‘ভোট দিছি, কিন্তু কোনো জিনিসই তো পাই না’

বস্তি এলাকার উন্নয়নে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নানা উদ্যোগ নেওয়ার কথা থাকলেও তার কোনোটির বাস্তবায়ন হয় না বলে অভিযোগ করেছেন বস্তিবাসীরা।

জয়ন্ত সাহাও আল হাসান রাকিববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Jan 2020, 03:30 PM
Updated : 21 Jan 2020, 04:47 PM

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় বস্তিতে বসবাসরতদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ তাদের স্থায়ী আবাসন নিয়ে। নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কার কথাও বলছেন তারা।

বস্তিবাসীদের অভিযোগ, নির্বাচিত মেয়র ও কাউন্সিলররা তার দুর্দিনে পাশে এসে দাঁড়ান না। সমস্যার কথা বলতে গেলে উল্টো তাড়িয়ে দেন।

এবার সিটি নির্বাচনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম)। তা নিয়ে বস্তিবাসীর অধিকাংশের নেই কোনো ধারণা।

ঢাকা মহানগরে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বস্তিতে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ মানুষের বসবাস বলে ২০১৪ সালে পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক জরিপে উঠে এসেছিল। এর মধ্যে ঢাকা উত্তরে ১,৬৩৯টি বস্তিতে জনসংখ্যা ৪,৯৯,০১৯ জন। ঢাকা দক্ষিণে ১,৭৫৫টি, বস্তির বাসিন্দা ১,৪৭,০৫৬ জন।

এই বস্তিবাসীর বড় অংশই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে মোট ৫৪ লাখ ভোটারের মধ্যে রয়েছেন।

বস্তির বাসিন্দারা বলছেন, ভোটের সময় উন্নয়নে শত প্রতিশ্রুতি দিলেও ভোট শেষ হয়ে যাওয়ার পর জনপ্রতিনিধিদের আর দেখা মেলে না।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২৪ নং ওয়ার্ডের তেজগাঁও রেলওয়ে কলোনির বাসিন্দা নুরুন্নাহার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “১৮ বছর ধইরা আছি এই এলাকায়।  কিচ্ছু পাই নাই। ভোট দিছি, কথা সত্য। কিন্তু সরকারি কোনো জিনিসই পাই না আমরা।”

নুরুন্নাহারের আরও ক’জন প্রতিবেশীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সদ্য সাবেক কাউন্সিলর ড্রেনেজ ব্যবস্থার ‘খানিকটা উন্নয়ন’ আর শীতবস্ত্র দান করে দায় সেরেছেন।

সরকারি জমি দখলমুক্ত করতে রেলওয়ে এই এলাকা থেকে বস্তিবাসীদের উচ্ছেদ করতে অভিযান চালিয়েছিল; কিন্তু তাতে ফল হয়নি। বস্তিবাসীরা রয়ে গেছেন আগের জায়গাতেই।

ওই বস্তির বাসিন্দা আব্দুল মান্নান বলেন, “সরকারি জায়গা ঠিক আছে। এইখানে সরকারি লোকজন তো থাকে না। তারা দুই .. চার,.. পাঁচ হাজার টাকায় ঘর ভাড়া দিয়া অন্যখানে থাহে।  আমরা এইখানে সরকারের কোনো সুযোগ সুবিধা পাই না।

“এলাকা যে ভাইঙ্গা দিছে, লক্ষ লক্ষ মানুষের ক্ষতি হয়ে গেছে। অনেকের সংসারও নষ্ট হয়ে গেছে। এ খবর কে নেয়। কেউ নেয় না… আমরা এখন অসহায়। ”

স্থায়ী নিবাসের দাবিতে একাধিকবার কাউন্সিলরের কাছে গেলেও তিনি পাত্তা দেননি বলে অভিযোগ তাদের।

আবুল কাশেম বলেন, “স্থায়ী ঘর চাইলে তো দিতাছে না। কোনো তদন্ত নিতাছে না। কে পাইব, কে না পাইব। যারা ভোট করব, তারা কেউ খবর নেয় নাই।”

রোকেয়া বেগম বলেন, “ঘর চামু? কিন্তু কার কাছে চামু কন তো? হেই মানুষটা খুঁইজা দেন? যার কাছে বাড়ি গাড়ি চামু। তাইলে তো আমাদের রাস্তাঘাটে থাকুন লাগে না। আঙ্গ নাই বাড়িঘর, নাই জমিন, কর্ম কইরা খাইতে হয়, তাও তো কইরা খাইতে পারতাছি না বস্তিত। তাও তো ভাইঙ্গা দিসে। তাও আমাগো ভোট তো দিওনই লাগে, না দিলে তো চলে না।”

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর ওয়ার্ডের শাহজাহানপুর রেলওয়ে বস্তির ভোটার আব্দুল আওয়াল বলেন, “আমাদের থাকুনের জায়গার ঠিক নাই। ভোট আইলেই বা আর না আইলেই বা কী?

“আমরা আজকে এইখানে তো কালকে ঐখানে। আমাদের ভোটের পরিবেশ জিগায়া কোনো লাভ নাই।”

গত বছর অগাস্টে আগুনে পুড়ে ছাই হয় রূপনগর থানার ঝিলপাড় বস্তির। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৭ নং ওয়ার্ডে পড়েছে সেই বস্তি।

সেই বস্তিতে ক্ষতিগ্রস্ত শাহাদাৎ হোসেন বলেন, “আগুন লাগুনের পর মেয়র সাব আইছিল। কইছিল আমাগো নাকি ভালো বাড়িঘর বানায়া দিয়া থাকতে দিব। কই কী হইল? এসব কয় ভোট পাওনের লেইগ্যা। বাস্তবে তারা কোনো কাজ করে না। আমরা গরিব। আমাগো ঘর পুড়লে তাগো কি?”

নুরুন্নাহার বেগম বলেন, “সেই আগুনের পর থিকা কেম্নে যে বাচ্চাকাচ্চা নিয়া চলতাসি, সে খবর কি তারা রাখছে? তারা এখন আইতাছে, ভোট চাইতাছে। অবশ্য গরিবের ভোটের আর কী দাম আছে বলেন?”

উত্তরের ১৯ নং ওয়ার্ডের কড়াইল বস্তির তরুণ ভোটার মোহাম্মদ রায়হান বলেন, “আমাদের ভাগ্যের পরিবর্তন নাই। নির্বাচন আসে, তখন প্রার্থীরা আসে ভোট চাইতে। কিন্তু নির্বাচন হয়া গেলে প্রার্থীরা আসে না খোঁজখবর নিতে।”

ঢাকা উত্তরের ২০ নং ওয়ার্ডে সাততলা বস্তির বাসিন্দাদের এক ভোটার অভিযোগ করেন, “এলাকার সবচেয়ে বড় সমস্যা হইতাছে, ছেলেপেলেদের পড়াশোনার ভালো বন্দোবস্ত নাই।  মাস্তানি, চাঁদাবাজি অহরহ চলে। কিন্তু কেউ এসব নিয়া কাউন্সিলররে কইতে যায় না। বিচার চাইতে গেলে সমস্যা আছে।”

কারওয়ান বাজার বস্তির বাসিন্দা মাহতাব উদ্দিন বাবু বলেন, “কীসের প্রতিবাদ করব? কাদের নামে? এরা বড় খারাপ। কিছু কওন যায় না। জানের মায়া আছে।”

নুরুন্নাহার ও আব্দুল মান্নানকে প্রশ্ন করা হয় ইভিএম নিয়ে।

বস্তি এলাকাতে প্রার্থীরা ভোট চাইতে গেলেও তাদের ইভিএম নিয়ে কোনো ধারণা দেননি বলে অভিযোগ করেন তারা।

নুরুন্নাহার বলেন, “ইভিএম কী হেইডা জানি না। কেন্দ্রে যামু। গিয়া দেখমু কেমনে ভোট দেওন লাগে।”

উত্তরের ২০ নং ওয়ার্ডের কড়াইল বস্তির তরুণ ভোটার মোহাম্মদ রায়হান বলেন,  “মেশিন নতুন যখন বাইর হইছে। সেটা তো আমরা দেখি নাই, দেখলে তখন বুঝব সেইডা কেমন।”

তবে এত অভাব-অভিযোগের পরও বস্তিবাসীরা চান, এবার সিটি নির্বাচন যেন সুষ্ঠু হয়।

 

কড়াইলের মোহাম্মদ রায়হান বলেন, “এবারের নির্বাচন যেন সুষ্ঠু হয়। আমরা ভালো মানুষকে আশা করি। তবে এইবার একটু চেঞ্জ হোক। একটু চেঞ্জ হওয়ার প্রয়োজন আছে।”

রায়হানের প্রতিবেশী আবুল কাশেম বলেন, “যারা বস্তির জন্য কাজ করব বইল্যা মনে হয়, তাগোরে ভোট দিমু।”