আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে ঘিরে পুরো ঢাকা ছেয়ে গেছে প্রার্থীদের পোস্টারে। প্রার্থীরা পরিচ্ছন্ন নগরী উপহার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গেলেও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পলিথিনে মোড়া তাদের পোস্টার ঝুলছে অলিগলিতে।
Published : 20 Jan 2020, 01:45 PM
এক্ষেত্রে নাগরিক ও পরিবেশকর্মীরা প্রার্থীদের দায়িত্বশীলতা নিয়ে তুলছেন প্রশ্ন। অন্যদিকে বর্ষা মৌসুমে নালা-নর্দমায় আটকে যাওয়া এসব পলিথিন জলাবদ্ধতা বাড়িয়ে তুলতে পারে, তা নিয়ে চিন্তিত সিটি করপোরেশনের কর্তাব্যক্তিরা।
গত একাদশ জাতীয় নির্বাচনের সময়ও পলিথিনে মোড়ানো কিছু পোস্টার দেখা গিয়েছিল। তবে এবার সিটি ভোটে প্রায় সব প্রার্থীই এ ধরনের পোস্টার ব্যবহার করছেন। এমনকি রাজধানীতে লেমিনেটিং করা পোস্টারও দেখা গেছে।
রাস্তার ওপর রশিতে ঝোলানো এসব পোস্টার প্রায়ই ছিঁড়ে পড়ে নালায় চলে যায় বলে জানান লালবাগের জগন্নাথ সাহা রোডের বাসিন্দা মনির হোসেন।
রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “রাতে এইখানে অনেক ট্রাক আসে। ট্রাকের গায়ে লাইগা পোস্টার ছিঁড়া পইড়া যায়। এখন তো বৃষ্টির দিন না এখন প্লাস্টিকে মোড়ানো পোস্টার না লাগাইলেই ভালো হইত।”
এ ধরনের পোস্টার ব্যবহারের ফলে প্রার্থীদের দায়িত্বশীলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা ব্যাংক কর্মকর্তা কাজী মাহমুদ।
তিনি বলেন, “মেয়র প্রার্থীরা বলছেন, নির্বাচিত হলে ভালো পরিবেশ দেবেন। কিন্তু পরিবেশ রক্ষার নমুনা এই? নির্বাচনের পর এসব পোস্টারের শতভাগ যে অপসারণ করা হবে না, এটা আমরা ধরে নিতে পারি। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এ রকম দেখেছি।
জানতে চাইলে উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী আতিকুল ইসলামের নির্বাচনী প্রচারণা সেলের সমন্বয়ক সাইফুদ্দিন ইমন বলেন, তারা প্রথমে পলিথিনে মোড়া পোস্টার ছাপালেও এখন আর সেগুলো দিচ্ছেন না।
“আমরা শুরুতে কিছু পোস্টার করেছিলাম পলি দিয়ে। কিন্তু এটা নিয়ে আপত্তি আসার পর এখন আর পলি দিয়ে পোস্টার করছি না। কিছু পোস্টার আমরা নষ্ট করে দিয়েছি।”
পরিবেশ আইনে যা আছে: ১৯৯৫ সালের বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ৬/ক ধারায় বলা হয়েছে, “সরকার, মহা-পরিচালকের পরামর্শ বা অন্য কোনভাবে যদি সন্তুষ্ট হয় যে, সকল বা যে কোন প্রকার পলিথিন শপিং ব্যাগ, বা পলিইথাইলিন বা পলিপ্রপাইলিনের তৈরী অন্য কোন সামগ্রী বা অন্য যে কোন সামগ্রী পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, তাহা হইলে, সরকারী গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, সমগ্র দেশে বা কোন নির্দিষ্ট এলাকায় এইরূপ সামগ্রীর উত্পাদন, আমদানী, বাজারজাতকরণ, বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করিবার বা প্রজ্ঞাপনে নির্ধারিত শর্তাধীনে ঐ সকল কার্যক্রম পরিচালনা বা ব্যবস্থাপনার বিষয়ে নির্দেশ জারী করিতে পারিবে এবং উক্ত নির্দেশ পালনে সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তি বাধ্য থাকিবে।” “তবে রপ্তানি উদ্দেশ্য এবং বিভিন্ন পণ্যের মোড়কের জন্য পলিথিন ব্যবহার করা যাবে।” |
ডিএনসিসিতে বিএনপির মেয়রপ্রার্থী তাবিথ আউয়ালের ব্যক্তিগত সহকারী মাহমুদুল হাসান জানিয়েছেন, সব প্রার্থীর পোস্টারই পলিথিনে মোড়ানো। কুয়াশা থেকে রক্ষা করতে তারাও একই কাজ করেছেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী ফজলে নূর তাপসের মিডিয়া সমন্বয়ক তারেক শিকদার বললেন, এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কোনো নিষেধ নাই।
“লেমিনেশন করা যাবে কিনা এ বিষয়ে কোনো বাধা নেই। আমরা লেমিনেশন করে দিয়েছি, এটাকে পলিথিন হিসেবে চিন্তা করি নাই। এই পলিথিনটা মনে হয় পরিবেশ অধিদপ্তরের নিষেধাজ্ঞারা বাইরে।”
এসব পোস্টার নিয়ে নির্বাচন কমিশনের যে বেশিকিছু করার নেই তার সত্যতা মিলল ডিএসসিসি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আবদুল বাতেনের কথাতেও।
“আমাদের আচরণবিধিতে পোস্টার লাগানোর বিষয়ে বলা আছে। কিন্তু পলিথিনসহ পোস্টার ব্যবহার করা যাবে কি, যাবে না বিষয়টি ক্লিয়ার না। প্রার্থীরা আমাদের বলেছে কুয়াশায় ভিজে এগুলো (পলিথিন ছাড়া পোস্টার) পড়ে যায়। আমরা বলেছি, পড়ে গেলে আবার লাগাবেন।”
পলিথিন যখন মাথাব্যথার কারণ
সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এবারের নির্বাচনে পলিথিনে মোড়ানো পোস্টার অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি দেখছেন তারা। বিষয়টি নিয়ে তারাও চিন্তিত।
ডিএসসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের একজন কর্মকর্তা নামপ্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এসব পোস্টার অপসারণ না করলে তা ম্যানহোল ও নর্দমায় আটকে থাকে। ফলে পানি নিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত হয়।
“পলিথিনের ব্যবহার তো সরকারিভাবেই নিষিদ্ধ। তারপরও প্রার্থীরা এসব পোস্টার কিভাবে লাগান বুঝতে পারি না। এগুলো পচনশীল না, ড্রেনে গেলে জ্যাম হয়ে যায়। নির্বাচনের পর এসব পোস্টার প্রার্থীরা খোলেও না। আমাদেরই খুলতে হয়।”
একই কথা বলেছেন উত্তর সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী একরামুল হক।
“ড্রেনেজ সিস্টেমে গেলে এগুলো ঝামেলা তৈরি করে। কিন্তু আমাদের কিছুটা কষ্ট হলেও নির্বাচনের পর আমরা এগুলো সরিয়ে নেব।”
পলিথিনে মোড়া নির্বাচনী পোস্টার বহুল ব্যবহারের বিষয়টি চোখে পড়েছে ‘পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন’ (পবা) এর চেয়ারম্যান আবু নাসের খানেরও।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “প্লাস্টিকের নিষিদ্ধ হওয়া বা না হওয়ার চেয়ে বড় বিষয় এটি ক্ষতিকর। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা পরিবেশ ভালো রাখবেন এ প্রত্যাশা সবার। কিন্তু উনারা নিজেরাই যদি বিষয়টি না বোঝেন তাহলে পরিবেশটা কিভাবে ভালো থাকবে?”
এ বিষয়ে প্রার্থী, নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে দায়িত্বশীলতা আশা করেন তিনি।