”

এ মেশিন ছিনতাই হওয়ার সম্ভাবনা নেই দাবি করে তিনি বলেন, মেশিন ছিনতাই হলেও সমস্যা নেই। যে রিজার্ভ মেশিন থাকবে, তা দিয়ে ভোট কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে।

সাইদুল ইসলাম বলেন, “ইভিএম মেশিন খোলার ক্ষেত্রে বায়োমেট্রিক ভেরিফিকেশন এবং ব্যক্তির উপস্থিতি বাধ্যতামূলক হওয়ায় কেন্দ্র দখল করেও কোনো লাভ নেই। কারণ এক ব্যক্তি আরেকজনের ভোট দিতে পারবেন না। কেউ দ্বিতীবার ভোট দিতে চাইলে মেশিন স্বয়ংক্রিয়ভাবে বলে দেবে, আপনি আগে ভোট দিয়েছেন, যেটি পোলিং এজেন্টও দেখতে পারবেন।”

২০১১ সালে যে ইভিএম ব্যবহার করা হয়েছিল, সেখানে ব্যক্তিকে যাচাই করার করার ব্যবস্থা ছিল না জানিয়ে তিনি বলেন, “নতুন ইভিএম যেটি ব্যবহার করছি তাতে যে কোনো ব্যক্তিকে ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে সার্ভারের মাধ্যমে চিহ্নিত করা সম্ভব।”

বর্তমান ইভিএমে ভোটার চিহ্নিত করার জন্য যে কয়েকটি পর্যায় রয়েছে তার মধ্যে একজন ব্যক্তিকে চারভাবে চিহ্নিত করা যায় বলে জানান তিনি।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে ব্রিগেডিয়ার সাইদুল বলেন, “চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে ইভিএমে একটি থাকে কন্ট্রোল ইউনিট, আরেকটি ব্যালট ইউনিট। সমস্ত প্রকার সফটওয়্যার আপগ্রেড করেছি। সফটওয়্যার বাংলাদেশে তৈরি।

“ইভিএম মেশিনে ভোটগ্রহণের শুরুতে এজেন্টদের আমরা দেখিয়ে দেই মেশিনে শূন্য ভোট দিয়ে ভোটগ্রহণ শুরু হচ্ছে। কোন মার্কায় ভোট দেওয়া হচ্ছে, মেশিন ঠিক আছে কি না। তারপর আমরা ভোটগ্রহণ শুরু করি।”

“ভোটের সব কিছু কিন্তু পোলিং কার্ডে সংরক্ষিত রয়েছে। যে কোন তথ্য যাচাই করতে চাইলে তা করা সম্ভব,” বলেন তিনি।

ইভিএম একদিন প্রতিষ্ঠিত হবে: সিইসি

সভার শুরুতে স্বাগত বক্তব্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা বলেন, নির্বাচনে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে ইভিএমে ভোটগ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

এর আগেও প্রযুক্তির সফল ব্যবহারের দাবি করে তিনি বলেন, “এক সময় দেড় কোটি জাল ভোটারও হয়েছিল। এখন বায়োমেট্রিক সিস্টেমে একজনের ভোট আরেকজন দিতে পারে না।”

ঢাকার সিটি ভোটে স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র, এনআইডি ও ইভিএম- তিনটির সমন্বয় থাকার কথা জানিয়ে সিইসি বলেন, “এ পদ্ধতিতে জাল ভোট দেওয়ার সুযোগ নেই। ইভিএমে ভুয়া ভোটার ভোট দিতে পারবে না।”

ইভিএম নিয়ে কোনো কোনো দলের আপত্তি ও সমালোচনা মেনে নিয়ে নূরুল হুদা বলেন, “সংস্কার হাতে নিলে প্রতিবন্ধকতা থাকেই। ওই বিষয়ে কিছুটা বুঝতে জানতে দেরি হয়। অভ্যাসগতভাবে বিরোধিতা করা হয়, সমালোচনা হয়।

“সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারলে, ভুল না থাকলে প্রতিষ্ঠিত হবে। আমি নিশ্চয়তা দিতে পারি, ইভিএমের পরিচিতি আরও বাড়িয়ে দিলে একদিন এতেই নির্বাচন হবে সবখানে।”